শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগটি অবৈধ ॥ মিগ মামলা খারিজ

 প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরম্নদ্ধে দায়েরকৃত মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ক্রয় সংক্রান্ত দুর্নীতি মামলা অবৈধ ও বেআইনী ঘোষণা করে খারিজ করে দিয়েছে হাইকোর্ট।
বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও বিচারপতি বোরহান উদ্দিনের সমন্বয়ে গঠিত দ্বৈত বেঞ্চ মঙ্গলবার এই আদেশ দেয়। এর আগে ৪ মার্চ একই বেঞ্চ বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার সংক্রান্ত ৩টি মামলাও খারিজ করে দেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরম্নদ্ধে ১৫টি মামলার মধ্যে আটটি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এখনও সাতটি মামলা শুনানির অপেৰায় রয়েছে।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় দায়েরকৃত মিগ-২৯ মামলার রায়ে বলা হয়েছে, তৎকালীন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের প্রভাবে অসৎ উদ্দেশ্যে এ মামলা করা হয়। অর্থ আত্মসাত বা রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতারণা কোন অপরাধের উপাদান এ মামলায় নেই। যে ধারায় এ মামলা করা হয়েছে, তার উপাদান বিদ্যমান না থাকায় এ মামলার আইনগত ভিত্তি নেই। তাই এ মামলা খারিজ হলো।
মামলাটি করা হয়েছিল বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরো ২০০১ সালের ১১ ডিসেম্বর তেজগাঁও থানায়। ১৯৯৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া থেকে ৮টি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার কেনে। নীতিমালা লঙ্ঘন করে কেনা বাবদ রাষ্ট্রের প্রায় ৭০০ কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মামলার অভিযোগে আনা হয়। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনাসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হলে, তার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে শেখ হাসিনা রিট দায়ের করেন।
বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের দ্বৈত বেঞ্চে রায় ঘোষণা করে বলা হয়, অসৎ উদ্দেশ্যে এ ধরনের মামলা কখনও করা উচিত নয়। রায়ে উলেস্নখ করা হয়, ২টি আঙ্গিক থেকে মামলাটি খারিজ করা হয়েছে। প্রথমত, আইন ভঙ্গ করে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাঁর বিরম্নদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়। দ্বিতীয়ত, মুখ্যত যে কাহিনীর অবতারণা করা হয়েছে এজাহার এবং চার্জশীটে তা কোন ফৌজদারী আইনের আওতায় পড়ে না। অর্থাৎ ঐ কাহিনী সত্য হলেও কোন মামলা যা সেই মামলার ভিত্তিতে সাজা হতে পারে না। এটা একটি দৃঢ় প্রতিষ্ঠানিক বিধান যে, অভিযুক্ত ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার বিরুদ্ধে কোন চার্জ গঠন হতে পারে না। যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি পলাতক না হয়।
এ ব্যাপারে আমাদের এবং কমন ল ভুক্ত দেশসমূহের উচ্চতর আদালতের ভূরি ভূরি সিদ্ধান্ত রয়েছে। এই মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তি পলাতক ছিলেন না। এটা স্বীকৃত ব্যাপার। স্বীকৃত যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি চিকিৎসার কারণে চার্জ গঠনের শুনানির সময়ে বিদেশে অবস্থান করছিলেন। এটা দালিলিক যে, তাঁর চিকিৎসার সংজ্ঞাও অনুপস্থিতির জন্য নিম্ন আদালতে চার্জ গঠনের দিন পরিবর্তনের দরখাস্ত করা হয়েছিল। কিন্তু নিম্ন আদালত ঐ দরখাস্ত গ্রাহ্য না করে দরখাস্তকারীর অনুপস্থিতিতেই তাঁর বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন। আমরা মনে করি সময়ের দরখাস্ত নাকচ করে দরখাস্তকারীর অনুপস্থিতিতে এক দরখাস্তকারীর বক্তব্য শ্রবণ না করে তার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন ছিল মারাত্মক আইনগত ভ্রানন্তি। যার কারণে গঠিত চার্জ কোন অবস্থায়ই আইনগত স্বীকৃতি দেয়া যেতে পারে না।
বিচারকরায়ে উল্লেখ করেন, নিম্ন আদালতের বিজ্ঞ বিচারকের উচিত ছিল সময়ের আবেদন মঞ্জুর করা। কেননা আদালতের অনুমতি এবং জ্ঞান সাপেৰেই দরখাস্তকারী চিকিৎসার জন্য বিদেশে অবস্থান করছিলেন।
দ্বিতীয়ত, এজাহার এবং চার্জশীটে যে ঘটনা ব্যক্ত করা হয়েছে, তা আদৌ ফৌজদারী আইনসমূহের উলিস্নখিত ধারা অর্থাৎ ফৌজদারী দ-বিধির ৫০৯ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতিবিরোধী আইনের ৫(২) ধারার আওতায় পড়ে কিনা? ফৌজদারী দ-বিধির ৫০৯ এবং ৫০৪ ধারা বিশেস্নষণ করলে এটা পরিষ্কার ফুটে ওঠে যে, কোন ব্যক্তি তখনই উক্ত ৫০৯ ধারার অভিযোগে অভিযুক্ত হতে পারেন। যদি দেখা যায় যে, তিনি তার নিজের জন্য বা অন্য কারোর জন্য বিশ্বাসভঙ্গমূলক এবং অসৎভাবে উক্ত সম্পত্তি আত্মসাত করেন বা তার নিজের ব্যবহারে অথবা নিজের ব্যবহারের জন্য রূপানত্মর করেন অথবা বিক্রি করেন।
রায়ে আরও বলা হয়, ১৯৪৭ সালের দুনর্ীতি দমন আইনের ৫(১) ধারা অনুযায়ী একজন ব্যক্তির বিরম্নদ্ধে তখনই মামলা করা যায়, যদি তার বিরম্নদ্ধে এই মর্মে অভিযোগ থাকে যে, তিনি সম্পত্তি অথবা আর্থিক সুবিধা নিজে তসরম্নফ গ্রহণ করেছেন। অথবা গ্রহণের চেষ্টা করেছেন অথবা অন্য কাউকে সেই সুবিধা প্রদান করেছেন। রায় পাঠ করে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও বিচারপতি বোরহান উদ্দিনের বেঞ্চ বলেছে, আমাদের এই মামলায় যে এজাহার বা চার্জশীট করা হয়েছে, তার কোথায়ও এমন কোন কথা নেই যে, দরখাসত্মকারী এই উপরোলিস্নখিত কোন ঘটনা ঘটিয়েছেন। তাঁর সম্পর্কে এজাহার এবং অভিযোগ মতে মূলত যে কথা বলা হয়েছে, তা হলো, দেশের প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও তিনি মিগ-২৯ বিমানসমূহ ক্রয় করেছেন। আমাদের কোন ফৌজদারী আইনে এমন কোন বিধান নেই। নেত্রী সম্পর্কে যে কথা বলা হয়েছে তার ভিত্তিতে তার বিরম্নদ্ধে ফৌজদারী মামলা চলতে পারে।
রায়ে বলা হয় এ সম্পর্কে আদালতে উপস্থিত সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের মতামত চাওয়া হলে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, যে এজাহারে এবং অভিযোগপত্রে যে কথা বলা হয়েছে, তার ভিত্তিতে কোন ফৌজদারী মামলা দায়ের করা বা প্রচলিত রাখা যেতে পারে না। উলেস্নখ করেছেন ফৌজদারী দ-বিধির অথবা অন্য কোন ফৌজদারী আইনের আওতায় কোন কাহিনী আনয়ন করা যায় না, গেলে কোন ব্যক্তিকে ফৌজদারী অপরাধে অভিযুক্ত করা যেতে পারে না। সেই অর্থে বর্তমান ফৌজদারী মামলা চলতে পারে না। তিনি আরও বলেন যে, সিদ্ধানত্ম গ্রহণের ব্যাপারে কোন ভুল যদি সত্যি সত্যি পরিলৰিত হয় তার বিচারের দায়িত্ব পার্লামেন্ট এবং জনসাধারণের, তার ভিত্তিতে কোন মামলা করা যেতে পারে না।
রায়ে আরও বলা হয়, আবেদনকারীর সিনিয়র আইনজীবী রফিক উল হক, আব্দুল মতিন খসরম্ন, ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, নুুরম্নল ইসলাম সুজন, ফজলে নূর তাপস একই মতামত পেশ করেছেন। তদুপরি আদালতে উপস্থিতি আরেক বিজ্ঞ আইনজীবী আব্দুর রব চৌধুরী বলেছেন, রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়ের সিদ্ধানত্ম নেয়ার ৰমতা জনপ্রতিনিধিত্বকারী সরকারের ওপর। তারা যদি এসব সিদ্ধানত্ম প্রয়োগ করতে না পারে, এই ভয়ে থাকেন যে, কোন সিদ্ধানত্ম হলে তার বিরম্নদ্ধে মামলা হতে পারে। তা হলে রাষ্ট্রযন্ত্র বিকল হতে বাধ্য। রায়ে বলা হয়, আমরা বিজ্ঞ আইনজীবীদের উলিস্নখিত মতামতের সঙ্গে একমত। যেহেতু এজাহারে বা অভিযোগপত্রে কোথায়ও উলেস্নখ নেই যে, আবেদনকারী নিজের জন্য বা অপরকারোর জন্য কোন সম্পদ বা অর্থ আত্মসাত করেছেন, বা আত্মসাতের সুযোগ ঘটিয়ে দিয়েছেন। সেহেতু তার বিরম্নদ্ধে কোন ফৌজদারী মামলা চলতে পারে না। প্রশ্ন থেকে যায় অভিযোগ গঠন পত্রটি বাতিল ঘোষণা করা হলে তার ফল কি হবে। এ ব্যাপারে আদালতে উপস্থিত আরেক সিনিয়র এ্যাডভোকেট আনিসুল হকের মতামত চাওয়া হলে, তিনি বলেন, চার্জ গঠন দলিলটি খারিজ করা হলে আদালতের সামনে মামলা চালিয়ে যাবার আর কোন উপস্থিত থাকবে না। সে কারণে এই দলিলটি খারিজ করা হলে পুরো মামলাটি খারিজ করতে হবে। অন্যথায় এটা একটি অবাসত্মব পরিণতিতে নিৰিপ্ত হবে। রায়ে বলা হয় ১৯৫৪ সালের এআইআর-এ মুদ্রিত সম্রাট বনাম নাজির আহমেদের কথা উল্লেখ করতে পারি। উক্ত মামলায় প্রিভি কাউন্সিল এই মর্মে রায় প্রদান করে যে অভিযোগপত্রে এমন ঘটনা উলেস্নখ না থাকে যা ফৌজদারী আইনের কোন বিধানে আনা যায়, তাহলে সেই অভিযোগের ভিত্তিতে কোন ফৌজদারী মামলা করা হলে তা অচিরেই খারিজ করে দেয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়। এ ছাড়া ৩৮ ডিএলআরএ বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীও একই মনত্মব্য প্রকাশ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ বনাম রাষ্ট্র মামলাসহ অন্যান্য বহু মামলায় ভারতীয় সুপ্রীমকোর্ট একই ধরনের মন্তব্য ব্যক্ত করেছে। এমতাবস্থায় এই মৃত মামলাটি যার মৃত অবস্থায় জন্ম, জীবনহীন অবস্থায় যার জন্ম, তা খারিজ করে দেয়া একানত্ম বাঞ্ছনীয় হয়ে পড়েছে। নয়ত শুধু আবেদনকারী লাঞ্ছিত হবেন না, আমাদের পুরো আইন ব্যবস্থাও অপব্যবহারের শিকার হবে।
রায়ে আরও বলা হয়, এজাহার এবং অভিযোগপত্র থেকে এটা দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে, মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল, রাজনৈতিক অভিসন্ধির কারণে। দরখাস্তকারী শুধু বাংলাদেশের নয়। সারা পৃথিবীতে একজন অতি পরিচিত ব্যক্তি যিনি সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত। এই মামলাটি চরিত্র হননের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সুতরাং কালক্ষেপণ না করে এই মামলা খারিজ করে দেয়া হলো। এ বিষয়ে ভারতেরে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি কৃষ্ণা আয়ারের উক্তি উলেস্নখযোগ্য। তিনি নবাব খান আব্বাস খান বনাম গুজরাট রাষ্ট্র মামলায় বলেছিলেন, যদি সংবিধানের প্রদত্ত মানবাধিকার ভঙ্গ করে কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অসার ফৌজদারী মামলা দায়ের করা হয় তা হলে সেই মামলা অচিরেই খারিজ না করলে সংবিধানের শাসন পদ্ধতি মারাত্মকভাবে বিঘি্নত হতে বাধ্য। উপরোক্ত কারণসমূহের আলোকে আমরা এই মামলা খারিজের নির্দেশ প্রদান করছি। একই কারণে এই রুলটিও এ্যাবসুলেট করা হলো।

No comments

Powered by Blogger.