সময়চিত্র-ষড়যন্ত্র রুখতে হবে by আসিফ নজরুল

সেনা সদর দপ্তর ১৯ জানুয়ারি একটি নজিরবিহীন সংবাদ সম্মেলন করে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের কথা দেশবাসীকে অবহিত করেছে। এই ষড়যন্ত্রের টার্গেট ছিল জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত একটি সরকার, আরও নির্দিষ্টভাবে বললে দেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। আমরা সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সুষ্ঠু বিচার সাপেক্ষে উপযুক্ত শাস্তি দাবি করছি। এই দাবিতে শামিল হওয়া প্রতিটি গণতন্ত্রমনা মানুষের কর্তব্য বলে আমরা মনে করি।


একটি নির্বাচিত সরকারকে জনগণ দেশ পরিচালনার ম্যান্ডেট প্রদান করে পাঁচ বছরের জন্য। এই সময়ে বিভিন্ন কারণে নির্বাচিত সরকার জনগণের আস্থা এবং জনসমর্থন হারাতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে এমন সরকারের পতন ঘটানোর একমাত্র বৈধ পন্থা হচ্ছে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা। ১৯৯০ পরবর্তী তিনটি সরকারের পতন ঘটানো হয়েছিল এভাবেই। এ ছাড়া ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে বিদায় নিতে বাধ্য করাও গণতন্ত্রে একটি কমবেশি স্বীকৃত পদ্ধতি। সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে তাই ঘটেছে, ১৯৯৬ সালে একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত বিএনপি সরকারও বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছিল অনেকটা একইভাবে। এর বাইরে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা শুধু সংবিধান ও গণতন্ত্রবিরোধী নয়, এটি একটি দেশের স্থিতিশীলতার জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর বাংলাদেশে বহু সামরিক অফিসার ও জওয়ান হত্যা, অসাম্প্রদায়িকতা প্রসার এবং রাজনীতিতে অরাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের দাপটের যে ঘটনাগুলো ঘটে তার ধকল আজও বাংলাদেশ পুরোপুরি সামলে উঠতে পারেনি। এরশাদের সময় থেকে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের যে প্রবণতা বাংলাদেশে জেঁকে বসে তার বিস্তারও আজও রোধ করা যায়নি। এসব অভিজ্ঞতা আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে গণতন্ত্রের বিকল্প তাই কোনো সামরিক অভ্যুত্থান হতে পারে না।
গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং দেশপ্রেম থাকলে হাসিনা সরকারের সবচেয়ে কঠিন সমালোচককেও তাই ১৯ জানুয়ারিতে বর্ণিত অভ্যুত্থান পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। সরকারকে এই পরিকল্পনার সঙ্গে প্রকৃতভাবে জড়িত প্রতিটি মানুষ ও মহলকে বিচারের সম্মুখীন করতে হবে এবং এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে গভীর প্রজ্ঞার সঙ্গে কাজ করতে হবে।

২.
আমাদের জন্য স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, সেনাসদর দপ্তরের বর্ণিত চক্রান্তটি অঙ্কুরে দমন করা গেছে। এই চক্রান্তে জড়িত ১৪ থেকে ১৬ জনের মধ্যে অধিকাংশ অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য, চাকরিরত সেনাসদস্যের সংখ্যা এখানে নগণ্য ছিল বলা হয়েছে। এই চক্রান্তের কথা জানামাত্র অন্য সেনাসদস্যরা তা ঊর্ধ্বতন সেনা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। এটি প্রমাণ করে নানা উসকানি সত্ত্বেও সেনাবাহিনী তার দায়িত্বশীল ও দেশপ্রেমিক ভূমিকায় অবিচল রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সেনাবাহিনীর অতীত ভূমিকা আমাদের নির্মোহভাবে বিবেচনা করতে হবে। অতীতের বিভিন্ন অভ্যুত্থানের জন্য সেনাবাহিনীর একটি অংশকে দায়ী করা হলেও তারা এককভাবে কোনো অভ্যুত্থান সংঘটিত করেছে কি না এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এসব অভ্যুত্থানে বরং কোনো না কোনো রাজনৈতিক মহলের মদদ বা সমর্থন ছিল বলে আমরা জানি। সর্বশেষ ১/১১ পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ঘটে মূলত রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার কারণে। ১/১১-পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন মহল ক্ষমতা দখলের উসকানি প্রদান করলেও তারা তা করেনি। বরং গোটা জাতির জন্য বিশুদ্ধ ভোটার আইডি কার্ড তৈরি করে তারা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সুসম্পন্ন করে যায়। ২০০৯ সালে পিলখানায় বহু সেনা অফিসারের নারকীয়ভাবে হত্যা করা হলেও তারা দৃষ্টান্তমূলক সংযম ও দায়িত্ববোধের পরিচয় দেয়। এসব ঘটনা প্রমাণ করে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী পাকিস্তান বা পশ্চিম আফ্রিকার কিছু দেশের সেনাবাহিনীর মতো প্রকৃতভাবে ক্ষমতালিপ্সু নয়। দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার বিষয়ে তারা তাদের দায়িত্বশীলতার বহু প্রমাণ দিয়েছে অন্তত গত ২০ বছরে।
প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনী সুশৃঙ্খল থাকলেও এখানেও কিছু বিপথগামী সদস্য থাকতে পারে। উন্নত বিশ্বে সবচেয়ে সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীতেও অবসর নিয়ে সাধারণ জনগণের ওপর উন্মত্ত হামলা কিংবা নিজ দেশের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির ঘটনা হঠাৎ হঠাৎ ঘটে। তবে সেখানে সরকারের প্রধান প্রচেষ্টাগুলো জনকল্যাণমূলক হয়, বিরোধী দল দায়িত্বশীল ছায়া সরকারের ভূমিকা পালন করে, রাজনৈতিক দল, সমাজ ও সংগঠনে গণতন্ত্রের চর্চা হয়, জনগণের মৌলিক প্রয়োজন মেটানো হয় এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের নিশ্চয়তা থাকে। ফলে হঠকারী পদক্ষেপের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের কোনো সুযোগ বা পরিবেশ সেখানে বিরাজ করে না। এমন সুযোগ বা পরিবেশ চিরতরে বিনাশ করার মতো একটি সমাজ আমাদের নির্মাণ করতে হবে। একটি নির্বাচিত সরকারের কোনো ব্যর্থতাকে পুঁজি করে বা সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে তাকে উৎখাত করার চক্রান্ত কেউ করতে পারবে না এমন একটি রাষ্ট্র আমাদের গড়ে তুলতে হবে।

৩.
হঠকারিতার উন্মেষ হবে না এমন সমাজ নির্মাণ করতে হয় গণতন্ত্রের চর্চার মাধ্যমে। সেই চর্চায় ভুল থাকতে পারে, কিন্তু সে ভুলও শোধরাতে হবে গণতান্ত্রিক পথে। অনেকেই মনে করেন যে বর্তমান সরকারের কিছু ভুলত্রুটি রয়েছে। বিশেষ করে অর্থনীতি ও বিদেশনীতিতে ব্যর্থতার কারণে এই সরকারের আমলে নিম্নবিত্ত মানুষের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যর উর্ধ্বগতি, শেয়ারবাজার ধস, দেশে ও বিদেশে কর্মসংস্থান এবং বিনিয়োগ পরিস্থিতির অবনতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাও কঠিন হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিজ দেশের স্বার্থ আদায়ে ব্যর্থতার ব্যাপক অভিযোগ সরকারের বিরুদ্ধে রয়েছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে বিভিন্ন ধরনের ব্যর্থতা আগের গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর সময়ও ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হওয়ার কারণে প্রতিটি ব্যর্থ সরকারকে পরিবর্তন করে জনগণ তার জবাব দিয়েছে। সরকার ব্যর্থ হলে তাকে বিদায় জানাতে হবে নির্বাচনের মাধ্যমে, এই চর্চা আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে সংশয় থাকলে সংসদ ও সংসদের বাইরে গিয়ে এর প্রতিকার কী তা বলতে হবে, সরকার না মানলে জনগণকে সংগঠিত করতে হবে এবং গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে তা মানতে বাধ্য করতে হবে। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত করেছিল এই পথেই, বিরোধী দলকে বর্তমানে তাই করতে হবে। তখনো বিরোধী দলের আন্দোলনের সুযোগে কায়েমি বা গোষ্ঠীস্বার্থে কোনো অবৈধ পন্থায় ক্ষমতা দখলের ঘটনা ঘটেনি, এখনো তা ঘটানোর চিন্তা থেকে সবাইকে বিরত থাকতে হবে। এখানে কোনো হঠকারিতার সুযোগ নেই তা সমাজের সব মহলের কাছে স্পষ্ট করতে হবে।

৪.
বর্তমান সরকার কিছু ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করার কারণে এমনিতেই প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর রোষানলের মধ্যে রয়েছে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যে গুরুদায়িত্ব অতীতের সরকারগুলো পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে, বর্তমান সরকার তা সম্পন্ন করার লক্ষে বিভিন্ন প্রশংসনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সাম্প্রদায়িক ও ধর্মকে অপব্যবহারকারী উগ্রবাদী গোষ্ঠীদের দমনেও সরকার বহু ইতিবাচক ব্যবস্থা নিয়েছে। সরকারকে উৎখাতের অপচেষ্টার পেছনে এসব কারণ থাকলে আমাদের আরও সুদৃঢ় ও ঐক্যবদ্ধভাবে তা রুখে দিতে হবে, এর বিরুদ্ধে ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে সচেতন করার দায়িত্ব পালন করতে হবে।
সরকারের কাছে আমাদের আবেদন থাকবে, সরকার উৎখাতের যড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত মহলকে বিচারের মুখোমুখী করার দায়িত্ব যেন সুষ্ঠুভাবে পালন করা হয়। এ সুযোগে রাজনৈতিক অপপ্রচার, গণমাধ্যমবিরোধী কোনো পদক্ষেপ বা ঢালাওভাবে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের চিন্তা কারও থাকলে তা অবদমন করতে হবে। এ ধরনের চিন্তার বাস্তবায়ন সরকারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অহেতুক সন্দেহ ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে এবং প্রকৃত দোষী ব্যক্তিরা এবং তাদের সমর্থনকারীরা এর সুফল গ্রহণে নানাভাবে মরিয়া হয়ে ওঠে। নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের যড়যন্ত্র হলে বরং এর বিরুদ্ধে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলার চেষ্টা করা উচিত।
সরকারের কাছে আমাদের আরেকটি আবেদন, কোনো কারণে সেনাবাহিনী বা সমাজের অন্য কোনো অংশের মধ্যে যৌক্তিক অসন্তোষ থাকলে তা সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ঘোলাটে পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তার সুযোগ গ্রহণ করার মতো মহল পৃথিবীর বহু দুর্বল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রয়েছে। সবচেয়ে প্রজ্ঞাচিত কাজ হচ্ছে এমন পরিস্থিতিই সৃষ্টি না হতে দেওয়া।
আমরা বিরোধী দলের কাছে আশা করব, তারা সরকার উৎখাতের যড়যন্ত্রের নিন্দা জানাবে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে সরকারকে সহায়তা করবে। সেনাবাহিনী বা তার সদস্যরা যাতে কোনো ধরনের অপপ্রচারের শিকার না হয়, তাদের শক্তি, ঐক্য, আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদাবোধ কোনোভাবে যেন ক্ষুণ্ন না হয় সেজন্য সরকার ও বিরোধী দলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে শক্তিশালী ও আত্মপ্রত্যয়ী সেনাবাহিনী যে দেশের সার্বভৌমত্ব, আত্মমর্যাদা ও সামর্থ্য রক্ষায় কতটা জরুরি তা সবাইকে উপলদ্ধি করতে হবে।
আমরা এও আশা করব যে সেনাবাহিনী তাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা অব্যাহত রাখবে ভবিষ্যতে। ২০ জানুয়ারি প্রথম আলোর ওয়েব পাতায় বেশ কিছু পাঠক তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই বা অধিকাংশ সন্দেহভাজনেরা গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই চক্রান্তের খবরটি ফলাও করে জানানো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কেউ কেউ এমন তথ্য প্রকাশ নতুন কোনো অস্থিরতা তৈরি করবে কি না এ আশঙ্কাও ব্যক্ত করেছেন। আমরা মনে করি, ভবিষ্যতে তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে সময়োপযোগিতা ও তুলনামূলক লাভ-ক্ষতি আরও গভীরভাবে বিবেচনা করে দেখার অবকাশ থাকলে সেনাবাহিনীর তাই করা উচিত।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.