দরবারের দুই কোটি টাকা লুট-ছয়-সাত মাস আগে থেকে লুটের প্রস্তুতি by একরামুল হক

চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার তালসরা দরগাহ থেকে টাকা লুটের প্রস্তুতি ছয়-সাত মাস আগে থেকে শুরু হয়। দরবারে ‘চার-পাঁচ কোটি টাকা’ আছে, এমন খবর পেয়ে সেখানে অভিযান চালানো হয়। র‌্যাবের সোর্স দিদার-উল ইসলাম চট্টগ্রামের বিচারিক হাকিম আদালতে ১৬৪ ধারায় জানবন্দিতে এই তথ্য দেন।

চট্টগ্রামের বিচারিক হাকিম মাসুদ পারভেজ গত রোববার সকালে তাঁর জবানবন্দি নেন।
দিদার জবানবন্দিতে লে. কর্নেল জুলফিকার আলী মজুমদারকে র‌্যাব-৭-এর অধিনায়ক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তবে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শেখ মাহমুদুল হাসানের পদবি ভুল করে তিনি ক্যাপ্টেন হাসান বলে উল্লেখ করেন।
জবানবন্দিতে দিদার বলেন, তাঁর খালু আনোয়ার তালসরা দরবারের আহমদ ছফার মামাতো ভাই। আনোয়ার ও ছফার মধ্যে বিরোধ ছিল।
দিদার আদালতে বলেন, আনোয়ার তাঁকে জানান, আহমদ ছফার বাড়িতে মিয়ানমারের ২০-২৫ জন নাগরিক থাকে। এ ছাড়া ছফার কাছে দুটি আগ্নেয়াস্ত্র এবং দরবারের বিপুল পরিমাণ টাকা আছে।
এই তথ্য আনোয়ার কীভাবে পেয়েছেন, তা জিজ্ঞাসা করলে আনোয়ার দিদারকে বলেন, ছফার বাড়িতে একজন ‘হুজুর’ থাকেন। তিনিই তাঁকে (আনোয়ারকে) এসব তথ্য দিয়েছেন। দিদার বলেন, ‘আমি এ হুজুরের নাম এখন বলতে পারছি না।’
জবানবন্দিতে দিদার বলেন, ‘আমি খালুকে বলি, আপনি ওই হুজুরকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে আমার সঙ্গে দেখা করেন। আমি এ ঘটনাটি র‌্যাবের এসআই তরুণ বাবুকে জানাই। তখন এসআই তরুণ আমাকে জানান, তোমার ওই দুজন লোক (খালু ও হুজুর) শহরে এলে তাঁদের নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করো। তখন আমি খালুকে ফোন করে হুজুরকে সঙ্গে নিয়ে শহরে আসতে বলি। খালু ওই হুজুরকে নিয়ে শহরে আমার সঙ্গে দেখা করেন। পরে তাঁদের নিয়ে পতেঙ্গা র‌্যাব-৭-এর কার্যালয়ে গিয়ে এসআই তরুণের সঙ্গে দেখা করি। এরপর তরুণ বাবু আমাদের তিনজনকে নিয়ে র‌্যাব-৭-এর তৎকালীন এক কর্মকর্তার কক্ষে নিয়ে যান এবং সেখানে আমরা বৈঠক করি। বৈঠকে ওই কর্মকর্তা হুজুরের সব কথা শুনলেন। পরে ওই কর্মকর্তা আমাদের প্রত্যেককে দুই হাজার টাকা করে দেন। আর বলেন, তোমরা ভালো করে খোঁজ নাও।’
দিদার আরও বলেন, ‘পরে দীর্ঘদিন আমার খালু ও হুজুর আর যোগাযোগ করেননি। তাঁরা সরাসরি র‌্যাবের ওই কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। এভাবে প্রায় ছয়-সাত মাস পার হয়। ইতিমধ্যে র‌্যাবের ওই কর্মকর্তা বদলি হয়ে চলে যান। এর কিছু দিন পর এসআই তরুণ আমাকে জানান, নতুন অধিনায়ক এসেছেন। তুমি প্রস্তুত থেকো। পরে এসআই তরুণের সহায়তায় আমি র‌্যাব কার্যালয়ে যাই এবং নতুন অধিনায়ক লে. কর্নেল জুলফিকার মজুমদারের সঙ্গে কথা বলি। লে. কর্নেল জুলফিকারকে সব খুলে বলি।’
দিদার জবানবন্দিতে বলেন, তিনি লে. কর্নেল জুলফিকারকে জানান, দরবারে অভিযান চালালে সেখানে দু-তিনটি অবৈধ অস্ত্র ও চার-পাঁচ কোটি টাকা পাওয়া যাবে। এ কথা শুনে জুলফিকার তাঁকে বলেন, ‘অভিযান সফল না হলে কী হবে?’ জবাবে দিদার বলেন, ‘আপনি আমাকে যে শাস্তি দেন তা আমি মাথা পেতে নেব।’
দিদার আদালতে বলেন, তিনি জুলফিকারের কাছে জানতে চান, সত্যিই দরবারে বিপুল অঙ্কের টাকা পেলে তিনি (দিদার) কী পাবেন। এতে জুলফিকার দিদারের কী দাবি আছে তা জানতে চান। জবাবে দিদার বলেন, ‘আমরা তিনজন সোর্স আছি (দিদার, অপর সোর্স মানত বড়ুয়া ও আহমদ ছফার ড্রাইভার), আমাদের প্রত্যেককে যা টাকা পাওয়া যাবে তার পাঁচ শতাংশ দিতে হবে। আর সোর্স মানি হিসেবে উদ্ধার হওয়া টাকা সরকারি খাতে জমা দেওয়ার সময় আমার নাম সোর্স হিসেবে লিখতে হবে। সরকারি খাতায় সোর্স হিসেবে আমার নাম অন্তর্ভুক্ত থাকলে আমি নিয়মিত উদ্ধার হওয়া টাকা থেকে দুই শতাংশ পাব।’
জবানবন্দিতে দিদার বলেন, জুলফিকার তাঁদের উদ্ধার হওয়া টাকার দুই শতাংশ দিতে রাজি হন। দিদারও তা নিতে সম্মত হন। ঠিক হয়, ৪ নভেম্বর দুপুর আড়াইটায় অভিযান চালানো হবে।
দিদার বলেন, ‘৪ নভেম্বর বিকেলে নতুন সেতুর (কর্ণফুলী তৃতীয় সেতু) কাছে র‌্যাবের গাড়ি আসে। ওই গাড়িতে আমি উঠি। এসআই তরুণ গাড়িতে আমাকে ক্যাপ্টেন (ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট) হাসানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। পরে র‌্যাবের আরও দুটি গাড়ি তালসরা দরগাহের কাছে পৌঁছায়।’
দরগাহ অভিযান সম্পর্কে দিদার বলেন, ‘আমি এসআই তরুণ বাবু ও ক্যাপ্টেন হাসানকে নিয়ে দরবারের ভেতর ঢুকি। সেখানে আমি আহমদ ছফাকে শনাক্ত করে দিই। দরবারে তিনটি ফটক আছে। আমি দরবার থেকে বের হয়ে র‌্যাব সদস্যদের ফটকগুলো পাহারা দিতে বলি। মিয়ানমারের লোকজনদের আমি শনাক্ত করিয়ে দিই। অভিযানে চার-পাঁচজন মিয়ানমারের লোক পাওয়া যায়। তাঁদের এক পাশে বসিয়ে রাখা হয়।’
দিদার বলেন, তল্লাশি চালানোর একপর্যায়ে ভবনের পাঁচতলার একটি কক্ষের স্টিলের আলমারিতে একটি টাকার থলে পান। নিচতলায় আলমারিতে আরও দুটি থলে পাওয়া যায়।
দিদার বলেন, তল্লাশি চলাকালে ক্যাপ্টেন হাসান কাকে যেন ফোন করে জানান, ‘স্যার, সব ঠিক আছে।’ দিদার বলেন, তাঁর মনে হয়, হাসান তখন অধিনায়ক জুলফিকারের সঙ্গে কথা বলছিলেন।
দিদার বলেন, ‘অভিযানের মধ্যেই লে. কর্নেল জুলফিকার ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। তাঁর উপস্থিতির ১৫-২০ মিনিট পর আনোয়ারা থানার পুলিশ আসে। জুলফিকার সাহেবের সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তার কথা হয়। পরে পুলিশ চলে যায়। জুলফিকার আমাদের বলেন, বাইরে থেকে কিছু স্থানীয় লোকজন নিয়ে আসো। তাঁর কথামতো আমি দোকান থেকে তিন-চারজনকে ডেকে আনি। ওই সময় দরবারের আশপাশে অনেক লোক উপস্থিত হন। এরপর ফকিরসহ তিন-চারজনের কাছ থেকে জুলফিকার সাহেব সই নেন। পরে আমি ও মানত বড়ুয়া দরবারের ঘর থেকে বের হয়ে গেটে দাঁড়িয়ে থাকি। আধা ঘণ্টা পর জুলফিকার সাহেব দরবার থেকে বের হন।’
দিদার বলেন, পরদিন হাসান ফোন করে তাঁকে বন্দর ভবনে যেতে বলেন। তিনি মানত বড়ুয়াকে নিয়ে কাস্টম হাউসের সামনে গেলে হাসান তাঁকে ছয় লাখ ৭২ হাজার টাকা দেন। এর থেকে দুই লাখ টাকা মানতকে দিয়ে দিদার বাকি টাকা রেখে দেন।
এর কিছুদিন পর হাসান তাঁকে ফোন করে জানান, এ ঘটনা নিয়ে অভিযোগ হয়েছে। তিনি দিদারকে আত্মগোপন করার নির্দেশ দেন। এরপর দিদার প্রথমে কক্সবাজার এবং সেখান থেকে বান্দরবান, পটুয়াখালী কুয়াকাটা ও বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে বেড়ান। গত ৫ ফেব্রুয়ারি র‌্যাব তাঁকে গ্রেপ্তার করে।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ৪ নভেম্বর আনোয়ারা তালসরা দরগাহে অভিযানের কথা বলে দুই কোটি টাকা লুটে নেয় র‌্যাবের কর্মকর্তারা। এই ডাকাতির নেতৃত্ব দেন লে. কর্নেল জুলফিকার আলী মজুমদার। এ ঘটনায় ১৩ মার্চ আনোয়ারা থানায় একটি ডাকাতির মামলা হয়।

No comments

Powered by Blogger.