সুশাসন-নির্বাচন কমিশনের পাঁচসালা পরিকল্পনা by বদিউল আলম মজুমদার

আমরা নির্বাচন কমিশনকে আরও ক্ষমতায়নের পক্ষে। তবে ক্ষমতায়নের সঙ্গে সঙ্গে কমিশনের দায়বদ্ধতাও নিশ্চিত করতে হবে। অতীতে বিচারপতি আজিজের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের অপকর্মের বিষয়গুলো এখনও অনেকের স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি।


তারা যে ভোটার তালিকা করার নামে কোটি কোটি টাকা অপচয় করেছে তার দায় তাদের নিতে হবে। তাই কমিশনের দায়বদ্ধতার বিষয়টিও কর্মপরিকল্পনায় আসা উচিত


আমার প্রয়াত শিক্ষাগুরু পিটার ড্রাকার বলতেন, 'তুমি কোথায় যেতে চাও তা যদি পরিকল্পনা না কর, তাহলে যেখানে যেতে চাও না, সেখানে গিয়ে তুমি পেঁৗছতে পার।' (্তুওভ ুড়ঁ ফড়হ্থঃ ঢ়ষধহ যিবৎব ুড়ঁ ধিহঃ ঃড় মড়, ুড়ঁ রিষষ বহফ ঁঢ় মড়রহম ংড়সবযিবৎব বষংব যিবৎব ুড়ঁ ফড়হ্থঃ ধিহঃ ঃড় মড়.্থ) তাই সময়, শ্রম ও সম্পদের যথার্থ ব্যবহারের মাধ্যমে নির্ধারিত লক্ষ্যে পেঁৗছতে হলে পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এ বুদ্ধিভিত্তিক কাজটি সচরাচর আমাদের দেশে, বিশেষত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে হয় না, যার ফলে অনেক ক্ষেত্রে আমরা সফল হই না এবং আমাদের কাজের ধারাবাহিকতাও থাকে না। আমাদের নির্বাচন কমিশন এক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য তারা একটি 'রোডম্যাপ' তৈরি করে অগ্রসর হয়েছিল এবং নির্ধারিত সময়ে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে পেরেছিল, আগামী পাঁচ বছরের জন্যও বর্তমানে তারা পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হওয়ার পদক্ষেপ নিচ্ছে। কমিশনকে অভিনন্দন।
এ ব্যতিক্রমী পদক্ষেপের অংশ হিসেবেই গত ১৮ এপ্রিল বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন তার পঞ্চবার্ষিক কৌশলগত পরিকল্পনা ও দ্বিবার্ষিক কর্মপরিকল্পনা রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সামনে প্রকাশ করে। এটি ছিল একটি অভূতপূর্ব ঘটনা, কারণ অতীতে কোনো কমিশন এ ধরনের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও প্রকাশ করেনি। এর মাধ্যমে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে, বর্তমান কমিশনারদের মেয়াদ শেষের পর, তাদের স্থলাভিষিক্তরা যাতে শূন্যতার মধ্যে শুরু করতে না হয় তা নিশ্চিত হবে। একই সঙ্গে কৌশলগত পরিকল্পনা ও কর্মপরিকল্পনার মতো একটি আধুনিক ব্যবস্থাপনা হাতিয়ার ব্যবহার করে তারা সামনে অগ্রসর হতে পারবেন, যা তাদের সফলতা নিশ্চিত করবে।
আগামী পাঁচ বছরের জন্য কমিশন পাঁচটি কৌশলগত লক্ষ্য নির্ধারণ করে। লক্ষ্যগুলো হলো : (১) নির্বাচন কমিশনের প্রতি বিদ্যমান দৃঢ় আস্থা ও কমিশনের বর্তমান স্বাধীনতাকে ভিত্তি করে এই অবস্থাকে আরও সুসংহতকরণ; (২) একটি সঠিক ভোটার তালিকা সংরক্ষণ; (৩) অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান; (৪) অর্পিত দায়িত্ব পালনে সংশিল্গষ্ট সকলের পেশাগত সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং (৫) গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সমর্থন। প্রত্যেকটি লক্ষ্যের অধীনে আগামী দুই বছরের জন্য একাধিক উপ-লক্ষ্য এবং প্রত্যেকটি উপ-লক্ষ্য অর্জনের জন্য একাধিক সুস্পষ্ট কার্যক্রম চিহ্নিত করা হয়। একইসঙ্গে চিহ্নিত করা হয় সফলতার সূচক।
উদাহরণ হিসেবে তৃতীয় কৌশলগত লক্ষ্য _ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে তাকানো যাক। এটি অর্জনের লক্ষ্যে আগামী দুই বছরের জন্য ছয়টি উপ-লক্ষ্য চিহ্নিত করা হয়েছে, যেগুলো হলো : (৩.১) নির্বাচন প্রক্রিয়া ও সক্ষমতার উন্নয়ন; (৩.২) নির্বাচন সংক্রান্ত কার্যপ্রণালি, চর্চা ও আইনগত উপাদানসমূহ বিবেচনা করে নির্বাচন-পরবর্তী পর্যালোচনা, মূল্যায়ন ও মানদণ্ড প্রণয়ন প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা; (৩.৩) নির্বাচন পরিচালনা সংক্রান্ত বিদ্যমান সকল কার্যপ্রণালি, বিধিমালা, নির্দেশিকা (ম্যানুয়েল), নীতিমালা ও আদর্শ কার্যসম্পাদন পদ্ধতিসমূহকে বিধিবদ্ধকরণ; (৩.৪) নির্বাচন সংক্রান্ত সকল দায়িত্ব পালনের জন্য কমিশনের নিজস্ব সক্ষমতা ও দক্ষতা সৃষ্টি করা; (৩.৫) সংলাপ ও আইন প্রয়োগ এই উভয় পন্থার সমন্বয়ে, রাজনৈতিক দলসমূহকে আইন ও প্রবিধানসমূহ পরিপালনে উৎসাহ প্রদান; এবং (৩.৬) পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের ব্যাপকতর ব্যবহার পরীক্ষা।
এসব উপ-লক্ষ্য যাতে অর্জিত হয়, সে জন্য আবার সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম নির্ধারণ করা হয়। যেমন, উপ-লক্ষ্য ৩.১ _ নির্বাচন প্রক্রিয়া ও সক্ষমতার উন্নয়নের _ অধীনে দুটি কার্যক্রম চিহ্নিত করা হয়, যেগুলো হলো : (৩.১ক) প্রাক্-নির্বাচনী কাজের সময়সূচি; এবং (৩.১খ) নির্বাচনকালীন সময়ের কাজের সময়সূচি। আবার ৩.১ক-এর আওতাভুক্ত পদক্ষেপগুলো হলো : নির্বাচনী এলাকাসমূহের সীমানা পুনঃনির্ধারণ, ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণ, ভোটকেন্দ্রসমূহ চিহ্নিতকরণ, আদর্শ কার্যসম্পাদন পদ্ধতিসমূহ চূড়ান্তকরণ, নির্বাচন সম্পর্কে ভোটার সচেতনতা সৃষ্টি ও উপকরণ সংগ্রহ।
প্রত্যেকটি কৌশলগত লক্ষ্য, তার আওতাভুক্ত উপ-লক্ষ্য এবং তা অর্জনের জন্য চিহ্নিত কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলো কি-না তা জানার জন্য সুস্পষ্ট সূচকও নির্ধারিত করা হয়েছে। যেমন_ প্রথম কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনটি উপ-লক্ষ্য চিহ্নিত করা হয়েছে, যার প্রথমটি হলো : (১.১) নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতার আইনগত, পদ্ধতিগত ও আচরণ সম্পর্কিত যেসব উপাদান রয়েছে সেগুলোকে সমুন্নত রাখা এবং সুরক্ষিত করা। এই উপ-লক্ষ্য অর্জনের লক্ষ্যে আগামী দু'বছরের জন্য আবার পাঁচটি সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম চিহ্নিত করা হয়েছে, যার প্রথমটি হলো, (১.১ক) নির্বাচন কমিশনারদের বাছাই ও নিয়োগের পদ্ধতি। এ কার্যক্রমটি বাস্তবায়িত হলো কি-না তা বোঝা যাবে যদি নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের পদ্ধতি ও শর্তাবলি (যেমন_ যোগ্যতার মাপকাঠি) সংবলিত একটি আইন পাস করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন এবং আইনটি সংসদে পাসের মাধ্যমে। এ কাজটি সম্পন্ন করার জন্য নির্ধারিত সময় হলো বর্তমান বছর এবং আগামী বছরের প্রথমদিক, কারণ বর্তমান কমিশনের মেয়াদ আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে পূর্ণ হবে।
লক্ষণীয় যে, (১.১ক) উপ-লক্ষ্যের সফলতা সম্পূর্ণভাবে সরকারের ওপর নির্ভর করে না। নির্বাচন কমিশন সর্বজোর আইনের একটি খসড়া তৈরি করতে পারে, যা তারা ইতিমধ্যে করেছে এবং যা নিয়ে তারা সরকার, রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে পারে। তা সত্ত্বেও সরকার এ ধরনের একটি আইন সংসদে পাস করতে আগ্রহী না-ও হতে পারে, যদি গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের প্রচেষ্টায় এ ব্যাপারে জনমত সৃষ্টি না হয়। তাই নির্বাচন কমিশনকে তাদের কৌশলগত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সফল হতে হলে, সংশিল্গষ্ট সকলের পক্ষ থেকে তাদেরকে সহায়তা করতে হবে।
নিঃসন্দেহে নির্বাচন কমিশন প্রণীত এ কর্মপরিকল্পনা অত্যন্ত সুচিন্তিত, সুনির্দিষ্ট ও কাঙ্ক্ষিত এবং কমিশন এজন্য ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। তবে আমরা মনে করি যে, এটি অসম্পূর্ণ এবং এতে আরও কিছু সংযোজন করা আবশ্যক। যেমন, তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক কৌশলগত লক্ষ্য হলো, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান। কিন্তু বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে শুধু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনই আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উত্তরণের (ঃৎধহংরঃরড়হ) সঙ্গে সঙ্গে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুদৃঢ় (পড়হংড়ষরফধঃরড়হ) ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ (রহংঃরঃঁঃরড়হধষরংধঃরড়হ) আবশ্যক। আর এর জন্য প্রয়োজন অর্থবহ নির্বাচন, যার মাধ্যমে সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত ব্যক্তিরা বিভিন্ন স্তরে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পাবেন। আবার অর্থবহ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন হবে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানার ভোটারদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, যাতে তারা প্রার্থীদের সম্পর্কে জেনে-শুনে-বুঝে সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত ব্যক্তিদের পক্ষে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে।
বর্তমানে সবগুলো আইনে প্রার্থীদের তথ্য প্রদানের বাধ্যবাধকতা নেই। যেমন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (সংশোধিত) আইন, ১৯৭২ ও স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯-এ প্রার্থীদের হলফনামার মাধ্যমে তথ্য এবং আয়কর রিটার্নের কপি প্রদানের বিধান রয়েছে। জাতীয় সংসদ (সংরক্ষিত মহিলা আসন) নির্বাচন আইন, ২০০৪ এবং স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন, ২০০৯-এ প্রার্থীদের তথ্য প্রদানের বিধান না থাকলেও, নির্বাচন কমিশন বিশেষ নির্দেশ ও বিধিমালা তৈরি করে এ বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করে, যদিও সংরক্ষিত আসনের ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন দাখিলের বিধান নেই। উপজেলা পরিষদ (সংশোধিত) আইন, ১৯৯৮ এবং স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন, ২০০৯-এ বর্তমানে এ ধরনের কোনো বিধান নেই। নির্বাচন কমিশনের দুই বছরের কর্মপরিকল্পনায় বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হওয়া জরুরি। প্রসঙ্গত, ভারতীয় উচ্চ আদালত প্রার্থীদের সম্পর্কে তথ্যপ্রাপ্তিকে ভোটারদের বাক্স্বাধীনতার অংশ হিসেবে ঘোষণা করেন। কারণ তারা তাদের বাক্স্বাধীনতা প্রয়োগ করে ভোট প্রদানের মাধ্যমে এবং আমাদের আদালতও এ ব্যাপারে একমত প্রকাশ করেছেন।
শুধু প্রার্থীদের তথ্য দিলেই হবে না, প্রদত্ত তথ্য সঠিক হতে হবে। প্রার্থীরা সঠিক তথ্য দেবেন যদি কমিশন তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করে অসত্য তথ্য প্রদান ও তথ্য গোপনের জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এ বিষয়টিও কমিশনের কৌশলগত পরিকল্পনায় সংযুক্ত হওয়া আবশ্যক। তাহলেই অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের নির্বাচনী ময়দান থেকে দূরে রাখা যাবে এবং আমাদের নির্বাচন তথা রাজনীতি কলুষমুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। প্রসঙ্গত শুধু অর্থবহ নির্বাচনের জন্যই নয়, ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের মতে, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্যও প্রার্থীদের তথ্য প্রদান আবশ্যক।
সজ্জনের পক্ষে ভোটারদের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করতে হলে প্রার্থীদের প্রদত্ত তথ্য তাদের কাছে যথাসময়ে পেঁৗছাতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মনোনয়ন প্রত্যাহার এবং ভোটের দিনের মধ্যকার সময় অত্যন্ত সীমিত এবং এ সময়ে তথ্যগুলো কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে নিয়ে যথাযথভাবে সাজিয়ে ভোটারদের কাছে পেঁৗছে দেওয়া অতি দুরূহ। এ সমস্যার সমাধান হতে পারে একমাত্র অনলাইনে মনোনয়নপত্র ও এর সঙ্গে সংযুক্ত তথ্য জমা দেওয়ার মাধ্যমে। এটি বাস্তবায়িত হলে কমিশনকে আর হাজার হাজার পৃষ্ঠা কাগজ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হতে হবে না, বরং ক্ষুদ্রসংখ্যক দক্ষ কম্পিউটার অপারেটর পক্ষেই অতি অল্প খরচে এগুলো যথাযথভাবে সাজিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব হবে। এটি আমাদের ইনফরমেশন হাইওয়েতে প্রবেশে সহায়তা করবে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ সৃষ্টিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সরকারের কাছেও এটি আকর্ষণীয় হবে। তাই আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে হলে, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহারের পাশাপাশি অনলাইন ফাইলিংয়ের বিষয়টিও কমিশনের কৌশলগত কর্মপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
আরেকটি বিষয় কমিশনের কৌশলগত কর্মপরিকল্পনায় যুক্ত হওয়া আবশ্যক। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনেকগুলো সংস্কার ধারণা বিভিন্ন আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যার অনেকগুলোই নবম জাতীয় সংসদ অনুমোদন করেনি। তাই সংস্কার প্রক্রিয়া, বিশেষত রাজনৈতিক দলের সংস্কার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকা আবশ্যক, যে ব্যাপারে আওয়ামী লীগ তার দিনবদলের সনদের মাধ্যমে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং কমিশনও এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করবে বলে আমরা শুনেছি। তবে নতুন সংস্কার প্রস্তাব আইনে অন্তর্ভুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে এগুলোর যথাযথ বাস্তবায়নের দিকে এখন সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (সংশোধিত) আইন, ১৯৭২-এর অনেকগুলো, বিশেষত নিবন্ধন সম্পর্কিত বিধান রাজনৈতিক দলগুলো সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করেছে। যেমন, দলে গণতন্ত্রের চর্চা, অঙ্গ/সহযোগী সংগঠনের বিলুপ্তি, বিদেশি শাখা বিলুপ্তি, আর্থিক স্বচ্ছতা ইত্যাদি। নির্বাচনকে কালো টাকার প্রভাবমুক্ত করা ও মনোনয়ন বাণিজ্য রোধের ক্ষেত্রেও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো পরিপূর্ণভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, যা আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ভবিষ্যতের জন্য এক বিরাট ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতীতে নানা জটিল বাস্তবতার কারণে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি করা সম্ভব না হলেও ভবিষ্যতে কমিশনকে এ ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। তাই এ বিষয়টিও কমিশনের কর্মপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া আবশ্যক।
আমাদের সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদে কমিশনকে ভোটার তালিকা প্রণয়ন, রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচনের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব সরকারের হাতে, যদিও নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব কমিশনের হাতে। তাই স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে অনেক ধরনের অশুভ খেলা হয়। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হয় না। আর নির্বাচন না হলে 'তৃণমূলের গণতন্ত্র' তথা আমজনতার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না। আর এ ধরনের 'খুঁটিহীন' সংসদসর্বস্ব গণতন্ত্র টিকে থাকে না। তাই স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সমুদয় দায়িত্ব কমিশনের ওপর হস্তান্তরে বিধান করা আবশ্যক। এ বিষয়টিও কমিশনের কার্যপরিকল্পনায় যুক্ত হওয়া আবশ্যক।
আমরা নির্বাচন কমিশনকে আরও ক্ষমতায়নের পক্ষে। তবে ক্ষমতায়নের সঙ্গে সঙ্গে কমিশনের দায়বদ্ধতাও নিশ্চিত করতে হবে। অতীতে বিচারপতি আজিজের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের অপকর্মের বিষয়গুলো এখনও অনেকের স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। তারা যে ভোটার তালিকা করার নামে কোটি কোটি টাকা অপচয় করেছে তার দায় তাদের নিতে হবে। তাই কমিশনের দায়বদ্ধতার বিষয়টিও কর্মপরিকল্পনায় আসা উচিত।
কমিশনের একটি গবেষণা বিভাগও থাকা আবশ্যক। এটিও কর্মপরিকল্পনার অংশ হওয়া প্রয়োজন। আরও প্রয়োজন কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ঝুঁকি চিহ্নিতকরণ। তাই এসব বিষয় কর্মপরিকল্পনায় স্থান দেওয়ার ব্যাপারে বিবেচনার জন্য আমরা কমিশনকে অনুরোধ করছি।

ড. বদিউল আলম মজুমদার : সম্পাদক সুজন_ সুশাসনের জন্য নাগরিক
 

No comments

Powered by Blogger.