বহে কাল নিরবধি-বহুরূপী বর্ণচোরা ধর্মব্যবসায়ীরা by এম আবদুল হাফিজ

২০০৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের এক আলোচনা সভায় মূল নিবন্ধের তিনজন আলোচকের অন্যতমরূপে আমি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। আওয়ামী লীগ-সংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ে আমি আমার অনুজপ্রতিম জেনারেল মুস্তাফিজের সঙ্গে পরামর্শ করতাম।
তিনি তখনো বেঁচে ছিলেন। আমার ধারণা ছিল, তিনিও অনুষ্ঠানটিতে যাবেন। আমি তখন বারিধারায় বসবাস করি। মহাখালীর ডিওএইচএসএ যখন মুস্তাফিজের সঙ্গে কথা বলতে গেলাম, তিনি আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, তিনি ওই অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন না। কিন্তু আমাকে ওই অনুষ্ঠানে যেতে খুব উৎসাহিতই শুধু করলেন না, তিনি তাঁর ব্যক্তিগত কারটিও আমার অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য দেওয়ার প্রস্তাব করলেন। অনুষ্ঠানস্থলে গিয়ে আমার চোখ ছানাবড়া। মিলনায়তনটি এরই মধ্যে কানায় কানায় পরিপূর্ণ, ইনস্টিটিউশন প্রাঙ্গণেও উপচে পড়া ভিড়। ভেতরে ঢুকে দেখলাম, প্রধান অতিথি শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্ট সবাই মঞ্চে উপবিষ্ট। একটি আসনই খালি দেখে সেটা আমার ভেবে সেখানে বসে পড়লাম। একটু পরেই মাগরিবের আজান হলো। আমার তাৎক্ষণিক ভাবনা যে কোথায় কিভাবে নামাজ পড়ব। কোনো অবস্থায়ই জ্ঞান থাকা অবস্থায় আমি নামাজ কাজা করি না। একবার মিউনিখ সফরকালে আমাকে নৈশভোজে নিমন্ত্রণকারী এক জার্মানকে হকচকিত করে রেস্তোরাঁর সামনেই রোড আইল্যান্ডে মাগরিবের নামাজ আদায় করেছিলাম। ওইসব দেশে আবার সূর্যাস্তের আগেই ডিনার, যা মাগরিবের নামাজের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
যাহোক, আমাকে আসন থেকে উঠতে দেখে আয়োজকদের কেউ হয়তো বুঝলেন যে আমি নামাজ পড়ব। কোনো বাক্য ব্যয় না করে তাঁরা আমাকে মঞ্চের পেছনে নিয়ে গেলেন এবং আমার সামনে জায়নামাজ বিছিয়ে দিলেন। আমি নির্বিঘ্নে নামাজ সমাধা করে আসনে ফেরার সময় নামাজের এমন সুন্দর ব্যবস্থার কথা জানতে চাইলে একজন শুধু বললেন, আপার জন্য (সম্ভবত শেখ হসিনা) সব সময়ই এসব ব্যবস্থা থাকে। অতঃপর যথারীতি আমার ভূমিকা সম্পাদনসহ অনুষ্ঠান সমাপ্ত হলো। ইসলামের ধর্মীয় আচারগুলো এত সহজ ও সুন্দর যে কোথাও ব্যবহারিক জীবনের সঙ্গে এর কোনো সংঘাত নেই।
এর বিপরীতে আমাদের এক শ্রেণীর ধর্মীয় যাজক ধর্মকে জীবনের সঙ্গে অযথা সাংঘর্ষিক করে রেখেছে। বছরদশেক আগে আমার বাসস্থান এলাকার মসজিদে কার বা কাদের আমন্ত্রণে আজকের বহুল আলোচিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত পলাতক বাচ্চু রাজাকার ওরফে মাওলানা আযাদ এসেছিলেন। তাঁর অভ্যর্থনার আনুষ্ঠানিকতা দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। শুধু তা-ই নয়, অনেক মসজিদেই আমি তাঁকে তথাকথিত তাফসির করতে দেখেছি; কিন্তু কখনো বুঝিনি যে তিনি এত জঘন্য মানবতাবিরোধী অপরাধী।
এই সেদিন পর্যন্ত তিনি এনটিভি চ্যানেলে নিয়মিত ধর্মীয় অনুষ্ঠান করতেন। অবাক লাগে, কেউ তখনো তাঁর পেছনের ইতিহাস কী জানত না! আমার পুরনো কর্মস্থলে এক সময় কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে ডায়ালগ অব দ্য ফেইথসের সেমিনারগুলোতে মাওলানা আযাদ একজন সম্মানিত অংশগ্রহণকারী ছিলেন। কিন্তু তিনি তো তাঁর মানবতাবিরোধী অপরাধগুলো আরো অনেক আগে করেছিলেন। তা সত্ত্বেও কেন তিনি এত দাপটের সঙ্গে সমাজের উঁচুস্তরে একজন সম্মানিত ধর্মীয় যাজক হিসেবে সমাদৃত হয়েই চলেছিলেন? কোথায় ছিল তাঁর শক্তির উৎস?
তিনি যদি এত জঘন্য অপরাধী হন, যা এখন প্রমাণিত হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডাদেশও হলো, নজরদারি সত্ত্বেও তিনি 'ট্রেডমার্ক' চেহারা নিয়ে কিভাবে উধাও হলেন তা আরেক রহস্য, আরেক ব্যর্থতা।
ইসলাম একটি মানবতাবাদী সহজ ধর্ম, যা মাঠে-ঘাটে, জনারণ্যে বা ভ্রমণে সহজে পালন করা যায়। একে জটিল আনুষ্ঠানিকতার নিগড়ে শৃঙ্খলিত করে ধর্মব্যবসায়ীরা ফায়দা ওঠাতে চায়। সেই উদ্দেশ্যে তারা একেক সময় একেক রূপ ধারণ করে, একেক কৌশলের আশ্রয় নেয়। জানি না, মাওলানা আযাদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষ্যমতে যদি আরেক দেশে আশ্রয় নিয়ে থাকেন, সেখান থেকে নানা প্রতিবন্ধকতার জাল ছিন্ন করে তাঁকে ফিরিয়ে এনে কি তাঁর শাস্তি কার্যকর করা যাবে? আমরা কিন্তু বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ঠাঁই-ঠিকানা জানা সত্ত্বেও তাদের কয়েকজনকে এখনো শাস্তি প্রদানের জন্য ফিরিয়ে আনতে পারিনি। এর চেয়ে কি প্রশাসনের জন্য এটাই উত্তম হতো না যে মাওলানা আযাদ যেন নজরদারির জাল ছিন্ন করে পালাতে না পারে।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস

No comments

Powered by Blogger.