একটি অভিশংসন একটি অবিচার! মূল : ফ্রান্সেস হ্যারিসন অনুবাদ : by মুস্তাফা মাসুদ

শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসে দেশটির সুপ্রীমকোর্টের প্রধান বিচারপতি ড. শিরানী বন্দরনায়েকেকে (পুরো নাম : উপাতিসা আতাপাত্তু বন্দরনায়েকে ওয়াসালা মুদ্যিয়ানসি রালাহামিলেজ শিরানী অংশুমালা বন্দরনায়েকে, জন্ম : ১৯৫৮) গত ১৪ জানুয়ারি অপসারণ করে তার স্থলে মোহন পেইরিসকে নিয়োগ দিয়েছেন।
এর আগে ১১ জানুয়ারি শিরানী কথিত দুর্নীতির অভিযোগে পার্লামেন্টে ‘ইমপিচমেন্ট’ বা অভিশংসনের শিকার হন এবং প্রেসিডেন্ট সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে তাকে সর্বোচ্চ বিচারালয়ের শীর্ষপদ থেকে সরিয়ে দেন; যদিও পদচ্যুত প্রধান বিচারপতি তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছেন। শিরানী বন্দরনায়েকের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা বা অভিশংসন এবং তাকে বরখাস্তের খবরটি আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রকাশিত, প্রচারিত হয়েছে, যা বিশ্ববাসী হতাশা ও উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেছে। তিনি অভিশংসিত হয়েছেন কথিত দুর্নীতির অভিযোগে। তিনি দুর্নীতির দায়ে প্রকৃতপক্ষে দোষী কিনা, সে বিষয়ে মিডিয়ার কোন কোন প্রতিবেদনে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, নানা মন্তব্য করা হয়েছে। তার অভিশংসনের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
কিন্তু পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন, আসল রহস্য অন্যত্র। শ্রীলঙ্কার প্রথম নারী প্রধান বিচারপতি হিসেবে শিরানীকে নিয়োগ দেন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে, ২০১১ সালের ১৭ মে তারিখে। আইন বিষয়ে কৃতিত্বপূর্ণ রেকর্ডের অধিকারী শিরানী বন্দরনায়েকে আইন পেশায় জড়িত না হয়ে কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের অধ্যাপক হিসেবে মেধা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখেন। তিনি ১৯৮৩ সালে কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. ফিল ডিগ্রী এবং সে বছরই Commonwealth Open Scholarship Ges Chevening Scholarship এবং ঈযবাবহরহম ঝপযড়ষধৎংযরঢ় লাভ করেন। একই বছর তিনি অ্যাটর্নি বা আইনজীবীর সনদ পান। ১৯৮৬ সালে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। উল্লেখ্য, শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে তিনিই প্রথম নারী, যিনি বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রী পাওয়ার বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেন। ১৯৮৭ সালে তিনি কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগীয় প্রধান হন। এছাড়া ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে মর্যাদাপূর্ণ British Council Assert Award Ges এবং ১৯৯৬ সালে Fulbright-Hays Fellowship লাভ করেন ড. বন্দরনায়েকে। সেই অধ্যাপক-আইনবিদকে ২০১১ সালে যখন দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের শীর্ষপদে বসানো হলো ৪৩তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে, তখন তার নিয়োগের ব্যাপারে অনেক সমালোচনা হলেও প্রেসিডেন্ট রাজা পাকসে সেসব সমালোচনায় কর্ণপাত করেননি। অথচ মাত্র এক বছর আট মাসের মাথায় সেই প্রধান বিচারপতিকেই তিনি বরখাস্ত করার মতো কঠোর পদক্ষেপটি নিলেন! সরকারী পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হয়েছে পার্লামেন্ট অনাস্থা আনায় প্রেসিডেন্টের আর কিছু করার ছিল না।
প্রধান বিচারপতিকে অভিশংসন ও বরখাস্তের যে ঘটনাটি ঘটেছে, তা শ্রীলঙ্কার আইনের শাসনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে পাশ্চাত্যের নামীদামী পত্রপত্রিকা মন্তব্য করেছে। বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণের আলোকে এখানে একটি প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দেয়, তা হলো দেশের রাজনীতিবিদরা সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত গ্রাহ্য করবেন কি না। যদি তারা তা না করেন; বরং উল্টো আইনের টুঁটি টিপে ধরতে চান তা হলে ভবিষ্যতে ভাল কিছুর আশা করা বৃথা। অথচ প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের দিকে তাকালে দেখা যায়, সুপ্রীমকোর্টের প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরী দেশের বাঘা বাঘা রাজনৈতিক নেতাদের রীতিমতো নাকানি-চুবানি খাইয়ে ছাড়ছেন। তার রায়ের ফলে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানীকে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী রাজা পারভেজ আশরাফের অবস্থাও ত্রাহি ত্রাহি। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে প্রধান বিচারপতি গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেছেন। পাকিস্তানে অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে অস্থিরতা-সহিংসতা-ব্যর্থতা থাকলেও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যে সেখানে সুদৃঢ় ও সমুন্নত, প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরী তার প্রমাণ রেখেছেন।
কিন্তু শ্রীলঙ্কার প্রধান বিচারপতি শিরানী বন্দরনায়েকে ইফতিখার মোহাম্মদের মতো বিপ্লবাত্মক নন। তিনি আপদমস্তক একাডেমিক; আইনের প্রতি একনিষ্ঠ, একজন পুরোদস্তুর বিচারক। আইনের ব্যাখ্যা এবং আইনের প্রতি তার অবিচল দৃঢ়তা ক্ষমতাসীন পরিবারের ক্রমবর্ধমান প্রভাব-প্রতিপত্তির সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল বলে জানা যায়। অভিযোগ রয়েছে, প্রেসিডেন্ট তার ক্ষমতাকে স্থায়ী করার অনুকূলে আইন প্রণয়নের চেষ্টা করছিলেন। তার পরিবারের লোকজন প্রশাসনের সর্বময় কর্তৃত্ব কুক্ষিগত করে রেখেছেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধান এবং পার্লামেন্টের স্পিকারের পদসহ দেশের অনেক বড় বড় সরকারি পদ তারা দখল করে আছেন। রাজা পাকসের এক ছেলে আবার সংসদ সদস্য। পার্লামেন্টের সদস্যবৃন্দ প্রেসিডেন্টের অনুগত; অনেকে এই পার্লামেন্টকে ‘রাবার স্ট্যাম্প’ পার্লামেন্ট বলেও অভিহিত করে থাকেন। এদিকে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রধান, যিনি প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের ভাই, এক মামলায় তার বিরুদ্ধে সম্প্রতি রায় প্রদান করেন প্রধান বিচারপতি শিরানী বন্দরনায়েকে। নেপথ্যে এতসব ঘটনা থাকার প্রেক্ষাপটে নিরপেক্ষ ও নীতিনিষ্ঠ প্রধান বিচারপতির পদচ্যুতি সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। অবশেষে আইনের ন্যায়দ- সমুন্নত রেখেই ড. শিরানী সরে দাঁড়ান; আইন ও নীতির প্রশ্নে কোন আপোস করেননি। শাসক পরিবারের কাছে বিপজ্জনক মনে হওয়ার ফলেই এই অভিশংসন ও বরখাস্তের ঘটনা বলে জোর ধারণা চালু রয়েছে। শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্ট কর্তৃক আনীত ইমপিচমেন্টের ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, তা স্পষ্টতই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবান্বিত যদিও সরকারপক্ষ তা অস্বীকার করেছে। তাকে চরম ‘শিক্ষা’ দেয়ার জন্য সংসদে বিস্ময়কর এক পন্থা অবলম্বন করা হয়। সংসদ সদস্যগণ প্রকাশ্যভাবে সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতিকে একজন বিদুষী মহিলাকে ‘পাগলী’ বলে হেয় ও অপদস্ত করেন।
এই অবমাননাকর অভিশংসনের ব্যাপারে শিরানী বন্দরনায়েকে অবশেষে মুখ খুলেছেন। মিডিয়ায় দীর্ঘ বিবৃতি দিয়ে তিনি তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। ১৯ জানুয়ারি ঈুষড়হ ঞড়ফধু পত্রিকায় প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এই ঘটনাটিকে তিনি ‘অন্যায় শাস্তি’ বলে অভিহিত করেছেন। বিবৃতির শুরুটা এরকম: ‘‘ I am the 43rd Chief Justice of the Democratic socialist Republic of Srilanka, as the Chief Justice, I have an obligation and an unwavering duty twards the judges, lawyers and the citizens at large of my country.
I stand here before you today having been unjustly persecuted, vilified and condemned…’’ (Cylon Today, 19.1.2013) অর্থাৎ : আমি গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক শ্রীলঙ্কা প্রজাতন্ত্রের ৪৩তম প্রধান বিচারপতি; একজন প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচারক, আইনজীবী ও দেশের নাগরিকদের প্রতি এবং সর্বোপরি দেশের প্রতি আমার অবিচল দায়বদ্ধতা ও কর্তব্য রয়েছে। এক অন্যায়, কুৎসাপূর্ণ ও নিন্দার্হ দ-ের শাস্তি মাথায় নিয়ে আমি আজ আপনাদের সামনে দাঁড়িয়েছি।...’’
এ প্রসঙ্গে একটি চমকপ্রদ বিষয় এই যে, পার্লামেন্ট কর্তৃক অভিশংসিত হলেও ‘‘ The Appeal Court and the Supreme Court in Sri Lanka also ruled that the impeachment procedure illegal and void. Lawyers went on strike, issued statements and unfurled black flags to mourn the passing away of justice.’’ অর্থাৎ শ্রীলঙ্কার আপীল কোর্ট এবং সুপ্রীমকোর্টও অভিশংসনের প্রক্রিয়াটিকে বেআইনী ও অসিদ্ধ বলে রায় দিয়েছিল। আইনজীবীরা ধর্মঘটে যান, বিবৃতি প্রদান করেন এবং আইনের ‘অন্তিমদশা’র জন্য কালো পতাকা প্রদর্শন করে শোক প্রকাশ করেন।’’
প্রধান বিচারপতিকে বরখাস্তের এই ঘটনায় ৫৪ জাতির সংগঠন কমনওয়েলথের মহাসচিব কমলেশ শর্মা উষ্মা প্রকাশ করেছেন। ১৩ জানুয়ারি এক বিবৃতিতে তিনি এই ঘটনাকে ‘অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘ আমি স্বীকার করি যে, এটি শ্রীলঙ্কার নিজস্ব ব্যাপার; কিন্তু আমি আমাদের পারস্পরিক কমনওয়েলথ মূল্যবোধ ও নীতি-আদর্শের বিষয়েও সচেতন; যে সংস্থায় শ্রীলঙ্কা এবং অন্য দেশগুলো চাঁদা দিয়ে থাকে।’’ কোন কূটনীতিক বিষয়টিকে ‘ভৎরমযঃহরহম’ বা ভীতিপ্রদ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার। তিনি বলেছেন, প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে গৃহীত এ ব্যবস্থা একান্তভাবেই রাজনৈতিক- দঐরমযষু চড়ষরঃরপরুবফ’। তিনি বরখাস্তকৃত প্রধান বিচারপতিকে পুনর্বহালের দাবি করে বলেছেন, ‘‘দেশের সংবিধানের প্রতি ও আইন বিভাগের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে এবং বর্তমান গতিপথ অবিলম্বে পরিবর্তনের জন্য আমরা শ্রীলঙ্কা সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছি।’’ তিনি এই অভিশংসন ও বরখাস্ত প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব ছিল বলে অভিযোগ তুলেছেন এবং কমনওয়েলথকে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করেছেন। কমনওয়েলথের আগামী ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপনের জোর সম্ভাবনা রয়েছে। এদিকে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতর থেকেও এ বিষয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে।
প্রধান বিচারপতির এই অবমাননাকর অভিশংসন ও বরখাস্তের বিষয়টি অনেক শ্রীলঙ্কানই ভাল চোখে দেখছে না। ২০০৯ সালে বিচ্ছিন্নতাবাদী তামিল টাইগারদের সঙ্গে দীর্ঘদিনব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর শ্রীলঙ্কাবাসী দেশটিতে আইনের শাসন ও মানবাধিকার পুনর্প্রতিষ্ঠার আশা করেছিল। ভয়াবহ ওই গৃহযুদ্ধে চল্লিশ হাজার, কোনো কোনো পরিসংখ্যান মোতাবেক সত্তর হাজার মানুষের মৃত্যু হয়, যার বেশিরভাগই স্বাধীনতাকামী তামিল বিদ্রোহী ও সাধারণ মানুষ। এ সময় মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়। এ বিষয়টি বিবেকবান মানুষের মনে গভীরভাবে দাগ কাটে। নিকট-ইতিহাসের সেই দগদগে ক্ষতের স্মৃতি তাদের অনেককে এখনও তাড়া করে। তার মধ্যে এখন আবার ঘটল এই দুঃখজনক ঘটনা। এটি ময়দানের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ না হলেও মানবাধিকার এবং আইনের স্বাধীনতার প্রতি একটি প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ, যা মানবিক মানুষের প্রত্যাশা ও বিবেককে রক্তাক্ত করছে। নিয়মতান্ত্রিকভাবে নিযুক্ত সর্বোচ্চ বিচারালয়ের প্রধান ব্যক্তিকে সরিয়ে দেয়ার জন্য যে ন্যক্কারজনক পন্থার আশ্রয় নেয়া হলো, তা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন।
তথ্যসূত্র : ফ্রান্সেস হ্যারিসন (বিবিসি ও এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক প্রতিনিধি, সাংবাদিক; শ্রীলঙ্কার তামিল বিদ্রোহীদের নিয়ে লেখা ‘স্টিল কাউন্টিং দ্য ডেড’ বইয়ের লেখক)-এর লেখা Sri Lanka: Impeachment & Injustice পব শীর্ষক নিবন্ধ, দি কানাডিয়ান প্রেস-এ প্রকাশিত Harper tells Sri Lanka to reinstate chief justice after ‘politicized’ dismissal শিরোনামীয় প্রতিবেদন, ঈুষড়হ ঞড়ফধু পত্রিকা এবং মুক্ত অনলাইন বিশ্বকোষ Cylon Today।

No comments

Powered by Blogger.