মূল্যস্ফীতির চরম পর্যায় by শেখ শাহেদুল আমিন

অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মূল্যস্ফীতির কারণে ভোক্তা আগে একটি নির্দিষ্ট দামে যে পরিমাণ দ্রব্য কিনতে পারত তার তুলনায় তার ক্রয়ৰমতা কমে যায়।
মূল্যস্ফীতি যতটা না উচ্চবিত্তদের তার চেয়ে বেশি নিম্নবিত্তদের ৰতি করে। বাংলাদেশেও বর্তমানে মূল্যস্ফীতির পরিস্থিতি বিরাজ করছে। গত বছরের অক্টোবরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬.৭১%, যা বৃদ্ধি পেয়ে নবেম্বরে ৭.২৪% এবং ডিসেম্বরে ৮.৫১% এ এসে দাঁড়িয়েছে। গত ১৪ মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতির এই হার সর্বোচ্চ। এখানে উলেস্নখ্য যে, ২০১০ অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতির লৰ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬.৫%। খাদ্য এবং খাদ্যবহির্ভূত উভয় খাতে মূল্যবৃদ্ধির কারণেই মূলত এই মূল্যস্ফীতির চাপ দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ বু্যরো অব স্ট্যাটিসটিক্সের তথ্য অনুযায়ী, খাদ্য এবং খাদ্যবহিভর্ূত উভয় খাতেই মূল্যস্ফীতির চাপ ছিল উর্ধমুখী। গত বছরের ডিসেম্বরে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতির পরিমাণ ছিল ৯.৫০%, যার পরিমাণ নবেম্বরে ছিল ৭.৮৪%। খাদ্যবহির্ভূত খাতেও মূল্যস্ফীতি নবেম্বরের ৬.৪৪% থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৭.০৪%-এ এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উর্ধতন কর্মকর্তার মতে "মূল্যস্ফীতিজনক এই বৃদ্ধি পেয়েছে মূলত দেশীয় এবং আনত্মর্জাতিক বাজারে খাদ্য এবং খাদ্যবহির্ভূত দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতির কারণে।" তিনি আরও বলেছেন, "মূল্যস্ফীতির এই উর্ধগতি নিকট ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে কেননা বিশ্ববাজারে দাম কমার কোন লৰণ নেই।" বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতির প্রকল্প অনুযায়ী ২০১০ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার পয়েন্ট টু পয়েন্ট পদ্ধতিতে গত বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পাবে। তবে তারা আশা প্রকাশ করেছেন যে, ২০১০ অর্থবছরের শেষে ঈড়হংঁসবৎ চৎরপব ওহফবী -এর বার্ষিক গড় বাজেটের লৰ্যমাত্রার মধ্যেই থাকবে।
খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতির যে চাপ লৰ্য করা যাচ্ছে, তার পেছনে প্রধান কারণ হলো চালের দামের উর্ধগতি। চালের বাজার এই অস্থিতিশীলতার জন্য অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিত সিন্ডিকেটরদের দোষারোপ করেছেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) এবং দি ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই) আয়োজিত এক সেমিনারে অর্থমন্ত্রী বলেন, "একটি সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী বাজার ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এ ছাড়া মূল্য বৃদ্ধির আর কোন যৌক্তিক কারণ নেই।" তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের তুলনায় বর্তমানে এই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত মূল্যস্ফীতির জন্য তারা খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিকেই মূল কারণ হিসেবে অভিহিত করেছেন। বিআইডিএস-এর ডিরেক্টর জেনারেল কেএম মুজেরি এবং রিসার্চ ডিরেক্টর এম আসাদুজ্জামান সেমিনারে তাদের এক রিপোর্টে বলেছেন, "বাংলাদেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি সাধারণত খাদ্য খাতের মূল্যস্ফীতির গতিধারাকে অনুসরণ করে যার হার জাতীয় পর্যায়ে প্রায় ৬৫%।" গত বছর বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পরিমাণ চাল এবং গম উৎপাদিত হয়েছে প্রধানত সরকারের যথাযথ কাঁচামাল সরবরাহ এবং ভতর্ুকি প্রদানের কারণে। কিন্তু বিশ্ববাজারে চালের ব্যাপক চাহিদা এবং চাহিদার অনুপাতে সরবরাহ বৃদ্ধি না হওয়াতে বিশ্ববাজারে চালের মূল্য আরও বৃদ্ধি পাবে। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি পরোৰভাবে সরকারকে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে বেতন বৃদ্ধিতে চাপ প্রয়োগ করে এবং অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া আরও অনেক কারণে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির চাপ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই ব্যাপারে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক মোসত্মাফিজুর রহমান বলেন, "বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রেরণ এই মূল্যস্ফীতিজনক চাপকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যেতে পারে।" তাঁর সাথে তিনি যোগ করেন, "তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে মার্কিন ডলারের নিয়ন্ত্রিত সরবরাহের মাধ্যমে বিনিময় হারকে স্থিতিশীল রাখার ব্যাপারে গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।" সিপিডির তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকিং এবং শিল্প খাতে ঋণের পরিমাণ যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংকিং খাতের বাড়তি তারল্যও মূল্যস্ফীতি বাড়ার পেছনে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। উপরন্তু সংরৰিত বৈদেশিক মুদ্রাও গত কয়েক মাসে রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সিপিডির মতে, শিল্প খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাবের কারণে বাড়তি তারল্য দেখা দিয়েছে। অপর্যাপ্ত কাঁচামাল এবং যন্ত্রপাতি আমদানির কারণে গত বছরে বাণিজ্য সম্প্রসারণের হারও ছিল কম। মোসত্মাফিজুর রহমান বলেন, "দেশীয় বাজারের অস্থিতিশীলতা এবং আনত্মর্জাতিক বাজারে চাহিদার মন্থর গতির কারণেই এমনটা হয়েছে।"
মূল্যস্ফীতি দেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ৰেত্রে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করে। তাই এমন সমস্যা প্রতিরোধে এবং মূল্যস্ফীতিকে সহনশীল পর্যায় রাখতে সরকারকেই বিভিন্ন পদৰেপ নিতে হবে। সিপিডির তথ্যমতে, বোরোর অধিক উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে। সেই সাথে উৎপাদন ব্যয় কমানোর জন্য কাঁমাল আমদানিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভতর্ুকি এবং উচ্চ প্রযুক্তির প্রয়োগ করতে হবে। উৎপাদন ব্যবস্থাকে বহুমুখী করতে হবে। শিল্প খাতের মন্থর গতিকে চাঙ্গা করার জন্য সরকারী খাতের সংস্করণ এবং বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়াতে হবে। শিল্প খাতে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ বিদু্যৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। ভারত থেকে বিদু্যৎ আমদানিকে সিপিডি প্রশংসনীয় বললেও, আমদানিকৃত ১০০ মেগাওয়াট পরিস্থিতির উন্নতি করতে পারবে না। রপ্তানি খাতে যদিও ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এর আগের অর্থবছরের তুলনায় ১০.২৮% বৃদ্ধি দেখা গেলেও তৈরি পোশাক খাতে বর্তমান অর্থবছরের প্রথম কোয়ার্টারে বৃদ্ধি হার কমেছে। বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে। বিভিন্ন দ্রব্যের আমদানি মূল্য, পাইকারি মূল্য এবং খুচরা মূল্য যথাযথভাবে পর্যবেৰণ করতে হবে। পরিশেষে বলা যায় যে, সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বিচারে এই অর্থবছরে মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সরকারকে কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.