শিক্ষা-কোচিং-বাণিজ্য অবশ্যই বন্ধ করতে হবে by আসাদ উল্লাহ খান

সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকায় লেখা একটা চিঠির মাধ্যমে জানা গেছে, এই ঢাকা শহরের সন্নিকটে দোহারের আওলিয়াবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নয় মাস ধরে কোনো প্রধান শিক্ষক নেই। আগের প্রধান শিক্ষক তদবির করে অন্যত্র বদলি নেওয়ার পর ওই বিদ্যালয়ে নতুন কোনো প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়নি।


ওই স্কুলে ৫০০ ছাত্রের জন্য চারজন শিক্ষক আছেন, এর মধ্যে তিনজন নারী শিক্ষক; এবং এঁদের দুজন এখন ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটিতে আছেন। ওই স্কুলে লেখাপড়ার অবস্থাটা কেমন হতে পারে, সে বিষয়ে ধারণা পাওয়ার জন্য আর অধিক গবেষণা করার দরকার পড়ে না।
সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলে প্রায় ৬৯ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৭ হাজার ৬৭২। সারা দেশে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় এবার ২১ লাখ ৮৫ হাজার ৭৪৭ জন অংশ নিয়েছে, এদের মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে ২১ লাখ ২৫ হাজার ৮৬৯ জন। অর্থাৎ পাসের হার ৯৭ দশমিক ২৬ শতাংশ, যা গতবার ছিল ৯২ দশমিক ৩৪ শতাংশ। পাসের হার বিবেচনা করলে খুশি হওয়ার মতো ব্যাপার বটে। কিন্তু শিক্ষার গুণগত মানে কতটা পরিবর্তন এসেছে, তা কিন্তু কেউ খতিয়ে দেখছেন না। এই গুণগত মানের বিষয়টি কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে ধরা পড়ে না, বিশেষত অভিভাবকেরা তো ধরতেই পারবেন না।
প্রাথমিক স্তরে লেখাপড়ায় আগ্রহ সৃষ্টি করতে না পারলে, এই স্তরে মেধা খুঁজে বের করতে না পারলে, পরবর্তী স্তরে অভিভাবক তাঁর সন্তানের জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করে অত্যন্ত প্রাজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগ করে ঈপ্সিত ফল লাভ করতে ব্যর্থ হন। তিনটি বিষয়, যথা—বাংলা, ইংরেজি ও গণিতে আগ্রহ এই প্রাথমিক স্তরে সৃষ্টি হওয়া খুবই প্রয়োজন। বাংলা মায়ের ভাষা বলে ভালোভাবে শেখানো হয় না, ইংরেজি বিদেশি ভাষা বলে পদ্ধতিগতভাবে শেখানো হয় না। সবচেয়ে বড় কথা, ইংরেজি ও গণিতে ভালো শিক্ষক আজকাল আর নেই। চোখ-ধাঁধানো ডিগ্রি অর্জনের সার্টিফিকেট নয়, লেখাপড়ায় যাঁরা ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছেন এমন ব্যক্তিরা এখন স্কুল-কলেজে শিক্ষকতার পেশায় আসছেন না। নিয়োগ-প্রক্রিয়ায়ও ত্রুটি আছে। স্বজনপ্রীতির সঙ্গে সঙ্গে অর্থের বিনিময়ে আজকাল স্কুল-কলেজে শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে। বিরাট অঙ্কের টাকার বিনিময়ে অযোগ্য ও অদক্ষ ব্যক্তিকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষকের যদি বিষয়ের ওপর পারদর্শিতা না থাকে, তাহলে শিক্ষার্থীর ভিত্তি কীভাবে মজবুত হবে?
শিক্ষা মন্ত্রণালয় টাকা বরাদ্দ করছে, শিক্ষকেরা বেতনও পাচ্ছেন, স্কুলগৃহ আছে; কিন্তু সেখানে পঠন-পাঠন কীভাবে চলছে, সে বিষয়টি দেখার কেউ নেই। আমরা স্কুলে পড়ার সময় দেখেছি, রেঞ্জ ইন্সপেক্টর বছরে একবার মহকুমা শহরের মাধ্যমিক স্কুল পরিদর্শন করতেন। ইন্সপেক্টর আসবেন—এ খবরটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে সব শিক্ষক তটস্থ থাকতেন। ইন্সপেক্টর কোনো শ্রেণীকক্ষে ঢুকে পড়া ধরবেন এবং ধরতেনও, তাই ছাত্রদের সেভাবে প্রস্তুত রাখা হতো। এখন এসব চল একেবারেই উঠে গেছে। গ্রামাঞ্চলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার মানে কতটা ধস নেমেছে, তা অনেকের কাছেই অজানা। পরীক্ষায় শতভাগ পাসের হার নিয়ে উৎফুল্ল বোধ করলেও গ্রামাঞ্চলে শিক্ষার অধোগতি দেখে কিছুটা আতঙ্কিত হতে হয়। এবারের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় দেশসেরা ২০টি বিদ্যালয়ের ১৭টিই রাজধানীর। পাসের ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে গ্রামের কোনো বিদ্যালয় নেই। আরও একটি উদ্বেগজনক ব্যাপার হলো, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে দেশের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য পরিচালিত ‘আনন্দ’ স্কুলের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় ফলাফল খুবই হতাশাব্যঞ্জক। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় সারা দেশের ৩৭১টি শূন্য পাস বিদ্যালয়ের মধ্যে ১৭৯টিই আনন্দ স্কুল।
২১ জানুয়ারি প্রথম আলো পত্রিকায় তৃতীয় পাতায় ফুটপাতের ওপর বসবাসকারী অল্পশিক্ষিত মা রিনা বেগমের ওই ফুটপাতের ওপর মেয়েকে পড়ানোর ছবি দৃষ্টি কেড়ে নেয়। রিনা বেগম তাঁর মেয়ে ফালানীকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। কিন্তু পড়াশোনা না পারায় স্কুল থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাকে আর স্কুলে রাখা হবে না। এরূপ একটি সুবিধাবঞ্চিত এবং বিত্তহীন পরিবারের সন্তানকে লেখাপড়ায় টেনে আনার মধ্যেই তো শিক্ষকদের কর্মের সার্থকতা নিরূপিত হবে। যে বাচ্চার ঘর নেই, দুবেলা খাওয়ার সংস্থান নেই, বাড়িতে পড়ালেখা দেখে দেওয়ার মতো শিক্ষিত অভিভাবক নেই—তাকে সামনে টেনে নিয়ে আসাই তো আজ রাষ্ট্র এবং সমাজের কাছে বিরাট চ্যালেঞ্জ, সবচেয়ে বড় দায়।
শহরে আজকের দিনে যে মেধার বিস্ফোরণ ঘটছে, এর কারণ খুঁজে বের করা খুব কঠিন নয়। শহরাঞ্চলে শিক্ষায় আলোকপ্রাপ্ত বিত্তশালীরা বাস করেন। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ আছে এবং আগ্রহ আছে বললে যথেষ্ট হবে না, আর্থিক সংগতিও আছে। তাঁদের এই আর্থিক সংগতির ব্যাপারটা শহরাঞ্চলের স্কুলের বুদ্ধিদীপ্ত শিক্ষকেরা আঁচ করতে পেরেছেন। এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে শহরের স্কুলগুলোতে শ্রেণীকক্ষে পাঠদান কর্মসূচি একেবারে শিথিল হয়ে গেছে। এঁদেরই দ্বারা পরিচালিত কোচিং সেন্টারভিত্তিক রমরমা শিক্ষা-বাণিজ্য গড়ে উঠেছে।
আজকের দিনে মেধার সন্ধান শিক্ষকও করেন না এবং মেধার লালন না করার কারণে মেধার উন্মেষও ঘটছে না। অভিভাবক ও শিক্ষার্থী আজ উচ্চ নম্বর, অর্থাৎ উচ্চ গ্রেডের সন্ধানে বেরিয়েছেন। বাড়ি থেকে বেরিয়ে দৃষ্টি বাড়ালেই দেখা যাবে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে বাহারি নামের কোচিং সেন্টার বাণিজ্যের পসরা সাজিয়ে বসে আছে। যে শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে পড়াতে উৎসাহ বোধ করেন না, এখানে কিন্তু তিনি প্রচুর আগ্রহ নিয়ে পাঠদান করছেন, নোট দিচ্ছেন। সম্ভাব্য প্রশ্নের পাণ্ডিত্যপূর্ণ উত্তর শিক্ষক তৈরি করে ছাত্রের হাতে তুলে দিচ্ছেন। নোটের ফটোকপি এক ছাত্র থেকে আরেক ছাত্রের হাতে ঘুরছে। আজকের দিনে প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকের ক্লেশ অনেক কমে গেছে, একই সঙ্গে কোচিং-বাণিজ্যের সুবাদে শিক্ষকের আর্থিক অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। অনেক শিক্ষক এই ঢাকা শহরের নামকরা স্কুলে কয়েক বছর চাকরি করে এই শহরেই জমি, বাড়ি/ফ্ল্যাট কিনে ফেলেছেন। কিন্তু যে চাকরির সুবাদে তাঁর এই আর্থিক প্রবৃদ্ধি ঘটেছে কিংবা সচ্ছলতা এসেছে, সেই বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষে পড়ানোর ব্যাপারে তাঁর কোনো আগ্রহ নেই। কোচিং সেন্টারে কিংবা রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগপর্যন্ত ঘণ্টাভিত্তিক একটার পর একটা ব্যাচে ছাত্র পড়াচ্ছেন এবং পরীক্ষায় সেট হতে পারে, এমন সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তর জ্ঞানের মোড়ক বা ‘ক্যাপসুল’ আকারে বিতরণ করছেন। শিক্ষার্থী এই জ্ঞানের মোড়ক খুলে গোগ্রাসে গিলে ফেলছে এবং পরীক্ষার খাতায় উগরে দিচ্ছে। কোচিং সেন্টার থেকে পাওয়া নোট বা জ্ঞানের মোড়ক পরীক্ষার খাতায় লিখে চমক লাগানো ফল করছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বর্তমানে স্কুলের বইতে জ্ঞানভিত্তিক বিষয় যা আছে, তার সন্ধান শিক্ষার্থী পাচ্ছে না। অন্যদিকে পঠন-পাঠন পদ্ধতিতে একটি ছাত্রের মেধা, স্বকীয়তা কিংবা সৃজনশীলতা জাগিয়ে তোলার মতো কোনো ব্যবস্থা বা প্রচেষ্টা নেই। অনেক শিক্ষার্থী মূল বইটা খুলেও দেখেনি। তাক লাগানো নম্বর বা উচ্চ গ্রেড পাওয়ার প্রতিযোগিতায় শহর অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীরা এগিয়ে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আজ যদি দেশে পৃথকভাবে মেধাভিত্তিক পরীক্ষা নেওয়া হয়, যেখানে কোচিংয়ের মাধ্যমে প্রস্তুতি নিয়ে বসার অবকাশ থাকবে না, তাহলেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অসারতা ধরা পড়বে।
কোচিং বন্ধ করতে সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের করা কমিটি মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে যে সুপারিশ পেশ করেছে, তা বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে খুবই সুচিন্তিত। শিক্ষকের নিজের প্রতিষ্ঠান বাদে অন্য প্রতিষ্ঠনের একটি ব্যাচে ১০ জন শিক্ষার্থী পড়াতে পারবেন—এটা ঠিক আছে, কিন্তু একের অধিক ব্যাচ নিতে পারবেন কি পারবেন না, তা সুপারিশ থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। দেশের বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বাজার-পরিস্থিতি, শহরে বাসাভাড়া, পরিবারের চিকিৎসা-সংকট ইত্যাদি বিবেচনায় নিলে তাঁদের প্রাপ্যতার বিষয়টিও দেখতে হবে। তবে এই প্রাপ্যতার দাবি অবশ্যই তাঁদের অনৈতিক পথে ঠেলে দেবে না, অর্থের মোহে আবদ্ধ করবে না। শিক্ষা একটি মহান পেশা, এটা কোনোভাবেই ব্যবসা নয়—এ কথাটা সব সময়ে খেয়াল রাখতে হবে। অন্যদিকে এটা সবাই আশা করে, অনগ্রসর শিক্ষার্থীদের টেনে তুলতে তাঁরা যে শ্রম ও মেধা ব্যয় করবেন, সমাজ ও রাষ্ট্র অবশ্যই তাঁদের সেই শ্রমের মূল্য ও স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে কোনোরূপ অনীহা দেখাবে না।
১৯৮০ সালের শেষার্ধে দক্ষিণ কোরিয়ার একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, সে দেশে প্রতিবছর সন্তানদের কোচিং বাবদে ২৫ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার ব্যয় হচ্ছিল। অর্থনৈতিক কাঠামো মজবুত থাকা সত্ত্বেও দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল সরকার সে দেশে শিক্ষার সব পর্যায়ে কোচিং-বাণিজ্য আইন করে বন্ধ করে দিয়েছে। কোনো শিক্ষার্থী কোচিং গ্রহণ করছে, এটা ধরা পড়লে ওই শিক্ষার্থী স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হবে এবং যে শিক্ষক এই কোচিং দেবেন, তিনি চাকরি থেকে ছাঁটাই হবেন। ওই দেশের সরকার অনুধাবন করেছে যে এই কোচিং-বাণিজ্য ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করার ফলে দেশে সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছিল, যার ফলে দেশে একটি কুলীন সম্প্রদায় গড়ে উঠছিল। কোচিং নিতে অক্ষমেরা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন পর্যায়ে অচ্ছুত বলে গণ্য হচ্ছিল। দক্ষিণ কোরিয়া সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র না হলেও এ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা দেশের সার্বিক প্রগতি, উন্নয়ন এবং রাষ্ট্রীয় সংহতি গড়ে তোলার পথে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছিল—এ বাস্তবতা ওই দেশের বিচক্ষণ সরকার অস্বীকার করতে পারেনি বলেই এ সময়োপযোগী ব্যবস্থাটা নিয়েছে।
 আসাদ উল্লাহ খান: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক।
aukhandk¦gmail.com

No comments

Powered by Blogger.