ফাইবার অপটিক্স by ড. জাকিয়া বেগম

অপটিকাল ফাইবার কাঁচ বা প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি এক ধরনের স্বচ্ছ অত্যন্ত সরু তন্তু যা সাধারণত আলো সঞ্চারিত করার মাধ্যমে সংকেত/তথ্য আদান-প্রদানের জন্য ব্যবহার করা হয়।
ফাইবার অপটিক্স বিজ্ঞানের সেই শাখা- যা এই ধরনের তন্তু সম্পর্কিত তথ্যাদি নিয়ে কাজ করে। বর্তমানে টেলিকমিউনিকেশন (টেলিফোন, বেতার, টেলিভিশন বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে যে যোগাযোগ ব্যবস্থা), যোগাযোগ ব্যবস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্রে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে সংযোগ কাঠামো (নেটওয়ার্কিং) বিস্তৃত করে তুলতে, চিকিৎসা, সেনাবাহিনী, শিল্প-কারখানা, যানবাহন, নিরাপদ ও উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা ইত্যাদি ক্ষেত্রে এই তন্তু ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। প্রযুক্তিগত উন্নতির সাথে সাথে বিভিন্ন ব্যান্ডউয়িথের চাহিদা বেশ দ্রুততার সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং টেলিকমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতও এই তন্তু উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে যাবে।
সেই প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ আলো জ্বালিয়ে শত্রুর আগমনসহ বিভিন্ন জরুরী বার্তা আদান-প্রদান করত। প্রায় দুই শতাব্দী আগে ১৭৯০ সালে ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞানী ‘ক্লড চ্যাপে’ ‘সেমাফোরস্’ নামে মনুষ্য পরিচালিত কিছু সাংকেতিক চিহ্ন আলোর সাহায্যে প্রেরণের মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদানের একটা পদ্ধতি চালু করেছিলেন। ১৮৮০ সালে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল আয়না এবং সূর্যের আলো ব্যবহারের মাধ্যমে ‘ফটোফোন’ তৈরি করেন। কিন্তু সেই সময় তার এই আবিষ্কার তেমন স্বীকৃতি লাভে ব্যর্থ হয়, কারণ তখন এই প্রক্রিয়াতে আলো সঞ্চালনে বাধা সৃষ্টিকারক বাইরের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া যেমনÑআবহাওয়া, রাত্রির অন্ধকার বা মধ্যবর্তী স্থানে বিভিন্ন বস্তু বা স্থাপনার অবস্থান ইত্যাদি থেকে মুক্ত থাকার মতো কোন মাধ্যম তৈরি করা সম্ভব হয়নি। ফাইবার অপটিক আবিষ্কারের পর আলোর প্রবাহ ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় এবং আরও কিছু উন্নত প্রযুক্তি সংযোজন করা সম্ভব হওয়ায় এই প্রযুক্তি আবার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাই আব্রাহাম বেলের ‘ফটোফোন’কেই ‘ফাইবার অপটিক্স’ পদ্ধতিতে তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে আদি জনক বলে বিবেচনা করা হয়। ফাইবার অপটিক পদ্ধতির ক্ষেত্রে প্রথমত প্রয়োজন হয় একটি প্রেরক যন্ত্রÑযা আলোর মাধ্যমে সংকেত প্রেরণ করে, অপটিক্যাল ফাইবারÑযা আলোকে বহন করে নিয়ে যায় এবং একটি গ্রাহক যন্ত্র যা আলোর মাধ্যমে প্রেরিত সংকেত গ্রহণ করে। কেন্দ্রে অধিক ঘনত্ববিশিষ্ট স্বচ্ছ কাঁচের নল চতুর্দিক দিয়ে কিছুটা কম ঘনত্ববিশিষ্ট অপর একটি কাঁচের নল দ্বারা পরিবেষ্টিত অর্থাৎ ‘ক্ল্যাডিং (আচ্ছাদিত করা) করে এই ফাইবার তৈরি করা হয়। এর ফলে তন্তুর মধ্য দিয়ে সঞ্চালিত হওয়ার সময় পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন প্রক্রিয়ার কারণে আলোর বিচ্ছুরিত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায় এবং একটা নির্দিষ্ট দিকে আলো সঞ্চালিত হতে থাকে। ফাইবার অপটিক পদ্ধতি বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠার কারণ সাধারণ তার, কো-এক্সিয়াল কেবল্স বা বেতার তরঙ্গের চাইতে এর তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষমতা অনেক বেশি। আর অনেক বেশি দূরত্ব অতিক্রম করার ক্ষেত্রে কাঁচের তৈরি তন্তুই ব্যবহার করা হয়, কারণ এগুলোর প্লাস্টিকের তুলনায় আলো শোষণ করে নেয়ার ক্ষমতা কম হওয়ায় প্রেরিত আলোর বেশির ভাগই গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারে।
তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে মাধ্যমটির ক্ষমতা নির্ভর করে নিচু থেকে উঁচুতে কতটা বিস্তৃত মাত্রা পর্যন্ত কম্পাঙ্ক সরবরাহ করতে পারে (ব্যান্ডউয়িথ) তার ওপর। আর বর্তমানে প্রযুক্তিগত উন্নতি সাধনের কারণে ফাইবার অপটিক্স বিস্তৃত ‘ব্যান্ডউয়িথ’-এ তথ্য সরবরাহ করতে সক্ষম। এই তন্তুগুলো সাধারণত জোড়ায় জোড়ায় ব্যবহার করা হয় এবং জোড়ার একটি তন্তু একটি দিকেই সংকেত বহন করে। এই ধর্মটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এর ফলে বিভিন্ন তন্তুর মধ্য দিয়ে একই সাথে প্রবাহিত হওয়ার সময় সংকেতগুলোর মধ্যে সংমিশ্রণ কম ঘটে। ফলে সংকেত অনেকটা অবিকৃত অবস্থায় লক্ষ্য স্থানে পৌঁছে যায় এবং এক্ষেত্রে তারগুলো কোনভাবে বেঁকে গেলেও সংকেত প্রেরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। যদিও দ্বিমাত্রিক যোগাযোগও সম্ভব তবে সেক্ষেত্রে দু’টি ভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘের সংকেত এবং সঠিক সংযোজক/বিভাজক ব্যবহার করতে হয়।
যদিও তন্তুগুলো প্রেরিত তথ্য বিকৃত হয়ে যাওয়ার মতো সংকেতের সাথে নতুন কিছু যোগ করে না তবে প্রাথমিক পর্যায়ে কাঁচের মধ্য দিয়ে আলো প্রেরণের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা ছিল প্রেরিত আলোর অনেকটা অংশ কাঁচের মধ্যে শোষিত হয়ে যাওয়ায় প্রেরিত আলোর খুব বড় একটা অংশই লক্ষ্য স্থানে পৌঁছতে পারত না। প্রথম দিকে ব্যবহৃত কোন কোন ফাইবার অপটিক্সের ক্ষেত্রে দেখা গেছে ১০০ মিটার দীর্ঘ ফাইবারের ভেতর দিয়ে প্রেরিত আলোর মাত্র ১ বিলিয়ন ভাগের দশ ভাগ শেষ প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। এক্ষেত্রে তন্তুর দৈর্ঘ্যরে সাথে সূচক সূত্র (এক্সপনেনসিয়াল) মতে, প্রেরিত আলোর সঞ্চালনের মাত্রা কমে আসে। স্পষ্টত এত বেশি মাত্রায় শোষিত আলো তথ্য প্রেরণের জন্য ছিল অনেকটাই অকার্যকর।
কাঁচ যত কম স্বচ্ছ হয় এর মধ্য দিয়ে সঞ্চালিত হওয়ার সময় আলো তত বেশি শোষিত হয়। ফলে গত শতাব্দীর ৬০ দশক থেকে কাঁচের স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা চালাতে থাকেন। সৌভাগ্যবশত ১৯৬৬ সালে ‘স্ট্যান্ডার্ড টেলিকমিউনিকেশনস্ ল্যাবরেটরিজ লিমিটেডের’ দু’জন বিজ্ঞানী চালস্ কাও এবং জর্জ হকহাম আবিষ্কার করতে সক্ষম হন যে কাঁচের মধ্যস্থ খাদ যেমনÑলোহা, তামা, ভ্যানাডিয়াম, ইত্যাদি দূরীভূত করে যত বেশি কাঁচকে বিশুদ্ধ করা যায় এর সঞ্চালন ক্ষমতা তত বাড়ে। তাই যদি এমন ধরনের কাঁচ তৈরি করা যায় যা প্রেরিত আলোর ২০ ডেসিবেল/কি.মি. মাত্র শোষণ করে তবে সেক্ষেত্রে সেই কাঁচের মাধ্যমে আলোর সাহায্যে তথ্য আদান-প্রদান সম্ভব। পরবর্তীতে খাদ বিশেষ করে ‘হাইড্রক্সিল আয়ন’ দূর করে ফাইবার তন্তুর আলো শোষণ মাত্রা ০.২ডিবি/কিমি পর্যন্ত কমিয়ে আনা সম্ভব হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে আরও জানা যায়, ইনফ্রারেড বা অবহেলিত রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য এমন যে, সঞ্চারিত হওয়ার সময় তন্তু কর্তৃক এর শোষণ অনেক কম হয়। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, দৃশ্যমান আলোর চাইতে যদি ১.৩ মাইক্রোমিটার বা ১.৫৫ মাইক্রোমিটারের অবহেলিত রশ্মি ব্যবহার করা হয় তবে শোষণের পরিমাণ আরও কমে যায় কারণ ‘হাইড্রক্সিল আয়ন’ ২.৭৩ মাইক্রোমিটার তরঙ্গের আলো শোষণ করলেও ১.৩৯, ০.৯৫ এবং ০.৭২ মাইক্রোমিটার তরঙ্গের ক্ষেত্রে শোষণের পরিমাণ অনেক কমে যায়। ০.৯ মাইক্রোমিটার তরঙ্গের শোষণ মাত্রা ১ডেসি/কিমি রাখার জন্য হাইড্রক্সিলের মাত্রা হওয়া উচিত ১ মিলিয়নের মধ্যে ১ ভাগ মাত্র। টেলিকমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে ফাইবার অপটিক্সের মাধ্যমে তথ্য প্রেরণের কাজে বর্তমানে অবহেলিত রশ্মিই ব্যবহার করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.