শিশুর চোখে আঘাত, মা-ছেলেকে মারধর, কান ধরে ওঠবস, শিশুর পায়ে শিকল

শিক্ষকের বেত্রাঘাতে আহত শিশু পাথরঘাটা থেকে ঢাকায় এসেছে ক্ষতিগ্রস্ত চোখের চিকিৎসা করাতে। শৈলকুপায় চার ছাত্রী কান ধরে ওঠবস করতে করতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। সাটুরিয়ার দুই শিক্ষককে ডেকে পাঠিয়েছেন হাইকোর্ট। দেবহাটায় নির্যাতনকারী শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন এক ছাত্রের মা।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী নির্যাতনের এসব ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ের।
পাথরঘাটা থেকে ঢাকায়: বরগুনার পাথরঘাটায় মধ্য কুপধন রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীর ছাত্র ইমাম হোসেনের চোখে বেত দিয়ে আঘাত করেছেন ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. আল আমীন। শিশুটিকে গতকাল চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আনা হয়েছে। শিশুরা শ্রেণীকক্ষে হইচই শুরু করলে ওই শিক্ষক বেত দিয়ে এলোপাতাড়ি মারধর করেন। এ সময় ইমাম হোসেনের চোখে বেত ঢুকে রক্ত ঝরে। শিশুটির নানা মকবুল হাওলাদার জানান, চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ঘটনার পর সালিস বৈঠকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা এবং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ঠিক করেছেন, ওই শিক্ষক চিকিৎসার খরচ বহন করবেন। এরই অংশ হিসেবে গত রোববার স্থানীয় চিকিৎসককে ৬০০ টাকা দিয়েছেন ওই শিক্ষক। ঢাকায় আসার আগে দিয়েছেন এক হাজার টাকা। আরও খরচ দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন তিনি।
ন্যাশনাল সার্ভিসের আওতায় ওই বিদ্যালয়ে চাকরি করা শিক্ষক আল আমিন মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এটা দুর্ঘটনা। তবে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার কথা স্বীকার করেন তিনি।
শুধু ছাত্র নয়, মাকেও মারপিট! সাতক্ষীরার দেবহাটায় চাঁদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র ও তার মাকে মারপিট করা হয়েছে। ভুক্তভোগী মা মামলা করলেও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও প্রধান শিক্ষক স্থানীয়ভাবে বিষয়টি মীমাংসার চেষ্টা করছেন। অভিযুক্ত শিক্ষক পলাতক।
চাঁদপুর গ্রামের সোনিয়া খাতুন জানান, তাঁর ছেলে শেখ শ্রাবণ হোসেন (৭) গত বুধবার বিদ্যালয়ে তার সহপাঠী জাকারিয়া হোসেনের সঙ্গে মারামারি করে। ওই সহপাঠী শিক্ষক আবদুল হান্নানের কাছে অভিযোগ করে। বিদ্যালয়ের পাঠাগারে ডেকে নিয়ে শিক্ষক শ্রাবণকে লোহার রড দিয়ে মারপিট করেন। তিনি জানান, পরদিন তিনি ওই শিক্ষকের কাছে এভাবে মারধরের কারণ জানতে চান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে শিক্ষক তাঁর সামনে আবার সন্তানকে মারধর করেন। এ সময় ছেলেকে ঠেকাতে গেলে মাকেও মারধর করা হয়। এরপর মা মামলা করেন।
অভিযুক্ত শিক্ষক আবদুল হান্নান মুঠোফোন বন্ধ রেখেছেন। বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক জানান, দ্বিতীয় দিন মারধর করার সময় শ্রাবণের মা ওই শিক্ষককেও চড় মারেন। এ সময় উভয়ের মধ্যে মারপিটের ঘটনা ঘটে। তবে শ্রাবণের মা শিক্ষককে চড় মারার কথা অস্বীকার করেন।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল কাদের জানান, ঘটনার দিন তিনি ছুটিতে ছিলেন। ওই শিক্ষক ছুটি নিয়েছেন, তাঁর মুঠোফোন বন্ধ। তিনি বিষয়টি মীমাংসা করার চেষ্টা করছেন বলে জানান।
সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুর রশীদকে বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। দেবহাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহাজাহান আলী খান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে জানান, গা ঢাকা দেওয়ায় শিক্ষককে পাওয়া যাচ্ছে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আবদুল হান্নানকে গ্রেপ্তার না করতে কয়েকজন স্থানীয় প্রভাবশালী নেতার সুপারিশ রয়েছে।
কান ধরে ওঠবস করানো: নির্ধারিত পোশাক পরে স্কুলে না যাওয়ায় ঝিনাইদহের শৈলকুপা পাইলট বালিকা বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর চার ছাত্রীকে শতাধিকবার কান ধরে ওঠবস করানোর ঘটনা ঘটেছে। এতে অসুস্থ হওয়া দুই ছাত্রী গতকাল সোমবার স্কুলে যেতে পারেনি। অপর দুই ছাত্রী স্কুলে গেলেও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বলে জানিয়েছেন তাদের অভিভাবকেরা।
ঘটনার বিচার চেয়ে অভিভাবকেরা সোমবার শৈলকুপা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আজমুল হকের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সুলতান আলী বিষয়টি তদন্ত করছেন।
নির্যাতনের শিকার এক ছাত্রী জানায়, নির্ধারিত পোশাক পরে ক্লাসে না যাওয়ায় রোববার গার্হস্থ্য অর্থনীতির শিক্ষিকা শারমিন সুলতানা তাদের ক্লাসে দাঁড় করিয়ে ২০০ বার কান ধরে ওঠবস করতে বলেন। তারা কিছু সময় ওঠবস করার পর অসুস্থ হয়ে পড়ে। ক্লাসের মধ্যে পড়ে গেলে তাদের মাথায় পানি দিয়ে সুস্থ করার চেষ্টা করা হয়। পরে তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপর পারিবারিক উদ্যোগে প্রত্যেক ছাত্রীকে চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হয়।
একজন ছাত্রীর বাবা আবদুর রাজ্জাক জানান, তাঁর মেয়েকে প্রায় ১০০ বার ওঠবস করানোর পর সে অসুস্থ হয়ে মাটিতে পড়ে গিয়ে রক্ষা পায়।
অভিযুক্ত শিক্ষিকা শারমিন সুলতানা জানান, তিনি ছাত্রীদের পোশাক না দেখে কাছে ডেকে রসিকতা করে কয়েকবার কান ধরে ওঠবস করিয়েছেন। তখন ছাত্রীরা অসুস্থ হয়নি, পরে কেন অসুস্থ হলো, তা তিনি বুঝতে পারছেন না।
এ ব্যাপারে প্রধান শিক্ষক সামছুল আলম জানান, ওই শিক্ষিকা ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
কলাপাড়ায় শিশুর পায়ে শিকল: পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় দুরন্ত শৈশবকে শৃঙ্খলিত করতে মাদ্রাসার তত্ত্বাবধায়ক ১০ বছরের শিশুর পায়ে শিকল পরিয়েছেন, ঘাড়ে তুলে দিয়েছেন গাছের গুঁড়ি। কলাপাড়া উপজেলার একাডেমিক সুপারভাইজার মো. মনিরুজ্জামান খানের অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি মাদ্রাসাপ্রধান আনোয়ার জাহিদকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কিন্তু নির্যাতিত শিশুর বাবা বেলাল হোসেন নিজেই দোষ স্বীকার করে কলাপাড়া বিচারিক হাকিমের কাছে বক্তব্য দেন। তিনি জানান, ছেলেকে নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে আনতে এবং আরবি পড়ায় মনোযোগী করতে তিনি শিকল ও গাছের গুঁড়ি জোগাড় করে দেন ওই শিক্ষকের হাতে। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি আদালত শিক্ষককে জামিন দেন। আগামী ২৮ মার্চ মামলার পরবর্তী শুনানি হবে।
এ প্রসঙ্গে আনোয়ার জাহিদ জানান, তিনি ছাত্রের বাবার কথামতো কাজ করে ভুল করেছেন। রাতে ছাত্রটির পা থেকে শিকল খুলে না দিয়েও তিনি অন্যায় করেছেন, এ জন্য তিনি আদালতের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন।
সাটুরিয়ার দুই শিক্ষককে আদালতে তলব: শিক্ষার্থী নির্যাতনের অভিযোগ বিষয়ে ব্যাখ্যা জানাতে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার ধুল্যা বি এম বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষককে তলব করেছেন হাইকোর্ট। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক মো. শাজাহান ও মো. সালাউদ্দিনকে ২২ মার্চ আদালতে হাজির হতে বলা হয়েছে।
গত ১৪ মার্চ জুলহাসসহ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে প্রহার করেন ক্রীড়াশিক্ষক মো. সালাহউদ্দিন। বিদ্যালয়ের নির্ধারিত পোশাক না পরায় এ শাস্তি দেওয়া হয়। এদের মধ্যে শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম হওয়া জুলহাসকে সাটুরিয়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। জুলহাসের বাবা ও দরিদ্র কৃষক দেলোয়ার হোসেন জানান, টাকার অভাবে তিনি সন্তানকে স্কুলের পোশাক কিনে দিতে পারেননি।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন: কল্যাণ ব্যানার্জি (সাতক্ষীরা), আজাদ রহমান (ঝিনাইদহ), নেছার উদ্দিন আহমেদ (কলাপাড়া) ও আমিন সোহেল (পাথরঘাটা)।

No comments

Powered by Blogger.