ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রেই খাদ্য বিভাগের পরীক্ষা!

ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র দিয়েই গতকাল শুক্রবার খাদ্য বিভাগের সহকারী উপ-খাদ্যপরিদর্শক পদে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের সঙ্গে গতকাল শুক্রবার অনুষ্ঠিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের মিল পাওয়া গেছে।


পরীক্ষা শুরুর আগেই কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জানালেও খাদ্য বিভাগ এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলেও অভিযোগ উঠেছে। উল্লেখ্য, সহকারী উপ-খাদ্যপরিদর্শকের ৪২৮টি পদের বিপরীতে দুই লাখ ১৮ হাজার এবং নিম্নমান সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিকের ৫০৩টি পদের বিপরীতে ৩০ হাজার প্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য আবেদন করেছেন।
পরীক্ষার্থী ও পরীক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, পরীক্ষার্থীদের অনেকেই ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র রাতেই পেয়ে যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ও নীলক্ষেতের ফটোকপির দোকোনে এ প্রশ্নপত্রটি ছিল সহজলভ্য। সন্ধ্যায় একেকটি প্রশ্নপত্র এক থেকে দেড় লাখ টাকায় কেনাবেচা হয়েছে। রাত বাড়তে থাকলে এই দাম কমে ৫০ থেকে ১০০ টাকায় নেমে আসে।
রাজধানীর বাইরে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও ফরিদপুরে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই তিন জেলায় মোট নয়জন ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন দুজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আমজাদ আলী অভিযোগ করেছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার বিষয়টি খাদ্য বিভাগের সচিব বরুন দেব মিত্রের কাছে জানাতে গিয়ে তিনি দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছেন। খাদ্যসচিব তাঁকে মুঠোফোনে ধমক দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন প্রক্টর।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সচিব বরুন দেব মিত্র প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুক্রবার সকাল সাড়ে আটটায় প্রক্টর আমাকে ফোন করে বলেন, ‘আপনি কী বরুন দেব মিত্র’। একজন সচিবকে এভাবে প্রশ্ন করা উচিত কি না, সেই প্রশ্ন তুলে তিনি ধমক দেওয়ার কথা অস্বীকার করেন।
সচিব জানান, প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। খাদ্যমন্ত্রী ও খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বর্তমানে দেশের বাইরে রয়েছেন। তাঁরা দেশে ফিরলে প্রয়োজনী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
মুঠোফোনে প্রার্থীকে প্রশ্নপত্র দেওয়ার সময় গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে হাতেনাতে ধরা পড়া ব্যক্তিরা হলেন তৌহিদুর রহমান ও ইসমত মেজবাহউদ্দিন। তৌহিদুল দাবি করেছেন, তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ছিলেন। আর ইসমত মেজবাহউদ্দিনের দাবি, তিনি ২০০৩-০৪ শিক্ষাবর্ষে দর্শনের ছাত্র ছিলেন। তাঁদের কাছে পাওয়া দুই সেট প্রশ্নের মধ্যে শাপলা সেট মূল প্রশ্নের সঙ্গে হুবহু মিলেছে।
শাহবাগ থানা পুলিশ জানিয়েছে, গতকাল রাত পর্যন্ত খাদ্য বিভাগের কেউ পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। আটক হওয়া ব্যক্তিদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া প্রশ্নের সঙ্গে অনুষ্ঠিত পরীক্ষার প্রশ্নের মিল পাওয়ায় তাঁদের বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে।
খাদ্য বিভাগের ব্যাখ্যা: খাদ্য বিভাগের এক ব্যাখ্যায় গতকাল জানানো হয়, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও মুদ্রণের কোনো প্রক্রিয়ায় মন্ত্রণালয় এবং খাদ্য অধিদপ্তরের কোনো কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট (আইবিএ) এ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করে। প্রস্তুতকৃত প্রশ্ন আইবিএ সিলগালা অবস্থায় ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রেসে পাঠায়।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রশ্নপত্র মুদ্রণ করে সিলগালা করে তা প্রেস কার্যালয়ে অবস্থানকারী খাদ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালকের কাছে হস্তান্তর করে। প্রেস কার্যালয় থেকেই সিলগালাকৃত প্রশ্নপত্র বিভিন্ন জেলায় পাঠানোর জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধিদের (ম্যাজিস্ট্রেট) কাছে হস্তান্তর করা হয়। গতকাল পরীক্ষার সময় ট্রেজারি থেকে প্রশ্নপত্র সংশ্লিষ্ট জেলার পরীক্ষা কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের পরিচালক গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরী বলেন, ‘খাদ্য বিভাগ শুধু আমাদের কাছ থেকে প্রশ্ন নিয়েছে। প্রশ্ন মুদ্রণ এবং বিতরণ তারাই করেছে। আইবিএ থেকে প্রশ্ন ফাঁসের কোনো সম্ভাবনা নেই।’
কুড়িগ্রাম অফিস জানায়, ঢাকা থেকে ই-মেইলে পাঠানো প্রশ্নপত্র চতুরা গ্রামের জলিল সরকারের বাড়িতে প্রিন্ট করা হচ্ছিল। রাজারহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাদেকুল হক জানান, গতকাল ভোরের দিকে গোয়েন্দা পুলিশ ওই বাড়ি থেকে জলিল সরকার (৬৬) ও তাঁর ছেলে মাহফুজার রহমানসহ (৩৩), বিভিন্ন এলাকার আবদুল হাই (২২), রুহুল আমিন (৪৫), মোস্তাফিজুর রহমান (৩০), লুৎফর রহমান (৩৩), আসাদুজ্জামান (১৮) ও হাসান বসুনিয়াকে (২২) গ্রেপ্তার করে।
কুড়িগ্রামের এক কেন্দ্রে পরীক্ষা শেষে চাকরি প্রার্থী হূদয় চন্দ্র রায়, জসীম উদ্দিন, কামরুল হাসান, রাশেদুল ইসলামসহ অনেক পরীক্ষার্থী অভিযোগ করেন, ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের সঙ্গে পরীক্ষার হলে সরবরাহ করা প্রশ্নপত্রের হুবহু মিল পাওয়া গেছে। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর তাঁরা প্রশ্নপত্র মিলিয়ে দেখেছেন।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের সঙ্গে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের হুবহু মিল পাওয়া গেছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।’
ফরিদপুরে পরীক্ষা চলার সময় ফাঁস হওয়া প্রশ্নসহ এক পরীক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে ভ্রাম্যমাণ আদালতে হাজির করা হলে আদালত তাঁকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেন। জরিমানার টাকা দিতে না পারায় তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়।
দণ্ডাদেশ পাওয়া পরীক্ষার্থীর নাম জমির উদ্দীন শেখ (২৬)। তাঁর বাড়ি রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার ইকরচর গ্রামে। ফরিদপুর সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, কলেজের বায়তুলামানস্থ সম্মান শাখার ২৫১ নম্বর কক্ষে ওই পরীক্ষার্থীকে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের ফটোকপিসহ শনাক্ত করা হয়। তাঁকে আটক করে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.