শেয়ারবাজার ॥ জুয়াড়ি নিয়ন্ত্রণে by রাজু আহমেদ

১২টি শক্তিশালী জুয়াড়িচক্রের হাতে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে দেশের পুঁজিবাজার। শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, তিনটি মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউস, শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কয়েক কর্মকর্তা এবং বেশ কয়েক বড় বিনিয়োগকারীর সমন্বয়ে গঠিত এ চক্র ঘিরেই আবর্তিত হয় প্রতিদিনের লেনদেন।
শেয়ারবাজারে প্রতিদিনের এ চক্র টার্গেট করে শেয়ারের দরে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটায়। এদের হয়ে বাজারে সক্রিয় রয়েছে দুই শতাধিক বিনিয়োগকারী। বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস ঘুরে গুজব ছড়িয়ে শেয়ারের দর প্রভাবিত করাই এদের কাজ। নানা কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারের দর বাড়িয়ে কোটি কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে এ চক্রের সদস্যরা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দর বৃদ্ধি বা কমার ৰেত্রে জুয়াড়িচক্রই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে। নানা কৌশলে কাজ করলেও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে এরা অত্যনত্ম গুরম্নত্বপূর্ণ। জুয়াড়িচক্রের সদস্যরা কবে কোন কোম্পানির শেয়ার কিনছে_তা জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। অবশ্য এরা কোন কোম্পানির শেয়ার কিনলে কোন না কোনভাবে সব ব্রোকারেজ হাউসে সে খবর ছড়িয়ে পড়ে। গুজব বা সত্যি যাই হোক না কেন, জুয়াড়িরা কোন একটি কোম্পানির শেয়ার কিনেছে_এ খবর কানে এলেই একশ্রেণীর বিনিয়োগকারী ওই শেয়ার কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। এতে বাজারে সংশিস্নষ্ট শেয়ারের চাহিদা বেড়ে যায়। এর প্রভাবে দরবৃদ্ধির পর নিজেদের হাতে থাকা শেয়ার ছেড়ে দেয় জুয়াড়ি। জুয়ার ফাঁদে পড়ে বেশি দরে শেয়ার কিনে লোকসানের মুখে পড়েন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। অনুসন্ধানে জুয়াড়িচক্রের বেশ কয়েক সদস্যের পরিচয় পাওয়া গেছে। ভিন্ন ভিন্ন এসব চক্রের নেতৃত্বে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস অনুষদের স্ট্যাডিজ অনুষদের এক অধ্যাপক, পুঁজিবাজারে সবচেয়ে সক্রিয় একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্রোকারেজ হাউসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, একটি বেসরকারী ব্যাংকের উচ্চপদে আসীন ডিএসইর এক সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা, নামকরা দু'টি ব্রোকারেজ হাউসের দুই কর্মকর্তা, শীর্ষস্থানীয় দুই ব্যবসায়ী এবং কয়েক বড় বিনিয়োগকারী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্ট্যাডিজ অনুষদের অখ্যাত ওই অধ্যাপক শেয়ারবাজারের একটি বড় জুয়াড়িচক্র পরিচালনা করেন। নিজে অগোচরে থাকলেও তাঁর নেতৃত্বাধীন চক্রের ২০ থেকে ২৫ বিনিয়োগকারী সরাসরি লেনদেনে অংশগ্রহণ করে। বড় বিনিয়োগকারীদের অনেকেই শেয়ার লেনদেনের ৰেত্রে তাঁর পরামর্শ নিয়ে থাকেন। অবশ্য ওই অধ্যাপকের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করে সঙ্গে সঙ্গে ফোন রেখে দেন।
শীর্ষস্থানীয় এক ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি সম্পর্কে শেয়ারবাজারে নানা ধরনের মিথ চালু রয়েছে। অবশ্য ওই ব্যবসায়ী শুধু নিজের গ্রম্নপের কোম্পানির শেয়ার নিয়েই কারসাজি করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শেয়ারবাজারে নিয়মিত সক্রিয় রয়েছে তাঁর ৩০ জনের মতো কর্মী। ব্রোকারেজ হাউসে গুজব ছড়াতে এরা সব সময় তৎপর থাকে।
জানা গেছে, জুয়াড়িচক্রের অধিকাংশ সদস্য প্রত্য লেনদেনে অংশ নেয়। এর মধ্যে ইয়াকুব আলী, মোসত্মফা, শৈবাল, আউয়াল ও তরিকুলসহ কয়েক জনের নাম বিনিয়োগকারীদের মুখে মুখে ফেরে। কিন্তু এদের লেনদেন সম্পর্কিত কোন তথ্য জানে না অনেকেই। এমনকি কোন্ ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে জুয়াড়িচক্রের এ সদস্যরা শেয়ার লেনদেন করে_তাও কেউ বলতে পারে না। তবে সব ব্রোকারেজ হাউসেই এদের লোক নিয়োজিত রয়েছে। এ ধরনের প্রায় ২০০ ব্যক্তি বিনিয়োগকারী হিসেবে বিভিন্ন হাউসে ঘোরাফেরা করে কাজ করছে। কারও কারও ধারণা, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পুঁজি হাতিয়ে নিতে জুয়াড়িচক্রের সদস্যরা অধিকাংশ ৰেত্রেই ছদ্মনাম ব্যবহার করে।
অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরা জানিয়েছেন, মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো নানাভাবে জুয়াড়িচক্রের হয়ে ভূমিকা রাখছে। জুয়াড়িদের হাতে যেসব শেয়ার থাকে, সেগুলোর দাম বাড়াতে ভূমিকা রাখে এসব প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে এদের সঙ্গে সংশিস্নষ্ট কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে ছড়ানো হয় একের পর এক গুজব। পাশাপাশি জুয়াড়িচক্রের সক্রিয় সদস্য হিসেবে ঘুরেফিরে তিনটি ব্রোকারেজ হাউসের নাম এসেছে। এর মধ্যে দু'টিই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাব-সিডিয়ারি কোম্পানি। এর মধ্যে ম্যারিকোর শেয়ার নিয়ে কারসাজির অভিযোগে সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) ইতোমধ্যে একটি মার্চেন্ট ব্যাংকের কর্মকর্তাদের শুনানির জন্য তলব করেছে। পাশাপাশি এ হাউসের ইয়াকুব আলী খন্দকার এবং আরিফুর রহমান নামে দু'বিনিয়োগকারীকেও শুনানিতে ডেকেছে এসইসি। ওই দু'জন সম্পর্কে শেয়ারবাজারে দীর্ঘদিন ধরেই নানা গুঞ্জন রয়েছে। এর আগে গুজব ছড়িয়ে ম্যাক এন্টারপ্রাইজের শেয়ারের দর বাড়ানোর অভিযোগে গত বছর আলী জামান ও ফজলুল কবীর নামে দু'জনকে ২ লাখ টাকা করে জরিমানা করেছিল এসইসি।
সংশিস্নষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের উদ্যোগে পুঁজিবাজারে কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে একটি তদনত্ম করা হয়েছিল। ওই তদনত্মে জুয়াড়িচক্রের বেশ কয়েক সদস্যকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এদের বিরম্নদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তদনত্ম প্রতিবেদনটি এসইসিতে পাঠানো হয়। কিন্তু সেই সময় এসইসি কোন পদৰেপই নেয়নি। অনেকেই মনে করেন, যত শক্তিশালী হোক না কেন, এসইসি ও ডিএসইর কর্মকর্তাদের সঙ্গে নূ্যনতম যোগসাজশ ছাড়া কোন জুয়াড়িই টিকে থাকতে পারে না। শেয়ারবাজারে কারসাজির সঙ্গে এসইসির একাধিক কর্মকর্তা জড়িত বলে বেশ কয়েক বিনিয়োগকারীর অভিযোগ। তাঁরা মনে করেন, বাজারে প্রতিদিনের গুজব রটনাকারীদের চিহ্নিত ও গ্রেফতার করতে পারলেই জুয়াড়িচক্রের রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব।
এ বিষয়ে শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সদস্য ইয়াসিন আলী জনকণ্ঠকে বলেন, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে শেয়ারবাজারে কারসাজি রোধে এসইসি সবরকম পদৰেপ নেবে। সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ পেলে জুয়াড়িচক্রের বিরম্নদ্ধে কমিশন অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে। ইতোমধ্যে কয়েক জনের বিরম্নদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। আমি মনে করে, এসইসির সার্ভিলেন্স বিভাগ সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে শেয়ারবাজারে জুয়াড়িচক্রের বিরম্নদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে সঠিক কাজ করছে।
জানা গেছে, চলতি বছরের শুরম্ন থেকে শেয়ারবাজারে লেনদেন ব্যাপক হারে বাড়তে থাকায় বড় ধরনের অস্থিতিশীলতা এড়াতে জুয়াড়িচক্রকে চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেয় এসইসি। ইতোমধ্যে অনলাইন ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে শেয়ারের দর প্রভাবিত করতে তৎপর একাধিক চক্রকে চিহ্নিত করেছে এসইসি। বিভিন্ন নামের ওয়েবসাইট, বস্নগ, ফেসবুক ও মোবাইল ফোনে শেয়ারবাজার সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য প্রচারকারীদের শনাক্ত করতে গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তা নেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দর বাড়াতে কারসাজির আশ্রয় নেয়া কিছু বিনিয়োগকারীর বিরম্নদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে অনলাইনের মাধ্যমে শেয়ারবাজারের লেনদেন প্রভাবিত করার দায়ে মাহবুব সারোয়ার নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। অনলাইনে গুজব ছড়ানোর বিষয়ে সারোয়ারের বিরম্নদ্ধে সবরকম তথ্য-প্রমাণ যোগাড় করেই র্যাবের শরণাপন্ন হয় এসইসির তদনত্ম দল।
বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, যৌক্তিক কারণ ছাড়াই জুয়াড়িদের প্রভাবে মাঝে মাঝেই পুঁজিবাজারে অস্বাভাবিক লেনদেন হচ্ছে। গুজব ছড়ানোর মাধ্যমে তারা বাজারকে অস্থিতিশীল করে তোলে। আর গুজবের ফাঁদে পা দিয়ে পুঁজি হারিয়ে দিন দিন নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে আমাদের মতো সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এদের বিরম্নদ্ধে কঠোর পদৰেপ নিতে না পারলে শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে ডিএসইর সিনিয়র সহ-সভাপতি সাইফুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, শেয়ারবাজারে কোনরকম কারসাজি হলে তার বিরম্নদ্ধে স্টক এক্সচেঞ্জ সরাসরি কোন পদৰেপ নিতে পারে না। এ ধরনের কোন তথ্য পেলে আমরা এসইসিকে সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেই। তারা যথাযথ তদনত্মের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে পারে। সম্প্রতি মোবাইল ফোন ওয়েবসাইটের মাধ্যমে গুজব ছড়ানোর বিষয়টি ডিএসইর পৰ থেকেই এসইসিকে অবহিত করা হয়েছিল। এর ভিত্তিতে এসইসি ইতোমধ্যে তদনত্ম করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শুরম্ন করেছে।
তিনি আরও বলেন, কোন সদস্য ব্রোকারেজ হাউস বা তার অনুমোদিত প্রতিনিধির বিরম্নদ্ধে কারসাজির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেলে ডিএসই অবশ্যই তার বিরম্নদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে। তবে কোন বিনিয়োগকারী এ ধরনের কর্মকা-ে লিপ্ত হলে ডিএসই শুধু এসইসিকে জানাতে পারে।
বাজার বিশেস্নষকরা মনে করেন, পুঁজিবাজারের সঙ্গে সংশিস্নষ্ট সব পরে সমন্বয়ে শক্তিশালী নজরদারি টিম গঠন করে সহজেই জুয়াড়িদের চিহ্নিত করা সম্ভব। অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, এসইসি, এনবিআর, ডিএসই, সিএসই, মার্চেন্ট ব্যাংক এবং সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এ টিম গঠন করা যেতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে এখন যে অবস্থা বিরাজ করছে_ একে সুষ্ঠু বলা যায় না। খাঁটি বাংলায় একে জুয়া খেলা বলা যেতে পারে। এ জুয়াড়িদের চিহ্নিত করতে হবে। তবে উর্ধতন কর্মকর্তাদের ইন্ধন ছাড়া জুয়াড়িদের প েসক্রিয় থাকা সম্ভব নয়। ফলে বিনিয়োগকারীদের ভাগ্য নিয়ে জুয়া খেলা বন্ধ করতে হলে এসইসি ও ডিএসইকেই সঠিক ও কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা যথাযথভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছে কিনা_সে বিষয়ে সরকারের নজরদারি জোরদার করা উচিত।

No comments

Powered by Blogger.