সদরে অন্দরে-জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং মানুষের ভোগান্তি by মোস্তফা হোসেইন

খিলগাঁও তালতলা থেকে যেতে হবে মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকে। কয়েক দিন আগেও যেখানে বাস কাউন্টার ছিল, সেই জায়গাটা দেখা গেল খালি। গাড়ি আসতেই বলা হলো, গাড়িতে ভাড়া দিতে হবে, উঠে পড়ুন। ভাড়া কত? ১২ টাকা। বাড়তি দিতে হবে দুই টাকা।


কেন? জবাব আসে মুখের ওপর : গতকাল থেকে গ্যাসের দাম বেড়েছে। যাত্রীদের কাছ থেকে প্রতিবাদ হলো। যে যেভাবে পারে মন্তব্য করতে থাকে। কন্ডাক্টর নির্বিকার। অনেকক্ষণ কথা-কাটাকাটি করল সেও। কাছে আসতেই জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা ভাই, মতিঝিল পর্যন্ত কত কিলোমিটার রাস্তা? এ প্রশ্ন শোনার পর কন্ডাক্টর তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে। যেন অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করা হলো তাকে। জবাব এল, 'কত মাইল না কিলোমিটার ওইডা আপনে বাইর কইরেন। এইডা আমার দরকার নাই। আমার ভাড়াডা দিয়া দেন।' সহযাত্রীর প্রশ্ন, 'কত কিলোমিটার, সেটা তুমি জানবে না কেন? আর না জানলে ভাড়া নেবে কিভাবে? ভাড়ার তালিকা দেখাও। সেখানে দেখবে, তোমার ভাড়া উল্লেখ করা আছে কিলোমিটার হিসাবে। আর গতদিন যে ভাড়া বেড়েছে, তাও কিলোমিটার হিসাবেই। প্রতি কিলোমিটারে বেড়েছে পাঁচ পয়সা।' কন্ডাক্টরের পাল্টা যুক্তি, 'আগে আছিল ১২ টাকা ভাড়া, এহন দিবেন ১৪ টাকা। খুব বেশি চাইছি নাকি?' সে কি বেশি চেয়েছে? তালতলা থেকে মতিঝিলের দূরত্ব বড়জোর তিন কিলোমিটার। প্রতি কিলোমিটার এক টাকা ৫৫ পয়সা, আর নূ্যনতম ভাড়া সাত টাকা হারে তালতলা থেকে সেখানকার ভাড়া হতে পারে সাত টাকা। কিন্তু ওই রুটের নিয়মিত যাত্রীরা কি বলতে পারবেন কখনো এই দূরত্বের জন্য সাত টাকা আদায় হয়েছে বাসগুলো থেকে? গত মে মাসে যখন সরকার জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়িয়েছিল, তখন বাসের ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করা হয়। সেই অনুযায়ী, এই দূরত্বের ভাড়া সাত টাকা হওয়ার কথা থাকলেও তখন থেকেই বাসগুলো আদায় করে আসছে ১২ টাকা। তবে টিকিট দেওয়া হতো তালতলা থেকে প্রেসক্লাব পর্যন্ত। মতিঝিল কিংবা কমলাপুর_কোনো জায়গারই টিকিট পাওয়া যায় না। মিডওয়েতে টিকিট দেওয়া হয়। বাহন পরিবহনে টিকিটও দেওয়া হয় না। বাসগুলো ইচ্ছামাফিক ভাড়া আদায় করে নেয় যাত্রীদের কাছ থেকে।
এ অবস্থা যে শুধু এই রুটে, তা নয়। যেকোনো রুটেই যথেচ্ছ ভাড়া আদায় করা হচ্ছে যাত্রীদের কাছ থেকে। মানুষ প্রতিবাদ করতে গেলে তাদের নাজেহাল হতে হয় বাস কন্ডাক্টর কিংবা হেলপারদের হাতে। একসময় এমনও হয়েছে যে বাস মালিকদের পোষা মাস্তানদের হাতে শারীরিকভাবেও নির্যাতিত হতে হয়েছে কোনো কোনো যাত্রীকে। সরকার সেসব দেখার পরও যাত্রীদের নির্যাতন বন্ধ করার কোনো পদক্ষেপ নেয় না; বরং বাস মালিক ও ব্যবসায়ীদের পক্ষই অবলম্বন করে। যদি দু-একবার হৈচৈ হয়, তাহলে তারা লোক দেখানোর জন্য দু-এক দিন ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে কিছু জরিমানা আদায় করে চুপ করে যায়। ফলে যাত্রীদের দুর্ভোগ কমে না। বাড়ে বাস মালিকদের নির্যাতন। যাত্রীদের সামনে কোনো পথ খোলা থাকে না। তারা চোখ বুজে নির্যাতনকে স্বাভাবিক পাওনা হিসেবে মেনে নেয়। এ পরিস্থিতিতে সরকার যেন মনে করে, মানুষ সয়ে নিয়েছে, তাই আর কিছু হবে না। কিন্তু এই সয়ে যাওয়াটা যে স্বাভাবিক নয়, তা মনে হয় সরকার বুঝতে চায় না। এই মুহূর্তে যে অচলাবস্থা চলছে, তা দেখে সংগত কারণেই মনে করা যায়, দেশের যোগাযোগ ও পরিবহনব্যবস্থার ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যদি নিয়ন্ত্রণ থাকত, তাহলে নূ্যনতম বাসভাড়া সাত টাকার জায়গায় ১২ টাকা কিংবা কোনো কোনো বাস ১৫ টাকা পর্যন্ত আদায় করতে পারত না। কেউ কি হিসাব করেছে, একটি বাস যদি প্রত্যেক যাত্রীর কাছ থেকে এভাবে দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করে, তাহলে প্রতিদিন কত কোটি টাকা যাত্রীদের কাছ থেকে সারা দেশের বাস মালিকরা হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছে?
বাস মালিকরা এই বাড়তি ভাড়া আদায়ের জন্য আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা দেয়নি। এমনকি তারা ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়টি অস্বীকারও করে আসছে প্রকাশ্যে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা ভিন্নতর। গত মে মাসের ঘোষণা অনুযায়ী, বড় বাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে এক টাকা ৫৫ পয়সা এবং বর্ধিত ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি পাঁচ পয়সা_মোট এই এক টাকা ৬০ পয়সা ভাড়া হওয়া উচিত এই মুহূর্তে। সেই জায়গায় আদায় করা হচ্ছে ১২ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত। এবং প্রতি কিলোমিটার কমপক্ষে দুই থেকে তিন টাকা পর্যন্ত। এদিকে সরকার যে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে, তা প্রত্যাহার করার জন্য দাবি জানিয়েছে বাস মালিকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব বাস কোম্পানিজ (এবিসি)। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, সংগঠনের নেতারা যোগাযোগমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বলেছেন, তাঁরা নাকি বাড়তি ভাড়া আদায় করতে পারছেন না। এতে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে তাঁদের লোকসানের মুখে পড়তে হয়েছে। এবিসির নেতারা যে জেনেশুনে মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করেছেন, তা বোধ করি মন্ত্রীর বুঝতে অসুবিধা হবে না। মন্ত্রীর নিশ্চয়ই তাঁর সরকারের ব্যর্থতাগুলো সম্পর্কেও না জানার কথা নয়। তিনি খুব ভালো করেই জানেন, সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অনেক বেশি বাস মালিকরা অনেক আগে থেকেই আদায় করছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর জন্য সরকারের যে পদ্ধতি অবলম্বন করার প্রয়োজন ছিল, সরকার সেই পদ্ধতি অবলম্বন করেনি। প্রশ্ন হচ্ছে, যথাযথ নিয়ম মেনেও যদি সরকার অগ্রসর হতো, তাহলেও কি তেলের দাম না বাড়ানোর কোনো পথ খোলা ছিল সরকারের সামনে? আজকে জ্বালানি তেলের জন্য সরকারকে যে অঙ্কের টাকা নিত্য ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, তা তো সরকারের পক্ষে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এটা বিরোধী দলও জানে। আর এখানেও হয়তো দোষারোপ করা যেত, সরকার কেন ভর্তুকি দিতে গিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা নিত্য ঋণ করে আসছে। আর সেই ঋণের বোঝা টানতে হবে সাধারণ মানুষকে। এক হিসাবে দেখা গেছে, সরকার যদি জ্বালানি তেলের দাম না বাড়াত, তাহলে আগামী বছর থেকে বার্ষিক ১৩ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ভর্তুকি দিতে হতো। এ পরিস্থিতি কি সামাল দেওয়া সম্ভব হতো সরকারের পক্ষে। প্রশ্ন হচ্ছে, গুটিকয়েক মানুষের জন্য বিশাল অঙ্কের টাকা ভর্তুকি দেওয়া কি যুক্তিসংগত?
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি যৌক্তিক নয়। কারণ যেকোনো পণ্য উৎপাদনের জন্য একটি উপাদান হচ্ছে জ্বালানি। সে ক্ষেত্রে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে উৎপাদনে গিয়ে সামগ্রিক কোনো আঘাত পড়ে না। কিন্তু আমাদের এখানে যোগাযোগব্যবস্থার মতো জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার অজুহাতে উৎপাদনকারীরা পণ্যের মূল্য ইচ্ছামতো বাড়িয়ে দেয়। আর এ পরিস্থিতিতে সরকারবিরোধীরাও সুযোগ পেয়ে যায়। তারা বাস্তবতার কথা চিন্তা করে না, করে তাদের রাজনৈতিক সুবিধার বিষয়টি। সাধারণ মানুষের সস্তা সেন্টিমেন্ট কাজে লাগিয়ে তারা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে পিছপা হয় না। এ অবস্থানকে অস্বাভাবিক রাজনৈতিক খেলা হিসেবেও বলার সুযোগ নেই। জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছে, ভালো কথা। কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যদি সেই অনুপাতে বাড়ানো যেত, তাহলে হয়তো এত আতঙ্ক সৃষ্টি হতো না। সরকারকে এই মুহূর্তে সেই দিকে অধিক নজর দিতে হবে। অন্যদিকে সস্তা জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা দেনার দায় রেখে নিরীহ সাধারণ মানুষের কাছে রাষ্ট্রকে বিরক্তিকর জায়গা বানানোর অধিকার নিশ্চয়ই কারো নেই।

লেখক : সাংবাদিক
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.