উনিশ মিনিটে রচিত হলো একটি ইতিহাস by আবদুল মান্নান

বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অনেক বক্তৃতা দিয়েছেন। মাঠে, ঘাটে, পথে, প্রানত্মরে, সংসদে, জাতিসংঘে, ঢাকা, কলকাতা, লাহোর ও করাচি তিনি বিচরণ করেছেন।
এসব বক্তৃতা তিনি কখনও দিয়েছেন ছাত্রনেতা হিসেবে, কখনও রাজনৈতিককর্মী, দলীয় প্রধান, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী অথবা রাষ্ট্রপতি। বঙ্গবন্ধু অনেক কারণে বাংলা ও বাঙালীর ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। এই অমরত্বে পেছনের কারণগুলোর তালিকা অনেক দীর্ঘ। তবে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রমনা রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত ভাষণটি নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক।
১৯৭০-এর নির্বাচনের পর ১৯৭১-এর ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে তিনি নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের এক শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। সেই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান ছিল এক কথায় অবিস্মরণীয় ও অভূতপূর্ব। লাখো জনতার সামনে খোলা মঞ্চে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ হতে নির্বাচিত গণ-পরিষদের সদস্যরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শপথ গ্রহণ করেন যে তারা 'অঞ্চলে অঞ্চলে ও মানুষে মানুষে বিরাজমান চরম রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের চির অবসান ঘটাইয়া শোষণমুক্ত সুখী সমাজের বুনিয়াদ গড়িবেন।'
সত্তরের নির্বাচনের অব্যবহিত পরই পাকিসত্মানের সামরিক, বেসামরিক কুচক্রী মহল ওই নির্বাচনের রায়কে বানচাল করার জন্য ষড়যন্ত্র শুরম্ন করে। পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিসত্মানের উভয় অংশে দুজন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার অদ্ভুত তথ্য এই ষড়যন্ত্রে নতুন মাত্রা ও শক্তি যোগ করে। বিচণ বঙ্গবন্ধুর তার পূর্বের অভিজ্ঞতা হতে এসব ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। ৩ জানুয়ারির শপথ অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণে তিনি পশ্চিম পাকিসত্মানের রাজনীতিবিদ এবং নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের উদ্দেশে করে বলেন, তিনি তাদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করলেও নীতির প্রশ্নে কোন আপোস করবেন না। তিনি এও ঘোষণা করেন নতুন গণপরিষদে পাকিসত্মানের জন্য যে সংবিধান রচিত হবে তা অবশ্যই ছয় দফার ভিত্তিতে হবে এবং তা থেকে তাকে বা তার দলকে কখনও বিচু্যত করা যাবে না। তিনি সব মহলকে মনে করিয়ে দেন যে সত্তরের নির্বাচনে তাঁকে এবং তার দলকে জনগণ ছয় দফার ভিত্তিতেই সমর্থন দিয়েছেন। তাদের সঙ্গে তিনি কোন অবস্থাতেই বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন না। বঙ্গবন্ধু তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে সব সময় জনগণের প্রত্যাশাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। জনগণের সঙ্গে কখন বিশ্বাসঘাতকতা করেননি।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরে সারা পাকিসত্মানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর এটি প্রত্যাশিত ছিল রেওয়াজ অনুযায়ী দ্রম্নততম সময়ে গণ-পরিষদের অধিবেশনে আহ্বান করা হবে। তা না করে নানা ছলচাতুরির মাধ্যমে যখন পাকিসত্মানের সামরিক জানত্মা অধিবেশন আহ্বানে বিরত থাকে তখন পূর্ব বাংলার সাধারণ জনগণ তো বটেই বঙ্গবন্ধু নিজেও কিছুটা শঙ্কিত হয়ে পড়েন। ৯ ফেব্রম্নয়ারি তিনি এক বিবৃতির মাধ্যমে তার উদ্বেগের কথা প্রকাশ করেন এবং বলেন, এটি মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে জনগণকে তাদের নিজস্ব সরকার গঠন করার সুযোগ হতে বঞ্চিত করার একটি গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি অবিলম্বে সংসদের অধিবেশন আহ্বান করার দাবি জানান। এই দাবির প্রোপটেই অনেকটা বাধ্য হয়ে ইয়াহিয়া খান ১৩ ফেব্রম্নয়ারি ঘোষণা করেন যে, মার্চের তিন তারিখ পাকিসত্মানের সংবিধান রচনা করার জন্য ঢাকায় সংসদের অধিবেশন বসবে। এরপর শুরম্ন হয় ইয়াহিয়া ভুট্টো ষড়যন্ত্র পর্বের এক নতুন অধ্যায় যার প্রোপটে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই ১ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য গণ-পরিষদের সভা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়। এই প্রোপটে অনুষ্ঠিত হয় রমনা রেসকোর্সের সেই ঐতিহাসিক সমাবেশ ও যে সমাবেশ থেকে বঙ্গবন্ধুর দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, 'এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।'
১ মার্চ গণ-পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হয়ে যাওয়ার ঘোষণার পরপরই খুব দ্রম্নততম সময়ে বাংলার বেসামরিক শাসন ব্যবস্থা পুরোপুরি বঙ্গবন্ধুর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এটি ছিল আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা। দেশে একটি কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার বহাল থাকলেও দেশের একটি অংশে সেই সরকারে অস্থিত্ব প্রায় বিলুপ্ত এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই বেসামরিক শাসনকার্য পরিচালিত হচ্ছে। কেমন ছিল সেই সময় তা বর্তমান প্রজন্মকে বোঝানো মোটেও সহজ নয়।
বঙ্গবন্ধু তার দীর্ঘ ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে হয়ত বুঝতে পেরেছিলেন বাংলাদেশের বহু প্রত্যাশিত স্বাধীনতা এখন শুধু সময়ের ব্যাপার এবং তার জন্য এখন দ্রম্নততম সময়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করা প্রয়োজন। কিন্তু বাসত্মবটা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু কোন গোপন বিপস্নবী দলের নেতা নন। তার কাছে তো কোন সৈন্য সামনত্ম নেই। নেই কোন গোলাবারম্নদ অথবা অস্ত্র সরঞ্জাম। প্রতিপ পাকিসত্মানের সামরিক জানত্মা, তাদের নিয়ন্ত্রণে একটি আধুনিক সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে আছে বাঙালী-বিদ্বেষী একটি বেসামরিক আমলা চক্র। তবে বঙ্গবন্ধুর যা আছে তা তো তাদের নেই। বঙ্গবন্ধুর পেছনে আছে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর নৈতিক সমর্থন। বঙ্গবন্ধু ঠিকই জানতেন শুধু সামরিক শক্তি দিয়ে কখনও কোন দেশের মুক্তিসংগ্রাম সফল হয়নি। তিনি ফিরে গেলেন সেই জনগণের কাছে। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে। লাখো জনতার উত্থাল জনসমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে রাখলেন তিনি তার উনিশ মিনিটের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ। ভাষণে কোন কথার ফুলঝুড়ি ছিল না। ছিল না কোন কথার মারপঁ্যাচ। প্রতিটি শব্দ ছিল তী্ন আর সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট। বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণের ঠিক আগের দিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতির উদ্দেশে একটি বেতার ভাষণ দিয়েছিলেন। ভাষণে তিনি তার নেয়া বিভিন্ন কর্মকা-ের প েসাফাই গাওয়ার দুর্বল চেষ্টা করেছিলেন। মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন। বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য সরাসরি বঙ্গবন্ধুকে দায়ী করে তাঁকে প্রচ্ছন্নভাবে হুমকি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, পাকিসত্মানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রার জন্য সামরিক বাহিনী প্রধান হিসেবে তার যা যা করা প্রয়োজন তিনি তাই করবেন। তার ভাষণের কোথাও তিনি ভুট্টোর নামটুকু পর্যনত্ম উলেস্নখ করেননি। পরদিন রেসকোর্সে অনুষ্ঠিতব্য বঙ্গবন্ধুর জনসভাকে সামনে রেখে দেয়া এই ভাষণের মূল উদ্দেশ্য ছিল আসলে বঙ্গবন্ধু তথা বাঙালীদের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করা। ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুকে চিনতে ভুল করেছিলেন। ভয়ভীতি দেখিয়ে অথবা চাপ সৃষ্টি করে যদি বঙ্গন্ধুকে কাবু করা যেত তাহলে তা তিনি ষাটের দশকেই রাজনৈতিক মঞ্চ হতে বিলুপ্ত হয়ে যেতেন। বাসত্মবে ৬ মার্চে দেয়া ইয়াহিয়া খানের ভাষণ বাঙালীকে আরও ঐক্যবদ্ধ করেছিল। বঙ্গন্ধুর সামনে তা এক নতুন চ্যালেঞ্জর জন্ম দিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু তার উনিশ মিনিটের ভাষণে বিরাজমান রাজনৈতিক সঙ্কটের প্রোপট বর্ণনা করতে গিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে। যেখান থেকে সূত্রপাত আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। বলেছেন তিনি চুয়ান্নর নির্বাচনের কথা এবং কীভাবে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বাঙালীকে মতা গ্রহণ করা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল তার কথা। ১৯৬৬ সালের ছয় দফার কথা বলতে তিনি ভুলেননি। বারবার তিনি পশ্চিম পাকিসত্মানের শাসকগোষ্ঠী দ্বারা বাঙালীর অধিকার বঞ্চিত হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। পরিষ্কার ভাষায় তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন এদেশের মানুষ ঠিকই বুঝে যে বাঙালীকে আবারও মতাবঞ্চিত করার জন্য ষড়যন্ত্র হচ্ছে এবং সেই ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে তিনি এবং জনগণ প্রস্তুত।
অনেকে বলে থাকেন তিনি সেদিন ওই রেসকোর্স মাঠেই স্বাধীনতা ঘোষণা দিলেই ভাল করতেন। তা যদি হতো তাহলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়ে যেত একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে জয়যুক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাতে আনত্মর্জাতিক সমর্থন তেমন একটা থাকে না। ১৯৬৫ সালে নাইজেরিয়া হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে বায়েফ্রা নামক একটি নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিলেন ওজুকু। তা ব্যর্থ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যিনি নিজে একজন ইতিহাস সচেতন ব্যক্তি ছিলেন নিশ্চয় সেই ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। বঙ্গবন্ধু একতরফাভাবে সে দিন স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি ঠিক, কিন্তু জনগণকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন এবারের সংগ্রামটা কিসের সংগ্রাম এবং সে সংগ্রামে জয়ী হতে হলে কেমন প্রস্তুতি চাই। তিনি ইয়াহিয়া খানের সামনে অনেকগুলো দাবি উত্থাপন করলেন যা পূরণ করা তার প েসম্ভব ছিল না। বিশেষ করে সামরিক আইন প্রত্যাহার ও জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে মতা হসত্মানত্মর। তারপরও বঙ্গবন্ধু কিন্তু নিশ্চয়তা দিচ্ছেন না তিনি সংসদে অধিবেশনে যাবেন কি যাবেন না। বলছেন বিবেচনা করবেন। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার পুরো দায়িত্বটা তিনি ঠেলে দিয়েছিলেন ইয়াহিয়া খানের কাঁধে। এটি ছিল একজন দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতার পরিস্থিতি মোকবেলায় কৌশল প্রণয়নের এক উজ্জ্বল ও অসামান্য দৃৃষ্টানত্ম। এর পাশাপাশি তিনি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ কী হতে পারে। সেই ঘটনাপ্রবাহ মোকাবেলায় জনগণের করণীয় কী হতে পারে সে সম্পর্কে তিনি পরিষ্কার ভাষায় নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তিনি এও বুঝেছিলেন আসন্ন লড়াই কোন চিরাচরিত লড়াই হবে না। এটি হবে একটি সুসজ্জিত সামরিক বাহিনীর বিরম্নদ্ধে জনগণের যুদ্ধ। তিনি প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার কথা বলেছেন। বলেছেন যার যা কিছু আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাকতে। পূর্বের অভিজ্ঞতা হতে তিনি এটি বুঝতে পেরেছিলেন লড়াই শুরম্ন হলে পাকিসত্মানী জানত্মা তাকে হত্যা অথবা বন্দী করবে। সে মতো অবস্থায় জনগণের করণীয় কী তাও তিনি নির্দেশ করতে ভুলেননি। তিনি একটি অত্যনত্ম গুরম্নত্বপূর্ণ বিষয় সে দিনের বক্তৃতায় উলেস্নখ করেছিলেন। সেটি হচ্ছে নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি প্রিয় শক্তির অনুপ্রবেশ। তিনি বুঝেছিলেন ভেতরে যদি অপশক্তি অনুপ্রবেশ করে তাহলে কোন লড়াইয়ে জয়ী হওয়া যায় না। ল্য অর্জন অসম্ভব। ১৯৭১ এর সে দিনে যা বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন ২০১০ সালেও তা পুরোপুরি সত্য। তিনি দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা- যেন একেবারে স্থবির হয়ে না পরে সে দিকে ল্য রেখে কিছু কিছু নির্দেশ দিয়েছিলেন। উনিশ মিনিটের সেই বক্তৃতা তো শুধু একটা বক্তৃতা ছিল না, এটি ছিল এক মহাকাব্য। রচিত হয়েছিল একটি ইতিহাস। সেই বক্তৃতায় সব পরে জন্যই সংকেত বা মেসেজ ছিল। ইয়াহিয়া খান, পাকিসত্মানের সামরিক বাহিনী, প্রতিপ রাজনৈতিক শক্তি, জুলফিকার আলী ভুট্টো, নিজেদের অভ্যনত্মরের অপশক্তি, দলীয় নেতাকর্মী এবং সর্বোপরি জনগণ, সবার জন্য। এ সময় সারা দুনিয়ার গণমাধ্যমের দৃষ্টিও ছিল বঙ্গবন্ধু এদিন কী বলেন তার দিকে। বিশ্ব নেতৃবৃন্দও নজর রেখেছিলেন। সবাই মোটামুটি সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি প্রচ্ছন্ন ধারণা করতে পেরেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল একটি কালজয়ী ভাষণ। এর পূর্বের দুই শত বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনেক রাজনৈতিক নেতা অনেক বক্তৃৃতা বিবৃতি দিয়েছেন। এদের কোন কোন বক্তৃতার ঐতিহাসিক গুরম্নত্ব অপরিসীম। এখনও এর অনেকগুলো নিয়ে প্রচুর চর্চা হয়, আলোচনা হয়, লেখালেখি হয়। এসবের মাঝে দুটির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের যথেষ্ট মিল পাওয়া যায়। প্রথমটি আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র রচনা করেছিলেন থমাস জেফারসন। জেফারসনকে এখনও গণতন্ত্রের ইতিহাসে একজন প্রবাদ পুরম্নষ হিসেবে দেখা হয়। আমেরিকার ১৩টি কলোনির সঙ্গে গ্রেট ব্রিটেনের এক বছর যুদ্ধচলার পর মোটামুটি এটি পরিষ্কার হয়ে যায় যে কলোনিগুলোর স্বাধীনতা ঘোষণা ছাড়া বিকল্প, নেই। লিখিত হলো সে অসাধারণ দলিল। বিসত্মারিত প্রোপট বর্ণনা করে ব্যাখা করা হয় কেন ১৩টি কলোনি স্বাধীনতা ঘোষণা করছে। ঠিক একইভাবে ১৯৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু 'এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' উচ্চারণ করার পূর্বে পশ্চিম পাকিসত্মানী শাসকগোষ্ঠী কতর্ৃক বাঙালীর শোষণ বঞ্চনার কথা বর্ণনা করেছিলেন। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ষোড়শ প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের বিখ্যাত গেটিসবার্গ বক্তৃতা উলেস্নখযোগ্য। ১৮৬৩ সালের ১৯ নবেম্বর পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের গেটিসবার্গের সেই সভায় মূল বক্তা ছিলেন প্রখ্যাত সিনেটর এবং সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এডওয়ার্ড এবার্ট। তিনি ছিলেন অসাধারণ বক্তা। এ দিনের বক্তৃতা প্রস্তুত করার জন্য সময় পেয়ে ছিলেন চলিস্নশ দিন। সেদিন তিনি দু'ঘণ্টা বক্তৃতা দিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট লিংকনকে সময় দেয়া হয়েছিল সতের দিন। তিনি সর্বমোট ২ মিনিট বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এই ২ মিনিটে তিনি মূলতঃ গণতন্ত্র এবং তা রা করতে স্বদেশবাসীর ত্যাগের (গৃহযুদ্ধে) কথা বলেছিলেন। মানুষের স্বাধীনতার জয়গান গেয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তার উনিশ মিনিটের বক্তৃতায় বাঙালীর নিপীড়নের কথা বলেছিলেন। তাদের বঞ্চনার ইতিহাস শুনিয়ে ছিলেন। তাদের বিরম্নদ্ধে বিরামহীন ষড়যন্ত্রের কথা বলেছিলেন। তাদের গনত্মব্য পেঁৗছানোর স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। পথে সম্ভাব্য প্রতিকূলতা সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। তা সমাধা করে অতিক্রম করার পথ দেখিয়েছিলেন। তিনজনই মানুষের মুক্তির কথা বলেছিলেন। স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন। গণতন্ত্রের কথা বলেছিলেন। নানা কারণে জেফারসন আর লিংকন ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। বঙ্গবন্ধু যে কারণে ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন তা হচ্ছে শত বাধা-বিপত্তি, জাতীয় ও আনত্মর্জাতিক যড়যন্ত্র সব কিছুকে অতিক্রম করে তিনি বিশ্বের মানচিত্রে একটি নতুন জাতি ও রাষ্ট্রের জন্মের নেতৃত্ব দিতে পেরেছিলেন। তিনি একটি জাতির জনক হতে পেরেছিলেন। এটি তার জন্য এক বিরল প্রাপ্তি। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে উনিশ মিনিটে রচিত হয়েছিল একটি ইতিহাস। এর রচয়িতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্মৃতি চিরজীবী হোক। তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।
লেখক : শিক্ষাবিদ

No comments

Powered by Blogger.