দেশজ অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ by বোরহান উদ্দিন

নব্বইয়ের দশকে অর্থাৎ ১৯৯১ অথবা ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বোচ্চ নিট মুনাফা অর্জন করেছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এত অধিক মুনাফা অর্জন আর করতে পারেনি।
বিপরীতে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মুনাফা অর্জন ছিল সর্বনিম্ন পর্যায়ে। অর্থাৎ না পারতে লাভ দেখিয়েছিল। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কু-ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি, তারল্য সঙ্কটনসহ মূলধনী সঙ্কটের কারণেই তফসিল বা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ভাল করতে পারেনি।
এটা বলতে হচ্ছে এজন্য_ যে বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবচেয়ে বেশি মুনাফা করবে, ধরে নিতে হবে সে বছর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সামগ্রিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা খারাপ ছিল। তদ্রম্নপ বিপরীত অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুনাফা স্বাভাবিক পর্যায়ে অর্জন করলে বুঝতে হবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সার্বিক সম্পদ ও ব্যবস্থাপনা ভাল চলছে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সামগ্রিক নিট লাভ কমে যাওয়ার পেছনে কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো নন-পারফরমিং সম্পদ বৃদ্ধি, সামগ্রিক ঋণ বিতরণ ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম, ঋণ খেলাপিতে পরিণত হওয়া। আমদানি ও রফতানিতে সম্পৃক্ততা না থাকা অথবা ভাল সম্পদের বিনিময়ে আমদানি-রফতানি ব্যবসা না করা, কাস্টমারের চাহিদা মোতাবেক টাকার যোগান না থাকা বা তারল্য সঙ্কটের কারণে কলমানি মার্কেটে ছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ধার নেয়া। আমদানিকে বৈদেশিক মুদ্রা পরিশোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হওয়া।
আমেরিকার অর্থনীতিতে ধসের প্রধান কারণ ছিল সে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানিগুলোর ঋণ বিতরণসহ জামানত সম্পত্তিকে অতিমূল্যায়ন করে ঋণ প্রদান করা। যখন ব্যাংকগুলো খেলাপিঋণ আদায় করার জন্য মাঠে নেমেছিল দেখা গেল তাদের বিতরণকৃত ঋণের সম বা ততধিক মূল্যে সম্পদ বা বাড়ি বিক্রি হচ্ছে না। ঋণ পরিশোধের জন্য অধিকাংশ ঋণ গ্রহীতা বাড়ি বিক্রি করতে চেয়েছিল তখন দেখা গেল ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে গেছে। ফলশ্রম্নতিতে মর্টগেজকৃত সম্পত্তির অবমূল্যায়ন ঘটল।
আমেরিকার অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ভারি শিল্পগুলোতে শ্রমিক ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছে, বেকারত্বের কারণে অনেক অধিবাসীকে ভাড়া বাড়ি ছেড়ে তাঁবু টাঙ্গিয়ে খোলা মাঠে বসবাস করতে দেখা গেছে।
আমেরিকা ও ব্রিটেনের মতো উন্নত ও শক্তিশালী দেশের পতিত অর্থনৈতিক মন্দার প্রতিফলন এশিয়ায় বিশেষ করে দৰিণ এশিয়ার দেশগুলোর ওপর তেমন প্রভাব পড়েনি। মন্দার কারণে বাংলাদেশে আমদানি ও রফতানি কিছুটা কম হলেও উলেস্নখযোগ্য কোন বৈপরীত্য/বিরূপ প্রভাব প্রতিফলিত হয়নি। গার্মেন্টস শিল্পসমূহ এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত শিল্পসমূহ অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বন্ধ হয়নি। যে কয়টি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে তা বিশেস্নষণ করলে দেখা যাবে তাদের অভ্যনত্মরীণ অব্যবস্থাপনার কারণেই হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের (কেন্দ্রীয় ব্যাংক) ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ২০০৯ সালে মোট মুনাফা করেছে ৫২১ কোটি ডলার (৩২২ কোটি পাউন্ড)। ২০০৮ সালের তুলনায় ৪৭ শতাংশ বেশি। বিশ্বের বৃহত্তম সমৃদ্ধশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা অর্জন করেছে। আবার ওই দেশের বাণিজ্যের ঘাটতির পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নন-পারফরমিং সম্পদ বৃদ্ধি ও মূলধনী ঘাটতির কারণে ব্যবসা ভাল করতে পারেনি বলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর লাভের পরিমাণ কমছে। এমনকি পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ভতর্ুকি বা বিশেষ বরাদ্দের মাধ্যমে দেশের বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংককে দৌউলিয়াত্ব থেকে রৰা করেছে।
আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুনাফার পেছনে বলাও হয়েছে যে সরকারী বন্ড ও বন্ধকী সম্পদের সুদের এবং জনগণের দেয়া করের কারণেই মুনাফা বৃদ্ধিতে উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। আমাদের দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মুনাফার প্রতিযোগিতা এমনভাবে শুরম্ন হয়েছে যে কোন ব্যাংক কত বেশি মুনাফা করতে পারে তার ওপর। কোন ব্যাংক নিট লাভ করছে ৮শ' কোটি টাকারও ওপর। আবার বেসরকারী ব্যাংকগুলোর মধ্যে ধর্মের দোহাই দিয়ে একটি ব্যাংক সকল রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোকেও মুনাফার দিক দিয়ে হার মানিয়ে দিয়েছে। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশি মুনাফা করলে বুঝতে হবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর স্বাস্থ্যের অবস্থা ভাল নয়। সেৰেত্রে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর উচ্চ হারে যে মুনাফা অর্জন করেছে, সেৰেত্রে আমাদের বাংলাদেশ ব্যাংকের মুনাফার অবস্থান কোথায় তা একানত্ম জানার বিষয়।
পত্রপত্রিকায়, সংশিস্নষ্ট দফতর এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক রিজার্ভের পরিমাণ হাজার কোটি ডলারের ওপরে উপচে পড়ছে। তা হলে কি রিজার্ভ ফান্ড দিন দিন বাড়তে থাকবে_ না এর সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
মাননীয় গবর্নর বলেছেন, কেউ যদি শিল্প করতে চায় তাকে বা সে প্রতিষ্ঠানকে রিজার্ভ ফান্ড থেকে ঋণের ব্যবস্থা করা হবে। এ জমাকৃত রিজার্ভ ফান্ড বৃদ্ধি হওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হচ্ছে বিদেশ প্রবাসীরা তল্পিতল্পা নিয়ে একেবারে চলে আসছে সঙ্গে তাদের সব জমা টাকাও নিয়ে আসছে। এদের হার পত্রিকানত্মরে জানা যায় প্রায় ৬০ শতাংশ। বিদেশে চাকরি নিয়ে যাওয়া নতুনদের সংখ্যা প্রতিনিয়ত কমছে। ভবিষ্যতে প্রবাসীদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ক্রমান্বয়ে কমতে থাকবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এ বিষয়ে জরম্নরী ভিত্তিতে ভবিষ্যত পরিকল্পনা গ্রহণ করা আবশ্যক। অপরদিকে ক্যাপিটেল মেশিনারিজ আমদানির পরিমাণ কমে যাওয়া এবং নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ার সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণেও রিজার্ভ ফান্ড বৃদ্ধি পেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ রিজার্ভ ফান্ড থেকে ব্যক্তিগত উদ্যোক্তা না পাওয়া গেলে সরকারী বা কর্পোরেশনের মাধ্যমে দু'একটি শিল্প প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগও নেয়া যেতে পারে।
প্রাইভেট ব্যাংকগুলো কিনিক, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ ও কমিউনিটি সেন্টার প্রতিষ্ঠান গড়ে লাভ করছে। আমাদের সরকারী ব্যাংকগুলো কি সংশিস্নষ্ট শিল্প অভিজ্ঞ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দিয়ে রফতানিযোগ্য নিজস্ব শিল্প গড়তে পারে না? ব্যক্তি মালিকানা ব্যাংকগুলো যদি ব্যাংক ব্যবসা ছাড়াও এতগুলো প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে লাভ করতে পারে আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? তাতে তো বিপুলসংখ্যক বেকার যুবকদের চাকরির সংস্থান হবে।
আমাদের দেশ ছোট। জমির পরিমাণ নিতানত্মই কম। দিন দিন চাষাবাদী জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। যে কোন নতুন শিল্প গড়তে চাষাবাদী জমি নষ্ট না করে অনাবাদী জমি ব্যবহার করে শিল্প গড়ার জন্য সকল ব্যাংকগুলোকে দ্রম্নত নির্দেশ প্রদান দেশের জনগণের স্বার্থে অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত, তিনি একজন প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ। তিনি বারবার বলছেন, দারিদ্র্যবিমোচনের কথা এবং এৰেত্রে হতদরিদ্র কৃষক, দিনমজুর ও বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরম্নত্ব আরোপ করেছেন। তিনিই প্রথম বিনা সুদে ঋণ প্রদানের কাজ শুরম্ন করেছেন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আক্রানত্ম কৃষকদের মাঝে। যাতে কৃষকরা ও হতদরিদ্ররা কৃষি উৎপাদনে উৎসাহিত হয়। অন্যান্য ব্যাংকেও এ নীতি অনুসরণ করা অত্যাবশ্যক।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমাদের দেশের ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা পলস্নী ঋণের সঙ্গে সম্পৃক্ত তারা কতটুকু এ বিষয়ে উৎসাহবোধ করছেন না। তাদের মাঝে তো মুনাফা অর্জনের প্রবণতা ভীষণভাবে কাজ করছে। অনেক উর্ধতন কর্মকর্তাকে বলতে শুনেছি পলস্নী ঋণের স্বনির্ভর খাতসমূহে বিশেষ করে যেসব খাতে সুদের হার কম ওইসব খাতে ঋণ প্রদানে নিরম্নৎসাহিত করতে। এ যদি হয় তবে দেশের দারিদ্র্যবিমোচনে ও সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে কিভাবে বাসত্মবে প্রতিফলন ঘটবে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উন্নতি সুদূরপরাহত হবে।
প্রাচীন চীনের কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে চীনের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক কনফুসিয়াসের অর্থনৈতিক ভাবনা সমাজ, অর্থনীতি, নৈতিকতা প্রভৃতি ৰেত্রে পরিব্যপ্ত ছিল। কনফুসিয়াস ছিলেন মূলত নীতিবাদী দার্শনিক। তাঁর অর্থনৈতিক নীতি ছিল কৃষিভিত্তিক। তিনি দেখিয়েছিলেন "সম্পদ ভূমির সাথে সম্পৃক্ত" তাই তিনি সমাজকে চারটি ভাগে ভাগ করেছিলেন। (১) জ্ঞানীয় আমলাবর্গ নিয়ে অভিজাত শ্রেণী, (২) জাতিকে খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখে বর্গাচাষী ও কৃষক, (৩) কারিগর যারা শিল্প পণ্য বানায় এবং (৪) ব্যবসায়ী যারা খাদ্য ও মালামাল বিতরণ ও বণ্টন করে থাকে। এ মতবাদকে কনফুসিয়াস মতবাদ বলা হয়। চীনের ইতিহাসে এটা ছিল দীর্ঘকালীন রাষ্ট্রীয় আদর্শ। এ ভাবাদর্শের দেশ হলো জাপান ও দৰিণ কোরিয়া এবং ভিয়েতনামও। এসব দেশগুলো সব সময় কৃষিকে প্রাধান্য দিয়ে আসছে। বর্তমানে এ আদর্শের বাসত্মবায়নে ওই সকল দেশের কৃষিতে যেমনি উন্নতি ঘটেছে তেমনি শিল্পেও তারা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। তাদেরও সুষ্ঠু বণ্টন ব্যবস্থা বিদ্যমান।
তাই সকল সরকারী ও বেসরকারী ব্যাংক শুধু মুনাফার দিকে ঝুঁকে না গিয়ে কম মুনাফা অর্জনকারী খাতে যেমন রবিশস্য, পিঁয়াজ, রসুন, আদা চাষসহ কৃষি, শিল্পে ও দারিদ্র্যবিমোচনে স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণ নিশ্চিত করলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে উক্ত দ্রব্যাদি আমদানি কমবে, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে এবং প্রকৃতিক দুর্যোগ এলাকায় সুদবিহীন ঋণ বিতরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখা এবং পাশাপাশি শিল্প প্রতিষ্ঠার নামে চাষাবাদী জমি ব্যবহার নিরম্নৎসাহিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ খুবই বাসত্মবসম্মত উদ্যোগ হবে।
সাবেক এজিএম
জনতা ব্যাংক লিমিটেড

No comments

Powered by Blogger.