পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় শীর্ষ পর্যায়ে উদ্বেগ by এ এম এম শওকত আলী

মানবতাবিরোধী অপরাধীদের মুক্তির দাবিতে গত নভেম্বর মাস থেকেই জামায়াত-শিবির আচমকা আক্রমণসহ ভাঙচুর চালিয়ে যাচ্ছে। নভেম্বর থেকেই এ বিষয়ে মিডিয়া কিছু মন্তব্য করেছে, যার মধ্যে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা অন্যতম। এ যুক্তির পক্ষে কিছু বাস্তব চিত্রও ছাপানো হয়েছে।
ওই সময় এর কারণ হিসেবে সরকারের শেষ বছরকেই একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করা যায় না। সরকারি কর্মকর্তারা এ ধরনের সময়ে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করেন, যাতে পরবর্তী আমলে ভিন্ন দল ক্ষমতা গ্রহণ করলে যেন কোনো অসুবিধা না হয়। এর মূল কারণ কোনো বিশেষ ক্ষমতাসীন দলের প্রতি আনুগত্যের যেন কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ না থাকে। ১৯৯১ সাল-পরবর্তী সময়ে ক্ষমতাসীন সব দলই সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে প্রশ্নাতীত আনুগত্যের বিষয়টিকেই প্রাধান্য দিয়েছে। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় দলীয়করণের অভিযোগও হয়েছে প্রচুর। প্রশ্নাতীত আনুগত্যকে চাকরিতে উন্নতির প্রধান মাপকাঠি হিসেবে ক্ষমতাসীন সব দলই প্রাধান্য দিয়েছে। যার মধ্যে আনুগত্যের অভাব চিহ্নিত করা হয়েছে, তারই হয়েছে বিপদ। এর জ্বলন্ত প্রমাণ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সচিব থেকে সহকারী সচিব পর্যায়ের এবং বিভাগীয় কর্মকর্তারাও বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) অথবা অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ পদে বদলি হয়েছেন। সম্প্রতি ওএসডির পরিসংখ্যান এবং এর জন্য সরকারের ক্ষতির হিসাবও পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়। জানা যায়, বিষয়টি বর্তমানে হাইকোর্টের বিবেচনাধীন। দক্ষতা ও কাজের প্রতি যত্নশীলতা বিসর্জন দিলে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। অথচ এ সমস্যা নিরসনে কোনো ক্ষমতাসীন দলই গুরুত্ব দিচ্ছে না। বর্তমান বা ভবিষ্যতেও দেবে কি না তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
এ ছাড়া সরকারের সব বিভাগেই নিয়োগ বাণিজ্যের বহু ঘটনা মিডিয়ায় সব সময়ই প্রকাশ করা হয়। প্রাথমিক নিয়োগেই যদি গলদ থাকে তাহলে নিষ্ক্রিয়তা হবেই। নবনিযুক্ত চাকরিজীবীদের মধ্যে নিজেদের চাকরি রক্ষার জন্য দৃঢ়তা ও প্রত্যয়ের অভাব দেখা দেবে।
পুলিশ তথা সরকারি কর্মকর্তাদের নিষ্ক্রিয়তা বা অদক্ষতা যে কারণই বলা হোক না কেন, তাতে সম্পূর্ণভাবে অভাব থাকবে। জানুয়ারি মাসের সর্বশেষ তাণ্ডবলীলা ছিল ব্যাপক ও সুপরিকল্পিত। জামায়াত-শিবিরের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের আশঙ্কা সম্পর্কে অতীতে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ স্পষ্ট তথ্য প্রকাশ করেছে। এ কথাও বলেছিল, এ বিষয়ে তারা সজাগ। পরবর্তী সময়ে দাবি করা হয়, জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের গোপন অবস্থানও এ বিভাগ জানে। স্মরণ করা যেতে পারে, ৫ নভেম্বর জামায়াত-শিবির দেশের ১১টি জেলায় পুলিশের ওপর বেপরোয়া আক্রমণসহ গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এর ফলে পুলিশসহ প্রায় ২০০ ব্যক্তি আহত হয়। জানুয়ারি মাসের ঘটনায় ২০০ যানবাহনের ক্ষতি সাধন করা হয়। ঢাকাসহ অন্য কয়েকটি জেলায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। পূর্ববর্তী ঘটনাপ্রবাহের সময় অনেকেই মনে করেছিল, অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও শীর্ষ নেতাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের জন্য জামায়াত দুর্বল হয়ে গেছে, থেমে গেছে দলটির সাংগঠনিক ক্ষমতা। নভেম্বর-পরবর্তী ঘটনাবলি প্রমাণ করে, এ ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। পুলিশ কয়েক হাজার জামায়াত-শিবিরের কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। জানুয়ারির ঘটনায় এর সংখ্যা পাঁচ হাজার। জামায়াত-শিবিরের নেতারা মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য বর্তমানে কারাবাস করছেন। বিচার শুরুও হয়েছে। এর মধ্যে একজন পলাতক আসামি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতও হয়েছে। এত সবের পরও এ মহলের তাণ্ডবলীলা কিছুদিন পরপরই কেন হচ্ছে সে বিষয়টি সবারই ভেবে দেখা দরকার।
জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবলীলার সূত্র ধরে এখন দুই ধরনের বিতর্ক চলমান। এক, জামায়াতকে নিষিদ্ধ দল হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। এ বিষয়ে সরকারের কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে ৩০ নভেম্বরের একটি পত্রিকার খবর অনুযায়ী, ক্ষমতাসীন দলের একজন মুখপাত্র বলেছেন, জনগণ চাইলে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা যায়। এ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন। তিনি আশা করেন, এ বিষয়ে জনগণের সমর্থন পাওয়া যাবে। অর্থাৎ সমর্থন পাওয়া গেলে সরকার নিষিদ্ধকরণের প্রস্তাব বাস্তবায়ন করবে। এ বিষয়ে যে কথা বলা হয়নি, তা হলো, জনমত নির্ধারণের মাধ্যম কী? অবশ্য এ কথাও সত্য, নিষিদ্ধকরণের বিষয়ে সরকারবহির্ভূত অনেক মহলই সোচ্চার। সরকার কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করা পর্যন্ত কিছু বলা যাবে না। তবে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার বিষয়টি নিঃসন্দেহে জটিল। মূল কথা, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল অসাংবিধানিক কি না, তা বিবেচনায় আনতে হবে।
পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার বিষয়ে পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তাদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। প্রকাশিত খবর এ বিষয়টিই প্রমাণ করে। উদাহরণ হলো- এক. আইজিপির মতে, পুলিশ পেশাদারির সঙ্গে কাজ করছে; দুই. নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু কর্মকর্তা বলেছেন, মাঠ পর্যায়ে কেউ কারো কথা শুনছে না, অর্থাৎ চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে এবং তিন. সংসদীয় কমিটির সভায় জামায়াত-শিবিরের বিষয়ে আগাম কোনো তথ্য ছিল কি না এ প্রশ্নের কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। পুলিশের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা এ বিষয়ে নীরব ছিলেন। তবে তিনি বলেছেন, জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা তাদের স্বাভাবিক পোশাক বদলিয়েছে; যার কারণে তাদের শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।
বক্তব্য একাধিক কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। শনাক্ত যদি না করা যায় তাহলে হাজার হাজার ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা রুজু করার যৌক্তিকতার বিষয়টি কি উপেক্ষিত? এ ধরনের অভিযোগে দোষী প্রমাণ করা সম্ভব হবে না। অন্যদিকে তাঁর বক্তব্যের সত্যতাও রয়েছে। টিভি মিডিয়ায়ই বিষয়টি ছিল দৃশ্যমান। শনাক্ত করা সম্ভব না হলে এত ব্যক্তি নতুন বেশে আক্রমণের অভিযান কিভাবে করল? সবাই যদি জামায়াত-শিবিরকর্মী না হয়, তাহলে তারা অন্য দলের, না বিক্ষুব্ধ জনতার অংশ, নাকি নিছক লুটপাটের ইচ্ছায় তারা এ ধ্বংসযজ্ঞে শরিক হয়েছে? গোয়েন্দাদের ব্যর্থতা নিয়েও চলমান বিতর্কে সরকারি নীতিনির্ধারকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। প্রকাশিত তথ্যেই বিষয়টি পাওয়া যায়। একজন সিনিয়র নীতিনির্ধারক গোয়েন্দাদের ব্যর্থতার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। অন্যজন বলেছেন, মামলা রুজু করার বিষয়টিই প্রমাণ করে যে গোয়েন্দারা ব্যর্থ নন। অনেকেই মনে করে, আগাম তথ্য সঠিক হলে তাদের পূর্বাহ্নেই গ্রেপ্তার করা সম্ভব ছিল। যেকোনো চোরাগোপ্তা হামলা সফল করার জন্য পূর্বপ্রস্তুতি অপরিহার্য। এ প্রস্তুতি জামায়াতের ছিল, যা গোয়েন্দারা বহু আগেই বলেছিলেন। তবে এর প্রতিকারমূলক কোনো প্রস্তুতি ছিল কি না তা এখনো অজানা। বাস্তবতা হলো, নভেম্বর থেকেই এ ধরনের অতর্কিত হামলা সময় সময় চলছে। কৌশল যেন গেরিলা আক্রমণের মতো, যা সহজে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। এ কথা পুলিশের কিছু কর্তাব্যক্তি স্বীকার করেছেন।
অতীতের মতো আন্দোলনকারীদের কৌশলের একটি বিশেষ দিক ছিল। আন্দোলনের পরদিন হরতাল। সাম্প্রতিক অতীতের প্রথম পর্যায়ের ঘটনার পরও হরতাল হয়। গত বৃহস্পতিবারের হরতালের কারণে অন্তত তিনজন নিহত হয়। ঢাকাসহ সারা দেশে ৬৭টি যানবাহন ভাঙচুর ও ১৩টিতে আগুন দেওয়া হয়। নিহতের সংখা ও কারণ নিয়েও মতভেদ রয়েছে। অতীতে কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছিলেন, জামায়াত লাশ দেখতে চায়। বৃহস্পতিবার সেটাই হয়েছে। চলমান আন্দোলনের ভিন্নধর্মী বিশেষ কৌশল হলো- এক. জেলা পর্যায়ের ও বড় মহানগরীর হরতালের সময়সূচির তারতম্য। এর সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা এখনো পাওয়া যায়নি। অতীতে বড় মহানগরীর হরতালের ব্যাপকতা ও সংঘর্ষ সাধারণত তীব্র হতো। বর্তমান সময়ে জেলা শহরে সংঘর্ষের মাত্রা অধিকতর, এমনকি উপজেলা পর্যায়েও। বগুড়া ও যশোর এর মধ্যে অন্যতম।
বৃহস্পতিবারের হরতালের আগে রাজপথে অতর্কিত হামলার সময় প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ও মুক্তি পায়নি। জানা মতে, সচিবালয়ে যাওয়ার প্রধান সড়ক অর্থাৎ আবদুল গণি রোডে মিছিল বা সভা-সমাবেশ সব সময়ের জন্য নিষিদ্ধ। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ পথে আন্দোলনকারীরা মিছিল করেছে। পুলিশের কোনো বাধার সম্মুখীন হয়নি। এ ঘটনার কয়েক মিনিট আগে প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ে প্রবেশ করেন। প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময়সূচি গোপনভাবে গোয়েন্দারা সংরক্ষণ করেন, যাতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটিও এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। চলমান বিতর্কের অন্য একটি বিষয় হলো, আন্দোলনকারীদের আসল পরিচয়। কালের কণ্ঠে ৩০ জানুয়ারি একটি চমকপ্রদ সংবাদ প্রকাশ করা হয় হামলায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে- 'গ্রেপ্তার জামায়াত-শিবিরকর্মী আওয়ামী সনদে মুক্তি'। একই সঙ্গে এও বলা হয়েছে, এর আগেও গ্রেপ্তারকৃতদের বেশির ভাগই জামিনে।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.