বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণ নিয়ে তোড়জোড় চলছে by তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

শেয়ারবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত স্বল্প পুঁজির বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগকে আগামী এক বছরের জন্য সুদমুক্ত রাখার চিন্তাভাবনা করছে সরকার। এ ছাড়া বাজার ধসের শুরু থেকে এ পর্যন্ত নেওয়া মার্জিন ঋণের সুদ সম্পূর্ণ মওকুফের বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশেষ সুবিধা প্রদানের অংশ হিসেবে এ ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।


ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের আইপিওতে এসব বিনিয়োগকারীকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।
বুধবার রাতে বাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগামীকাল রবিবারের মধ্যেই এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দেওয়া হবে। বৈঠক সূত্রে এসব খবর জানা যায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনার পর শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে বলে আশা করছে সরকার। গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন, সেসব বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে গতকাল শুক্রবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে বৈঠক করেছেন সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তারা। আগামী রবিবারের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করছেন তাঁরা। গতকালের বৈঠকের পর অর্থমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তবে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশনের (এসইসি)
চেয়ারম্যান অধ্যাপক খায়রুল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, 'প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর অবশ্যই শেয়ারবাজার পরিস্থিতির উন্নতি হবে। এ যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব দিয়েছে। সেসব প্রস্তাব বিবেচনা করে কী ধরনের বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, বৈঠকে সেসব বিষয়েই আলোচনা হয়েছে। রবিবারের মধ্যেই আমরা ইতিবাচক সিদ্ধান্তে পেঁৗছাব।'
এসইসির সদস্য নিজামউদ্দিন হেলালী বলেন, 'আমরা প্রস্তাবগুলো আরো পরীক্ষা করে দেখছি। রবিবারের মধ্যেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।'
সভায় অর্থসচিব ড. মোহাম্মদ তারেক, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. শফিকুর রহমান পাটোয়ারী, রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. নাসিরউদ্দিন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ড. নজরুল হুদা, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের প্রধান শেফাক আহমেদসহ আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এসইসির অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
জানা যায়, শেয়ারবাজারে তারল্য সংকট কাটাতে ব্যাংকিং খাতের এসএলআর (বিধিবদ্ধ তারল্যের অনুপাত) ও সিআরআর (নগদ জমার অনুপাত) হ্রাস, শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা হিসাবের পদ্ধতি পরিবর্তন, মার্জিন ঋণের সুদ মওকুফ, এই ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা জামানত (প্রভিশন) রাখার বাধ্যবাধকতা শিথিল এবং গত দুই বছরে শেয়ারবাজার থেকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্জিত মুনাফা পুনর্বিনিয়োগের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। সূত্র মতে, প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে বুধবার রাতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বৃহস্পতিবার সকালেও অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি প্রাথমিক বৈঠক হয়।
বুধবার প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক থেকে বেরিয়ে এসইসি সদস্য আরিফ খান বলেন, বাজারে স্থিতিশীলতা ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। দু-একদিনের মধ্যেই এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দেওয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, শেয়ারবাজারে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা বাড়াতে তারল্য সংকট দূর করার বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকের এসএলআর এবং সিআরআর হার কমানোর বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। একইসঙ্গে শেয়ারবাজারে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগসীমা (এঙ্প্লোজার লিমিট) হিসাবের ক্ষেত্রে বিদ্যমান পদ্ধতি পরিবর্তন হতে পারে। বর্তমানে ব্যাংকের নিজস্ব বিনিয়োগের সঙ্গে সহযোগী প্রতিষ্ঠানের (সাবসিডিয়ারি) বিনিয়োগ ও ঋণ যোগ করে বিনিয়োগসীমা হিসাব করা হয়। এর পরিবর্তে শুধু ব্যাংকের নিজস্ব বিনিয়োগের ভিত্তিতে এই সীমা নির্ধারণ করা হতে পারে। অন্যদিকে মার্জিন ঋণের সুদ মওকুফের ক্ষেত্রে বিধিগত জটিলতা এড়াতে এই ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা জামানত (প্রভিশন) রাখার বাধ্যবাধকতা শিথিল করা হবে। একইসঙ্গে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মার্জিন ঋণ আদায় বন্ধ রাখার বিষয়টিও বিবেচনা করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে পুঁজিবাজারে নতুন অর্থপ্রবাহ বাড়াতে অপ্রদর্শিত অর্থের প্রশ্নহীন বিনিয়োগের সুযোগ কার্যকর করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এ ধরনের অর্থ বিনিয়োগ করা হলে সরকারের কোনো সংস্থা থেকে প্রশ্ন করা হবে না বলে নিশ্চিত করা হয়েছে। পাশাপাশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বলা হয়েছে। ব্যাংকের তারল্য সংকট সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হলে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব বলে বৈঠকে জানানো হয়েছে।
বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে ইতিমধ্যেই ব্রোকারেজ কমিশনের ওপর উৎসে কর হ্রাস, মিউচ্যুয়াল ফান্ডের আয়কে করমুক্ত রাখাসহ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের অর্থে কর রেয়াত সুবিধা প্রদান করা হয়েছে বলে বৈঠকে জানানো হয়। আগে নেওয়া পদক্ষেপগুলো কার্যকর করার পাশাপাশি নতুন আঙ্গিকে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে প্রস্তাব এসেছে। সামগ্রিকভাবে পর্যালোচনা করে এ বিষয়ে ঘোষণা দেওয়া হবে।
বুধবারের বৈঠকে শেয়ারবাজার কারসাজির বিষয়টি জোরেশোরে আলোচিত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়। জানা গেছে, কারসাজির জন্য বুকবিল্ডিং পদ্ধতির মাধ্যমে শেয়ারবাজারের টাকা লুটপাটের বিষয়টি ওঠে আসে। বিনিয়োগসীমার বাইরে ব্যাংকগুলোর আগ্রাসী উপস্থিতি বাজারকে অতিমূল্যায়িত করছিল_সমালোচনা করেন বৈঠকে উপস্থিত একাধিক ব্যক্তি। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে যথাসময়ে লাগাম না টেনে ধরার সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া কারসাজির নানা কৌশল নিয়েও আলোচনা হয়। কার সাজিচক্রের কারো নাম উল্লেখ করে আলোচনা না হলেও বুধবারের বৈঠকে অনেক বিতর্কিত ব্যক্তিকে উপস্থিত না থাকার বিষয়টি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের নিমন্ত্রণ জানানো হলেও আসেননি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কম্পানিজের (বিএপিএলসি) সভাপতি সালমান এফ রহমান। জাতীয় সংসদের অর্থমন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি আ হ ম মুস্তাফা কামালও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না।
মোরশেদ আলম নামের একজন বিনিয়োগকারী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বৈঠকে কারসাজি চক্রের কেউ উপস্থিত না থাকায় সরকারের ইমেজ বেড়েছে। তাই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার ভাব জন্ম নিয়েছে।'
লগ্নিকারীদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির পক্ষে বিশেষজ্ঞরা

No comments

Powered by Blogger.