অশান্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় by ড. নিয়াজ আহম্মেদ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ-ছাত্রদল সংঘর্ষে আহত ৫০, আটজন আটক। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মসূচি পালন করতে পারেনি দুই পক্ষই। নতুন কমিটির দাবিতে রাবি শাখা ছাত্রলীগের দ্বন্দ্ব চরমে। কলেজশিক্ষক অপহরণে জাবির চার শিক্ষার্থী সাময়িক বহিষ্কার।
চাঁদাবাজদের কারণে বন্ধ হয়ে গেল যবিপ্রবির নির্মাণকাজ। হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়ে গেল ফের শিবির-ছাত্রলীগ সংঘর্ষ। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্য। এগুলো এক দিনের একটি পত্রিকার শিরোনাম। বাংলাদেশের কলুষিত ছাত্ররাজনীতির একটি খণ্ডচিত্র। এ ধরনের শিরোনামের পরিবর্তে যদি শিরোনামগুলো এ রকম হতো, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন ও রাসায়নিক প্রযুক্তি বিভাগে আন্তর্জাতিক কনভেনশন সম্পন্ন হয়েছে, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় সেমিনারে নারীর ক্ষমতায়ন গুরুত্ব পেয়েছে ইত্যাদি- তাহলে আমরা খুব খুশি হতাম। হয়তো এমনটি ঘটে; কিন্তু পত্রিকার পাতায় শিরোনাম হয় না কিংবা পর্যাপ্ত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমার সহকর্মীরা উপরোক্ত ঘটনাগুলোর নেপথ্যের কারণগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না বিধায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নেতিবাচক শিরোনামে মানুষের কাছে ধরা দেয়।
এ মুহূর্তে বাংলাদেশে মোট তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অচল। সেগুলো হলো- বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এবং রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে একটি শিশু মারা গেছে। সংঘর্ষের সূত্রপাত বেশ কয়েক দিন ধরে। ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ আগেও হয়েছে; কিন্তু কর্তৃপক্ষ আগাম কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এমনকি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিও কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। যেটি করেছে তা ঘটনা ঘটার পর। ছাত্রলীগের কমিটি স্থগিত এবং সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বহিষ্কার করা হয়েছে। এর মধ্যেই কি তাদের দায় শেষ? একটি শিশুর মৃত্যুর দাম কি দুজনকে বহিষ্কারের সমান? কোনোক্রমেই তা হতে পারে না। যে শিশুটি মারা গেছে, তার মা-বাবাকে আমরা কী জবাব দেব? আমাদের জবাবের ভাষা জানা নেই। আর এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাকৃবিতে যে ব্যাপক ভাঙচুর হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণই বা কে দেবে।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অচলাবস্থা দীর্ঘদিনের। ধারণা করা হয়েছিল, সরকার নতুন উপাচার্য নিয়োগ দিলে অচলাবস্থার অবসান হবে। কিন্তু সে আশা নিরাশায় পরিণত হলো। ওখানকার শিক্ষকদের দাবি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি বড় প্রশাসনিক পদের পরিবর্তন। সরকার দুটির মধ্যে পরিবর্তন এনেছে। কিন্তু তাতে অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। এরই মধ্যে ছাত্রলীগ কর্তৃক শিক্ষকদের ওপর নগ্ন হামলা আমাদের হতবাক করে দেয় এবং আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়। শিক্ষকসমাজের প্রতি এ ধরনের হামলা নতুন কোনো বিষয় নয়, তবে লজ্জায় আমাদের মাথা কাটা যাচ্ছে। আমরা কোন সমাজে বাস করছি? অবাক হওয়ার কথা যে ছাত্রলীগের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদের ভাষা খুবই ক্ষীণ। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের গ্রেপ্তারের কোনো উদ্যোগ নেই। ফলস্বরূপ একই ধরনের কর্মকাণ্ড বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন কর্তৃক এমন আচরণ প্রত্যক্ষ করা অবান্তর হবে না। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রলীগের কমিটি স্থগিত করা হয়েছে। এখানে ছাত্রদল অনির্দিষ্টকালের জন্য ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা করছি আমরা।
সম্ভবত আশির দশকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় গাজীপুর থেকে কুষ্টিয়ায় স্থানান্তর করা হয়। এর পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি ভালোভাবে চলছে না। সব সরকারের সময় এখানে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করে। উপাচার্যরা তাঁদের মেয়াদ শেষ করার আগেই বিদায় নেন। রাজধানী এবং কুষ্টিয়া শহর থেকে দূরে হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়টি ক্রমে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে। কেননা মফস্বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর স্থানীয়দের একটি গৌণ প্রভাব থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকে না কোনো বাউন্ডারি। ফলে সংঘর্ষ তৈরি হওয়াটা হয় সহজ। এ রকম পরিস্থিতিতে সরকারকে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ভেবে দেখতে হবে যে মফস্বল শহরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা সঠিক হবে কি না।
আন্দোলন-সংগ্রাম আমাদের দীর্ঘদিনের। আন্দোলন করেই সব কিছু অর্জন করতে হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলন একমাত্র উপাচার্যদের পদত্যাগকে ঘিরে। উপাচার্য পদত্যাগের আন্দোলন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা অন্য একটিকে উৎসাহিত করে। যেমন জাবি উপাচার্যের অপসারণের ফলে বুয়েট উৎসাহিত হয়েছে। বুয়েটের পর ইসলামী এবং বর্তমানে রোকেয়ায় গিয়ে ঠেকেছে। আমার বিশ্বাস, রোকেয়া সফল হলে আবার আরেকটিতে আন্দোলন শুরু হবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ছাত্রদের একাডেমিক উন্নয়নের জন্য কোনো আন্দোলন করতে দেখা যায় না। পৃথক বেতন কাঠামোর দাবি দীর্ঘদিনের; কিন্তু এর জন্য আজ পর্যন্ত এক দিনও কর্মবিরতি পালন করেননি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য সুযোগ-সুবিধা সীমিত। এর জন্য তাঁদের কোনো আন্দোলন নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ ও শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতির সংস্কার নিয়ে তাঁদের কথা বলতে শোনা যায় না। এ দুটোর ক্ষেত্রে পরিবর্তন এলে এমনিতেই সব কিছু বন্ধ হয়ে যায়। না করার কারণ হলো, শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। গাছের গোড়ায় পানি না দিয়ে আগায় পানি দিলে যেমন ফল পাওয়া যায় না, তেমনি আমার সহকর্মীরা মৌলিক পরিবর্তন চাওয়ার পরিবর্তে উপাচার্য অপসারণের প্রতি বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন। আর দু-একটি বাম ছাত্রসংগঠন বাদে বাকি ছাত্রসংগঠন ছাত্রস্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো কাজে নেই। একমাত্র কাজ নিজেদের পদবি ব্যবহার করে চাঁদাবাজি ও ঠিকাদারি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা।
বুয়েটের শিক্ষকরা উপ-উপাচাযের্র অপসারণের পর ক্লাসে ফিরে গিয়েছিলেন। কিন্তু কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রটি ভিন্ন। এখানে শিক্ষকরা গোঁ ধরে বসে আছেন। যতক্ষণ পর্যন্ত না কোষাধ্যক্ষকে অপসারণ করা না হবে, ততক্ষণ তাঁরা শ্রেণীকক্ষে ফিরে যাবেন না। আমি ব্যক্তিগতভাবে এটিকে গোঁড়ামি মনে করি। পাশাপাশি এক ধরনের ভিন্ন গন্ধও খুঁজে পাচ্ছি। অনেকেরই হয়তো খায়েশ ছিল উপাচার্য হওয়ার। যখন তাঁদের খায়েশ পূরণ হয়নি, তখন নিজেরাই আন্দোলন জিইয়ে রেখেছেন। নইলে আজও কেন তাঁরা ক্লাসে ফিরে যাচ্ছেন না। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়টি খুব বড় নয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, বিশেষ করে প্রক্টর ও ছাত্রকল্যাণ উপদেষ্টা কঠোর হলে পূর্বোক্ত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো এড়ানো সম্ভব ছিল। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের মধ্যেও রয়েছে অনেক গ্রুপ। কিন্তু এখানকার প্রশাসন এদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে গত ছয় বছরে বিশ্ববিদ্যালয়টি বড় কোনো সংকটে পতিত হয়নি। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের উচিত ব্যক্তিগত স্বার্থ, লোভ-লালসার ঊধর্ে্ব উঠে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কথা চিন্তা করে বিশ্ববিদ্যালয়কে সচল রাখা। আমরা আরো আশা করব, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাঁদের পারস্পরিক ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে শুধু ছাত্রদের কথা চিন্তা করে অচিরেই ক্লাসে ফিরে যাবেন। পাশাপাশি তাঁদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। সবশেষে ছাত্রলীগ প্রসঙ্গ। তাদের কর্মকাণ্ড নতুন নয়। বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের খারাপ কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো ফল দেয়নি। তাদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে শিক্ষা খাতে সরকারের ভালো ভালো অর্জন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শুধু কমিটি বিলুপ্ত কিংবা বহিষ্কার নয়, কঠোরহস্তে দমন এবং আত্মশুদ্ধি একমাত্র সমাধান।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
neazahmed_2002@yahoo.com
এ মুহূর্তে বাংলাদেশে মোট তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অচল। সেগুলো হলো- বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এবং রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে একটি শিশু মারা গেছে। সংঘর্ষের সূত্রপাত বেশ কয়েক দিন ধরে। ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ আগেও হয়েছে; কিন্তু কর্তৃপক্ষ আগাম কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এমনকি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিও কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। যেটি করেছে তা ঘটনা ঘটার পর। ছাত্রলীগের কমিটি স্থগিত এবং সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বহিষ্কার করা হয়েছে। এর মধ্যেই কি তাদের দায় শেষ? একটি শিশুর মৃত্যুর দাম কি দুজনকে বহিষ্কারের সমান? কোনোক্রমেই তা হতে পারে না। যে শিশুটি মারা গেছে, তার মা-বাবাকে আমরা কী জবাব দেব? আমাদের জবাবের ভাষা জানা নেই। আর এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাকৃবিতে যে ব্যাপক ভাঙচুর হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণই বা কে দেবে।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অচলাবস্থা দীর্ঘদিনের। ধারণা করা হয়েছিল, সরকার নতুন উপাচার্য নিয়োগ দিলে অচলাবস্থার অবসান হবে। কিন্তু সে আশা নিরাশায় পরিণত হলো। ওখানকার শিক্ষকদের দাবি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি বড় প্রশাসনিক পদের পরিবর্তন। সরকার দুটির মধ্যে পরিবর্তন এনেছে। কিন্তু তাতে অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। এরই মধ্যে ছাত্রলীগ কর্তৃক শিক্ষকদের ওপর নগ্ন হামলা আমাদের হতবাক করে দেয় এবং আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়। শিক্ষকসমাজের প্রতি এ ধরনের হামলা নতুন কোনো বিষয় নয়, তবে লজ্জায় আমাদের মাথা কাটা যাচ্ছে। আমরা কোন সমাজে বাস করছি? অবাক হওয়ার কথা যে ছাত্রলীগের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদের ভাষা খুবই ক্ষীণ। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের গ্রেপ্তারের কোনো উদ্যোগ নেই। ফলস্বরূপ একই ধরনের কর্মকাণ্ড বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন কর্তৃক এমন আচরণ প্রত্যক্ষ করা অবান্তর হবে না। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রলীগের কমিটি স্থগিত করা হয়েছে। এখানে ছাত্রদল অনির্দিষ্টকালের জন্য ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা করছি আমরা।
সম্ভবত আশির দশকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় গাজীপুর থেকে কুষ্টিয়ায় স্থানান্তর করা হয়। এর পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি ভালোভাবে চলছে না। সব সরকারের সময় এখানে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করে। উপাচার্যরা তাঁদের মেয়াদ শেষ করার আগেই বিদায় নেন। রাজধানী এবং কুষ্টিয়া শহর থেকে দূরে হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়টি ক্রমে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে। কেননা মফস্বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর স্থানীয়দের একটি গৌণ প্রভাব থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকে না কোনো বাউন্ডারি। ফলে সংঘর্ষ তৈরি হওয়াটা হয় সহজ। এ রকম পরিস্থিতিতে সরকারকে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ভেবে দেখতে হবে যে মফস্বল শহরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা সঠিক হবে কি না।
আন্দোলন-সংগ্রাম আমাদের দীর্ঘদিনের। আন্দোলন করেই সব কিছু অর্জন করতে হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলন একমাত্র উপাচার্যদের পদত্যাগকে ঘিরে। উপাচার্য পদত্যাগের আন্দোলন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা অন্য একটিকে উৎসাহিত করে। যেমন জাবি উপাচার্যের অপসারণের ফলে বুয়েট উৎসাহিত হয়েছে। বুয়েটের পর ইসলামী এবং বর্তমানে রোকেয়ায় গিয়ে ঠেকেছে। আমার বিশ্বাস, রোকেয়া সফল হলে আবার আরেকটিতে আন্দোলন শুরু হবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ছাত্রদের একাডেমিক উন্নয়নের জন্য কোনো আন্দোলন করতে দেখা যায় না। পৃথক বেতন কাঠামোর দাবি দীর্ঘদিনের; কিন্তু এর জন্য আজ পর্যন্ত এক দিনও কর্মবিরতি পালন করেননি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য সুযোগ-সুবিধা সীমিত। এর জন্য তাঁদের কোনো আন্দোলন নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ ও শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতির সংস্কার নিয়ে তাঁদের কথা বলতে শোনা যায় না। এ দুটোর ক্ষেত্রে পরিবর্তন এলে এমনিতেই সব কিছু বন্ধ হয়ে যায়। না করার কারণ হলো, শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। গাছের গোড়ায় পানি না দিয়ে আগায় পানি দিলে যেমন ফল পাওয়া যায় না, তেমনি আমার সহকর্মীরা মৌলিক পরিবর্তন চাওয়ার পরিবর্তে উপাচার্য অপসারণের প্রতি বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন। আর দু-একটি বাম ছাত্রসংগঠন বাদে বাকি ছাত্রসংগঠন ছাত্রস্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো কাজে নেই। একমাত্র কাজ নিজেদের পদবি ব্যবহার করে চাঁদাবাজি ও ঠিকাদারি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা।
বুয়েটের শিক্ষকরা উপ-উপাচাযের্র অপসারণের পর ক্লাসে ফিরে গিয়েছিলেন। কিন্তু কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রটি ভিন্ন। এখানে শিক্ষকরা গোঁ ধরে বসে আছেন। যতক্ষণ পর্যন্ত না কোষাধ্যক্ষকে অপসারণ করা না হবে, ততক্ষণ তাঁরা শ্রেণীকক্ষে ফিরে যাবেন না। আমি ব্যক্তিগতভাবে এটিকে গোঁড়ামি মনে করি। পাশাপাশি এক ধরনের ভিন্ন গন্ধও খুঁজে পাচ্ছি। অনেকেরই হয়তো খায়েশ ছিল উপাচার্য হওয়ার। যখন তাঁদের খায়েশ পূরণ হয়নি, তখন নিজেরাই আন্দোলন জিইয়ে রেখেছেন। নইলে আজও কেন তাঁরা ক্লাসে ফিরে যাচ্ছেন না। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়টি খুব বড় নয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, বিশেষ করে প্রক্টর ও ছাত্রকল্যাণ উপদেষ্টা কঠোর হলে পূর্বোক্ত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো এড়ানো সম্ভব ছিল। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের মধ্যেও রয়েছে অনেক গ্রুপ। কিন্তু এখানকার প্রশাসন এদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে গত ছয় বছরে বিশ্ববিদ্যালয়টি বড় কোনো সংকটে পতিত হয়নি। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের উচিত ব্যক্তিগত স্বার্থ, লোভ-লালসার ঊধর্ে্ব উঠে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কথা চিন্তা করে বিশ্ববিদ্যালয়কে সচল রাখা। আমরা আরো আশা করব, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাঁদের পারস্পরিক ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে শুধু ছাত্রদের কথা চিন্তা করে অচিরেই ক্লাসে ফিরে যাবেন। পাশাপাশি তাঁদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। সবশেষে ছাত্রলীগ প্রসঙ্গ। তাদের কর্মকাণ্ড নতুন নয়। বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের খারাপ কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো ফল দেয়নি। তাদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে শিক্ষা খাতে সরকারের ভালো ভালো অর্জন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শুধু কমিটি বিলুপ্ত কিংবা বহিষ্কার নয়, কঠোরহস্তে দমন এবং আত্মশুদ্ধি একমাত্র সমাধান।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
neazahmed_2002@yahoo.com
No comments