উত্তরাঞ্চলে ৭৫ হাজার একর খাস জমির ৪১ হাজারই বেদখল- ভূমি দস্যুতা সমাচার- অনুসন্ধানী প্রতিবেদন-৬ by আনিসুজ্জামান,ইচএম এরশাদ

রাজশাহী এবং কক্সবাজারে লাখ লাখ একর সরকারী জমি ভূমিদসু্যরা দখল করে নিয়েছে। ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের কিছু অসাধু ব্যক্তির যোগসাজশে ভূমিদসু্য, মহাজন, সরকারী আমলা, দাদন ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, জোতদার ও শিল্পপতিসহ প্রভাবশালীর উদ্যোগে জাল দলিল ও ভুয়া রেকর্ডপত্রের মাধ্যমে সরকারী বিপুল পরিমাণ খাসজমি বিভিন্ন কায়দায় জবরদখল করেছে।
রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের সূত্র জানায়, রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলে খাসজমি রয়েছে প্রায় ৭৫ হাজার ২৪৫ দশমিক ৭১ একর। এর মধ্যে এককালীন লিজ দেয়া হয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার একর জমি। আর অবৈধ দখলদারদের দখলে রয়েছে প্রায় ৪১ হাজার একর সরকারী খাসজমি। এর মধ্যে রাজশাহী মহানগর এলাকায় কয়েক হাজার বিঘা খাসজমি অবৈধ দখলদারদের হাতে রয়েছে। বেদখল এসব খাসজমি উদ্ধারে কার্যকর কোন উদ্যোগ পরিলতি হচ্ছে না। ফলে অবৈধ দখলদাররা পাকাপোক্ত হচ্ছে। তারা ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে জবর দখলকৃত জমির নিরঙ্কুশ মালিকানা দাবি করছে। ফলে ভূমি ও জরিপ রেকর্ড অধিদফতরের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে দখলদারদের গোপন অাঁতাত গড়ে উঠেছে।
রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) অফিস সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীতে ২ হাজার ৪৯২ দশমিক ৪৪৮৮ একর অর্পিত সম্পত্তি রয়েছে। এর মধ্যে বোয়ালিয়া এলাকায় ২২৪ দশমিক ০০৫২ একর, পবায় ৬৩ দশমিক ১৬০০ একর, তানোরে ৭১৯ দশমিক ৪৯০০ একর, গোদাগাড়ীতে ৪৬৪ দশমিক ৯০৭৫ একর, মোহনপুরে ১১৭ দশমিক ০৮২৫ একর, বাগমারায় ৩৫৪ দশমিক ৬৯৫০ একর, পুঠিয়ায় ১৫৩ দশমিক ৭৩০০ একর, দুর্গাপুরে ২৬২ দশমিক ৪৮০০ একর, বাঘায় ৫৫ দশমিক ১৭১১ একর ও চারঘাটে ৭৭ দশমিক ৭২৭৫ একর। এসব অর্পিত সম্পত্তি পরিকল্পিতভাবে দখলের চেষ্টা চলছে।
সূত্র জানায়, রাজশাহী শহরের ঘোড়ামারা এলাকায় অর্পিত সম্পত্তির পাঁচটি বাড়ি রয়েছে। ওই বাড়িগুলো বার্ষিক ভাড়ার ভিত্তিতে ইজারা দেয়া হয়েছিল। আব্দুর রউফ ওই ৫ ইজারাদারের একজন। যিনি পরবর্তীতে বাড়ি ৫টি নিজের দাবি করে রাজশাহী সদর সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে মামলা দায়ের করেন। মামলা নম্বর ৩৬২/০৭। অথচ তিনি ২০০৭ সাল পর্যনত্ম সরকারকে ভাড়া পরিশোধ করেছেন।
সূত্র মতে, আব্দুর রউফের মামলার নথিতে প্রদত্ত দলিলে দেখা যায়, ১৯৪৫ সালের ২৩ জুন তিনি ওই জমি মহেন্দ্র কুমার সাহা চৌধুরীর কাছে থেকে রেজিস্ট্রি দলিল করে নিয়েছেন। চক্রটি হিসাব করেছে, ওই সময়ের নথি আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে নথি না পাওয়া গেলেও তার জমির দলিলে মারাত্মক কিছু ত্রম্নটি রয়েছে। যাতে সহজেই ওই জালিয়াতি ধরা পড়ে। যেমন দলিল রেজিস্ট্রেশনের তারিখের পাশে দলিল নম্বর দেয়া আছে ১১৫২। অপরদিকে পেজ ভলিউমে নম্বর দেয়া আছে ১১৫৭। মামলার নথির সঙ্গে জমাকৃত ডিসিআর ছাপার সাল ১৯৬৮। অথচ সেই ডিসিআর ইসু্যর তারিখ দেয়া রয়েছে ১৩ বছর আগের, ১৫৫ সালের ২৪ জুন। আবার ১৯৫৫ সালের কম্পিউটার কম্পোজ দাখিলা জমা দেয়া হয়েছে। অথচ ওই সময়ে বাংলাদেশে কম্পিউটারের ব্যবহারই শুরম্ন হয়নি। আদালতে ওই বাড়ি লিজের ওপর নিষেধাজ্ঞা চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু আদালত তা খারিজ করে দিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভূমি জালিয়াতিকে ঘিরে গোটা উত্তরাঞ্চলে একশ্রেণীর সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। ওসব সিন্ডিকেটের সঙ্গে ভূমি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রয়েছে দারম্নণ সখ্য। সংশিস্নষ্টদের অনেকেই চেনেন-জানেন। জালিয়াতি করেই তারা জীবিকা নির্বাহ করেন। গত বছরের নবেম্বরে এমন একটি ভূমি জালিয়াত সিন্ডিকেটের সদস্যকে র্যাব গ্রেফতারও করেছিল। ওই জালিয়াত চক্রের সদস্যের কাছে পুরনো আমলের দলিলের বিভিন্ন নমুনা স্ট্যাম্পসহ জাল দলিল করার উপযোগী সব কিছুই ছিল। জাল দলিল, ভুয়া পত্তনী ও আমলনামা তৈরি করে আরএস (রিভিশনাল সেটেলমেন্ট) এসব কিছুই তাদের কাছে সম্ভব। দখলদাররা এদেরই অর্থের বিনিময়ে ব্যবহার করে সরকারী খাসজমি দখলের েেত্র।
সংশিস্নষ্ট সূত্র জানায়, ১৯৭৫-৭৬ সালে সারাদেশের মতো বৃহত্তর রাজশাহীর চার জেলা রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে ভূমি জরিপের কাজ শুরম্ন হয়েছিল। জরিপের বিভিন্ন ধাপ-মাঠ জরিপ, তসদিক, খানাপুরি ইত্যাদি কাজ শেষ হলেও রেজিস্টার ভলিউম এখনও প্রকাশিত হয়নি। আর এ কারণেই দায়ের জমি সংক্রানত্ম মামলাগুলোর নিষ্পত্তির কাজ বছরের পর বছর ধরে সুরাহা হচ্ছে না।
জানা যায়, রাজশাহী অঞ্চলের ৮৩টি মৌজার মধ্যে সর্বাধিক রাজশাহী জেলার ৩০ মৌজার সেটেলমেন্ট হয়নি। এছাড়া নাটোরে ২০টি, নওগাঁয় ২৩টি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ১৯টি মৌজার সেটেলমেন্ট তথ্য রাজস্ব দফতরগুলোতেও সঠিকভাবে নেই বলে জানা গেছে। এমনকি সেটেলমেন্টের কাজও শুরম্ন হয়নি। যেসব মৌজার সেটেলমেন্ট রেকর্ড হয়নি এর বেশিরভাগই বিল এবং নদীর চর এলাকা এবং অধিকাংশ খাসজমি। এসব জমির প্রকৃত মালিক সরকার হলেও ভূমিহীনরা পাচ্ছে না। বড় অংশই ভূগ্রাসীদের দখলে।
সূত্র মতে, খাসজমিগুলো নিয়ে এমন অরাজক অবস্থা দীর্ঘদিনের। কেন এমন অরাজকতা তা জানতে চাইলে সংশিস্নষ্ট দফতরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অনেক মৌজার ভূমি রেকর্ডের কাজ এখন পর্যনত্ম শেষ হয়নি। রাজশাহীর পরিস্থিতি বেশি খারাপ। এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে জালিয়াত সিন্ডিকেট। জাল কাগজপত্র তৈরি করে বিপুল পরিমাণ খাসজমি অবৈধভাবে ভোগদখল করছে তারা। এসব দুর্বলতার কারণেই সংশিস্নষ্ট আদালতে শত শত মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কক্সবাজার-চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের উভয় পাশে প্রায় ১০ হাজার একর সওজ বিভাগের জমি অবৈধ দখলদারদের হাতে চলে গেছে। এছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড, গণপূর্ত ও কৃষি খাস জমি জেলার উপজেলার প্রত্যনত্ম অঞ্চলে প্রায় ৩০ হাজার একর অবৈধ দখলে রয়েছে।
কক্সবাজার জেলার সদর উপজেলা, উখিয়া, রামু, টেকনাফ, মহেশখালী, চকরিয়া, কুতুবদিয়া ও পেকুয়ায় প্রতিযোগিতামূলকভাবে দখলবাজদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
কক্সবাজার দণি ও উত্তর বনবিভাগের প্রায় ৬০ হাজার একর পাহাড়ী জমি অবৈধ দখলে চলে গেলেও কতর্ৃপরে কোন মাথাব্যথা নেই। বেদখল হয়ে যাওয়া এ বিশাল জমির মূল্য প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা বলে বনবিভাগের প হতে দাবি করা হয়েছে। স্থানীয় কতিপয় রাজনৈতিক নেতা, সাবেক মন্ত্রী-এমপি, সাবেক উর্ধতন সরকারী কর্মকতর্া-কর্মচারীসহ পেশাদার ভূমিদসু্যরা ও রোহিঙ্গারা এ অবৈধ দখলে সরাসরি জড়িত রয়েছে। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রায় ২ হাজার একর জমি দখলবাজদের হাত থেকে উদ্ধার করা হলেও বর্তমানে তার অধিকাংশই ফের বেদখল হয়ে গেছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে কক্সবাজার জেলা কারাগারের পেছনে এক রাজনৈতিক নেতার নেতৃত্বে কক্সবাজার দণি বন বিভাগের প্রায় ১০০ একর পাহাড়ী ভূমি দখল করে, পাহাড় কেটে পস্নট বিক্রিসহ একের পর এক জমি বিক্রি ছাড়াও বেশ কয়েকটি গৃহায়ন প্রকল্পের নামে পাহাড় কাটা অব্যাহত থাকে। ইতোমধ্যে কক্সবাজার শহরতলির কলাতলী, বৈদ্যঘোনা, খাজা মঞ্জিল, বাইপাস সড়ক, বাস টার্মিনাল এলাকায় বিরাট পাহাড়ী ভূমি কেটে সমতল করে ফেলা হয়েছে। কক্সবাজার দণি বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, উখিয়া টেকনাফের পাহাড়ী জায়গায় অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের বিরাট অংশ হচ্ছে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা পাহাড় দখল করার জন্য রোহিঙ্গাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। শুধু প্রভাবশালী লোকজনই নয়, চারদলীয় জোট সরকারের আমলে খোদ প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরাই শহরের কলাতলী এলাকার দৃষ্টিনন্দন সুউচ্চ পাহাড় বুলডোজার দিয়ে নির্বিচারে গুঁড়িয়ে দিয়ে আবাসন প্রকল্প বানানোর চেষ্টা করে। শহরতলির বাইপাস এলাকায় বনবিভাগের ঝিলংজা মৌজার (আর এস ৮০০১ দাগের ৬৪৭ খতিয়ানভুক্ত) ৫১ একর আয়তনের পাহাড় সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসন প্রকল্পের নামে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়।

No comments

Powered by Blogger.