মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস by মুহম্মদ জাফর ইকবাল

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় প্রবাসী অনেক বাঙালী মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করেছেন। তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশ সরকারের জন্য টাকা তুলেছেন, পাকিসত্মানের গণহত্যার কথা পৃথিবীকে জানিয়েছেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পৰে জনমত তৈরি করেছেন।
যাঁদের কথা বিশেষভাবে উলেস্নখ করা যায়, তাঁরা হচ্ছেন জাস্টিস আবু সায়ীদ চৌধুরী, স্থপতি এফআর খান, প্রফেসর মুহম্মদ ইউনূস এবং প্রফেসর রেহমান সোবহান। শুধু যে বাংলাদেশের মানুষই এগিয়ে এসেছিলেন তা নয়, আগস্টের ১ তারিখ নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে রবিশংকর, জর্জ হ্যারিসনসহ অসংখ্য শিল্পীকে নিয়ে স্মরণাতীতকালের বৃহত্তম একটি কনসার্ট সারা পৃথিবীর বিবেককে নাড়িয়ে দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কবি এ্যালেন গিনসবার্গ শরণাথর্ীদের কষ্ট নিয়ে 'সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড' নামে যে অসাধারণ কবিতাটি রচনা করেন, সেটি এখনও মানুষের বুকে শিহরণের সৃষ্টি করে।

পক্ষের দেশ বিপৰের দেশ
পাকিসত্মান সেনাবাহিনীর গণহত্যার কথা পৃথিবীতে প্রচার হওয়ার পর পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেরই সমবেদনা বাংলাদেশের পৰে ছিল, তবে দুটি খুব গুরম্নত্বপূর্ণ দেশ_ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন পাকিসত্মানের পৰে থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরম্নদ্ধে কাজ করেছে। একাত্তরে যদিও ইসলামের নামে বাংলাদেশের বেশিরভাগ মুসলমানকেই হত্যা করা হচ্ছিল, তার পরেও পৃথিবীর প্রায় সকল মুসলিম দেশও পাকিসত্মানের পৰে থেকে আমাদের মুক্তিসংগ্রামের বিরোধিতা করেছে। যদিও রাজনৈতিক কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিসত্মানের পৰে ছিল কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। পাকিসত্মান সেনাবানিহীর গণহত্যার দৃশ্য দেখে সে সময়কার মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্চার কে. বস্নাড ৰুব্ধ হয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টে যে টেলিগ্রামটি পাঠিয়েছিলেন সেটি কূটনৈতিক জগতে সবচেয়ে কঠিন ভাষায় লেখা চিঠি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
স্বাধীনতা সংগ্রামের একেবারে শেষের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সপ্তম নৌবহরের যুদ্ধজাহাজ বঙ্গোপসাগরে পাঠিয়ে দিয়েছিল এবং সোভিয়েত ইউনিয়নও নিউকিয়ার ৰমতাধারী যুদ্ধজাহাজ এই এলাকায় রওনা করিয়ে দিয়েছিল। শুনে অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটি সত্যি যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে উপলৰ করে বিশ্বের দুই পরাশক্তি নিউকিয়ার অস্ত্র নিয়ে পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিল।
স্বাধীনতা যুদ্ধের একেবারে শেষ মুহূর্তে যখন বাংলাদেশ এবং ভারতের যৌথবাহিনীর জয় একেবারে সুনিশ্চিত তখন সেই বিজয়ের মুহূর্তটিকে থামিয়ে দেবার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বারবার জাতিসংঘের সিকিউরিটি কাউন্সিলে যুদ্ধ বিরতির প্রসত্মাব নিয়ে এসেছিল এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো দিয়ে এ প্রসত্মাবকে নাকচ করে দিয়ে আমাদের বিজয়ের পথ সুনিশ্চিত করেছিল। তবে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে যে দেশটির ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি, সেই দেশ হচ্ছে ভারত। এই দেশটি প্রায় এক কোটি শরণাথর্ীর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিয়েছিল, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র, প্রশিৰণ আর আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেছিল। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার পর ভারত মুক্তিবাহিনীর সাথে মিত্রবাহিনী হিসেবে পাকিসত্মানের বিরম্নদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেয়। এই যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রায় দেড় হাজার সৈনিক প্রাণ দিয়েছিল।

যৌথবাহিনী
জুলাই মাসের দিকে নতুন করে যুদ্ধ শুরম্ন করে অক্টোবর মাসের ভেতর বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী দেখতে দেখতে শক্তিশালী আর আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল। তারা পাকিসত্মান সেনাবাহিনীর বর্ডার আউটপোস্টগুলো নিয়মিতভাবে আক্রমণ করে দখল করে দিতে শুরম্ন করে। গেরিলাবাহিনীর আক্রমণও অনেক বেশি দুঃসাহসী হয়ে উঠতে থাকে। পাকিসত্মান সেনাবাহিনী এই আক্রমণের জবাব দিত রাজাকারদের নিয়ে গ্রামের মানুষের বাড়িঘর পুড়িয়ে আর স্থানীয় মানুষদের হত্যা করে। ততদিনে পাকিসত্মান সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে পড়তে শুরম্ন করেছে, তারা আর সহজে তাদের ঘাঁটির বাইরে যেতে চাইত না।
বাংলাদেশে পাকিসত্মানী সেনাবাহিনীর অবস্থা দেখতে দেখতে এত খারাপ হয়ে গেল যে পাকিসত্মান তার সমাধান খুঁজে না পেয়ে ডিসেম্বরের তিন তারিখ ভারত আক্রমণ করে বসে। পাকিসত্মানের উদ্দেশ্য ছিল হঠাৎ আক্রমণ করে ভারতের বিমানবাহিনীকে পুরোপুরি পঙ্গু করে দেবে কিন্তু সেটি করতে পারল না। ভারত সাথে সাথে পাকিসত্মানের বিরম্নদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সাথে যৌথভাবে বাংলাদেশে তার সেনাবাহিনী নিয়ে প্রবেশ করে। বাংলাদেশের ভেতর তখন পাকিসত্মানের পাঁচটি পদাতিক ডিভিশন। যুদ্ধের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী আক্রমণের জন্য তিনগুণ বেশি অর্থাৎ ১৫ ডিভিশন সৈন্য নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু ভারতীয়রা মাত্র আট ডিভিশন সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ শুরম্ন করার সাহস পেয়েছিল। কারণ তাদের সাথে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের বাহিনী। সেই মুক্তিযোদ্ধারা পাকিসত্মানী সেনাবাহিনীকে এর মাঝেই পুরোপুরি অচল করে রাখতে পেরেছিল। শুধু যে মুক্তিযোদ্ধারা ছিল তা নয়_ এই যুদ্ধে দেশের সাধারণ মানুষও ছিল যৌথবাহিনীর সাথে।
যুদ্ধ শুরম্ন হবার পর সেটি চলেছে মাত্র তেরো দিন। একেবারে প্রথম দিকেই বোমা মেরে এয়ারপোর্টগুলো অচল করে দেবার পর পাকিসত্মান এয়ারফোর্সের সব পাইলট পালিয়ে গেল পাকিসত্মানে। সমুদ্রে যে কয়টি পাকিসত্মানী যুদ্ধজাহাজ ছিল সেগুলো ডুবিয়ে দেবার পর পাকিসত্মান সেনাবাহিনীর বাকি রইল শুধু তার স্থলবাহিনী_নিরীহ জনসাধারণ হত্যা করতে তারা অসাধারণ পারদশর্ী কিন্তু সত্যিকার যুদ্ধে কেমন করে, সেটি দেখার জন্য মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় বাহিনী অধীর আগ্রহে অপেৰা করছিল।
যুদ্ধ শুরম্ন হওয়ার পর একটি একটি করে পাকিসত্মানের ঘাঁটির পতন হতে থাকল_তারা কোনমতে প্রাণ নিয়ে অল্পকিছু জায়গায় মাটি কামড়ে পড়ে রইল। ভারতীয় বাহিনী আর মুক্তিবাহিনী তাদেরকে পাশ কাটিয়ে অবিশ্বাস্য দ্রম্নততায় ঢাকার কাছাকাছি এসে হাজির হয়ে যায়। মেঘনা নদীতে কোন ব্রিজ ছিল না, সাধারণ মানুষ তাদের নৌকা দিয়ে সেনাবাহিনীকে তাদের ভারি অস্ত্রসহ পারে করিয়ে আনল!
ঢাকায় জেনারেল নিয়াজী এবং তার জেনারেলরা বাংলাদেশের যুদ্ধে টিকে থাকার জন্য যে দু'টি বিষয়ের ওপর ভরসা করছিল, সেগুলো ছিল অত্যনত্ম বিচিত্র। প্রথমত, তারা বিশ্বাস করত পশ্চিম পাকিসত্মানের যুদ্ধে তারা ভারতকে এমনভাবে পর্যুদসত্ম করবে যে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বাহিনীর সরে যাওয়া ছাড়া কোন গতি থাকবে না। দ্বিতীয়ত, যুদ্ধে তাদের সাহায্য করার জন্য উত্তর দিক থেকে আসবে চীনা সৈন্য আর দৰিণ দিক থেকে আসবে আমেরিকান সৈন্য। কিন্তু দেখা গেল তাদের দু'টি ধারণাই ছিল পুরোপুরি ভুল। পশ্চিম পাকিসত্মান সীমানত্মে পাকিসত্মানীরাই চরমভাবে পযর্ুদসত্ম হলো আর কোন চীনা বা আমেরিকান সৈন্য তাদের সাহায্যের জন্যে এগিয়ে এলো না!

No comments

Powered by Blogger.