গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন by শেখর ইমতিয়াজ

শিক্ষামন্ত্রী শুরম্ন থেকেই দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠা, আদর্শ ও ন্যায়পরায়ণতার উদাহরণ রেখে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে অনেকবার তাঁকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে, কিন্তু উত্তরণ ঘটাতে সৰম হয়েছেন।
কথায় ও কাজে স্বচ্ছতার স্বাৰর রেখেছেন। এতে শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবকের মধ্যে আশার আলো জ্বলে উঠেছে। আধুনিক ও সময়োপযোগী শিৰা ব্যবস্থা উপহার দেয়ার ৰেত্রে তাঁর কোনও আন্তরিকতার অভাব দেখা যায়নি। তিনি গতানুগতিক শিৰা ব্যবস্থা বজায় রাখার প্রতি আগ্রহী নন। চান মানসম্মত ও যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রণয়ন। শিৰামন্ত্রী নূরম্নল ইসলাম নাহিদ বরাবরই বলে আসছেন, কোন দলীয় শিক্ষানীতি নয়- জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নই তাঁর লৰ্য। এক বছরের অধিক সময় পার করে অসংখ্য নির্মম বাস্তবতার নিরিখে বলতে বাধ্য হয়েছেন, শিৰা মন্ত্রণালয় দুর্নীতির আখড়া। মোদ্দা কথা হচ্ছে, দীর্ঘদিন যাবত অনিয়মের বরফ জমতে জমতে শিক্ষাবিষয়ক যাবতীয় কার্যালয় ভয়ঙ্কর রকমের নষ্ট শীতলতায় আবৃত হয়ে পড়েছে। এখান থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য শিৰামন্ত্রীর একক সদিচ্ছা যথেষ্ট নয়। বিশেষজ্ঞসহ সকল সচেতন নাগরিকের সহযোগিতা জরুরী হয়ে উঠেছে, তবে সে পথটিও যে কতটুকু খোলা তাও বার বার ভেবে দেখা উচিত।
শিৰা খাতের দুর্নীতি দূর করার জন্য শিৰামন্ত্রীর আগ্রহ ও উদ্যোগের কোনও কমতি নেই। কিন্তু 'শিক্ষা ভবন' হিসেবে পরিচিত মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিৰা অধিদপ্তরকে অনেক আগে থেকেই 'ভিক্ষা ভবন' নামে রূপান্তরিত হয়েছে। উচ্চতম আসনে বসা কর্মকর্তাটিসহ পিয়ন পর্যন্ত সকলেই প্রকাশ্যে ভিক্ষা গ্রহণ করে থাকেন। তাদের কৌশলে বিনয় থাকে না, থাকে হুমকি ধমকি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সকল বোর্ড, সকল কার্যালয়ের (উপজেলা কিংবা থানা শিৰা কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ) ভেতরে বাইরে চলে টাকার লেনদেন। পাঠ্যবই ছাপার কাজ নিয়েও শিক্ষামন্ত্রীকে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। বই বিতরণের নামে জেলা শিক্ষা অফিসার উৎকোচ (ভিৰা কিংবা ঘুষ) গ্রহণ করেন। এছাড়া বদলি এবং পদোন্নতি নিয়ে শিৰা মন্ত্রণালয় ও মাউশিতে বিশেষ দুটো সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। এসব সিন্ডিকেট মন্ত্রীর ওপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে। মন্ত্রী তাঁর আদর্শগত অবস্থানে অটল থাকার পরও কিঞ্চিৎ হিমশিম খেতে হচ্ছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন গত ১৭ বছরের এমপিওভুক্তিতে দুর্নীতির ঘটনায় মাস ছয়েক আগে মাউশির সাবেক ৭ মহাপরিচালকসহ ২৫ কর্মকর্তার ব্যক্তিগত ফাইলসহ তাদের বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা এবং কাজের মেয়াদকালের তথ্য চেয়ে মাউশিকে চিঠি দিয়েছে। শিৰা মন্ত্রণালয়ের আদেশ অমান্য করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক অধিদপ্তর সত্মর পরিবর্তন করে উচ্চতর সত্মরে শিৰক কর্মচারীদের এমপিওভুক্ত করে সরকারের প্রচুর আর্থিক ৰতিসাধনের অভিযোগ আনে দুদক। অভিযোগে পাওয়া গেছে অনেক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ হতে ডিগ্রী কলেজ এবং দাখিল মাদ্রাসা হতে আলিম মাদ্রাসায় উন্নীত দেখিয়ে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। দেশের প্রায় ৩০ হাজার শিৰা প্রতিষ্ঠানে শিৰক কর্মচারীদের নিয়োগ, বদলি, এমপিওভুক্তি, টাইম স্কেল প্রদানের দায়িত্ব মাউশির। অন্যদিকে ডিআইএর দায়িত্ব ২৬ হাজার ৩৩৩টি এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারের দেয়া টাকা যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে কিনা তা দেখাশোনা করা। কাজগুলো দফতর দুটো করে বটে, তবে ঘুষ লাগে। এই ভবন দুটোর ইটও বেহায়া ভিখেরির মতো হাত পেতে বসে থাকে! দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত সহজ সরল শিৰকদের অনেক নাজেহাল হতে হয়। তাদের মনোবল ও সততার ভিত ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়।
মহাজোট সরকার ৰমতায় আসার ২০১০ এ অনুষ্ঠিত এসএসসি, দাখিল ও এসএসসি ভোকেশনাল পরীৰাটি দ্বিতীয় বারের পরীৰা। অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে বহিষ্কৃত পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কম হওয়ায় সবার মধ্যেই আশা সঞ্চারিত হয়েছে। কিন্তু ২০ হাজার পরীক্ষার্থীর অনুপস্থিতি এক ধরনের শঙ্কাও জন্ম দিয়েছে। একাদশ শ্রেণীতে নিবন্ধন করলেও আর্থিক সঙ্কটসহ নানা কারণে মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই ঝরে পড়েছে আরও ৫ লাখ শিক্ষার্থী। প্রতিবছরে পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হওয়ার পর পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীর। উল্লেখ্য, প্রাথমিক সত্মরে যে সংখ্যক শিশু ভর্তি হয় তাদের ৮০ শতাংশ মাধ্যমিক সত্মর অতিক্রম করার আগেই ঝরে পড়ে। এটা অবশ্যই উদ্বেগজনক। এই উদ্বেগ থেকে আগামী প্রজন্মকে রৰা করার দায়িত্ব সরকারের, বিশেষ করে শিৰা মন্ত্রণালয়ের। ঝরে পড়ার কারণ অনুসন্ধান করে বাসত্মবমুখী পদৰেপ গ্রহণ না করলে শিৰা মন্ত্রণালয়ের অর্জিত ভাবমূর্তি ৰুণ্ন্ন হবে বলে বিশিষ্টজনেরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
জাতীয় শিৰানীতি প্রণয়ন অবশ্যই এ সরকারের বিরাট সাফল্য। কিন্তু, পুনরায় বলতে হচ্ছে, গোটা শিৰা ব্যবস্থায় দীর্ঘদিনের পাথরবরফ সরাতে না পারলে জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নসহ ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা হ্রাস করা যাবে না, প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপটি।
গত ৬ মার্চ জনকণ্ঠে মুদ্রিত 'পরীক্ষাময় শিক্ষা' সংবাদটি শিক্ষা ব্যবস্থার করুণচিত্র তুলে ধরেছে। লাখো পাঠকের সাথে আমি নিজেও এই সংবাদটি পাঠ করে কঠিন সত্যটিকে নতুন করে উপলব্ধি করলাম। একদার পেশাগত অবস্থান আমাকে এমনতর সত্যের মুখোমুখি করেছে অনেকবার। একজন পিতা হিসেবেও দেখেছি সনত্মানের অসহায়ত্ব_ তার কোনও নিজস্বতা ছিল না, ছিল না স্বসত্মির গৃহকোণ, ছিল না পুতুল খেলার অবসর, ছিল না দৌড় ঝাঁপ সাঁতার কিংবা উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ও দৰিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারকে নিয়ে মেতে থাকার সময়, বারান্দায় চাঁদনীরাতে পিতামহী কিংবা মাতামহীর কোলে শুয়ে রাজকন্যা রাজকুমারের বীরত্ব গাথা শোনার সুযোগও ছিল না_ সব কেড়ে নিয়েছে পরীৰাময় শিৰা। হারিয়েছে নিজের মনোজগৎ। কল্পনার ডানাও ভেঙ্গেছে। চেতনা হয়েছে বৃত্তাবদ্ধ। গত তিন দশক ধরে এই শিৰা ব্যবস্থায় যুগানত্মকারী (!) পরিবর্তন এনে 'মেধাবী' করার নামে শিৰাথর্ীদের ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে কেবলই পরীৰার বোঝা। প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যনত্ম অসংখ্য পরীৰার আতঙ্ক তাদের সর্বদা উৎকণ্ঠার বৃত্তে আবদ্ধ করে রাখে। কাস টেস্ট, সাপ্তাহিক পরীৰা, টিউটোরিয়াল, মেধা যাচাই, মডেল টেস্ট যাবতীয় নামের পরীৰায় ছাত্রছাত্রীর ঊষালগ্নকে বিষাক্ত করে তোলে। বই তাদের কাছে বারংবার ব্যবহৃত হতে হতে মলিন হয়ে পড়ে, এক পর্যায়ে হয়ে পড়ে অনাদৃত। শিৰা প্রতিষ্ঠানের প্রতি প্রেমবোধ নষ্ট হয়। ঝরেপড়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। শিৰকের উপদেশ, অভিভাবকের শাসন ওদের জীবনে কোন মূল্য বহন করে না।
প্রতিযোগিতার যুগ এটা, কেউ অস্বীকার করবে না। তবে অসংখ্য বইয়ের মাঝে কোন শিশু কিশোরকে বসিয়ে দিলে তার দৃষ্টি দূর আকাশ পথে পেঁৗছোবে না। দূর জগতের মুক্ত বাতাস বেয়ে শঙ্খ চিলের ডাক কানে এসে অনুরনন জাগাবে না। খেলার মাঠ, নদীতীর, কাশবন, মেঘের ভেলা তার কাছে অচেনা থেকে যাবে। সোনালী স্বপ্ন সঙ্ঙ্কুচিত হতে হতে বিন্দুতে এসে ঠেকবে।
জাতীয় শিক্ষানীতিতে বাংলা ভাষায় শিক্ষা প্রদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। উচ্চ শিক্ষায় একশ নম্বরের ইংরেজি বাধ্যতামূলক রাখা হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর জোর দেয়া হয়েছে। শিক্ষা বহির্ভূত কার্যক্রম যেমন খেলাধুলা, সংস্কৃতি চর্চা, আচরণ বিধি ইত্যাদি যুক্ত আছে। মোট কথা, একজন শিক্ষার্থীকে সামগ্রিকভাবে সুগঠিত করার জন্য স্নেহমমতায় পূর্ণ শিৰক-শিৰয়িত্রী দরকার। তদুপরি থাকতে হবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর দৰতা। নইলে পরীৰা বোঝা হয়েই থাকবে কেবল, আনন্দময় সোপান ডিঙানোর বার্তা বয়ে আনবে না।
আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় অন্ততপক্ষে শিক্ষা ব্যবস্থা যেন আটকে না যায়, সে ব্যাপারে সরকার দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করম্নক এটা সকলের কাম্য। ঘুষ, অর্থ কেলেঙ্কারি শিৰক নিয়োগে বাণিজ্য, বদলি এবং পদোন্নতিতে দলীয়করণ এসব বন্ধ না হলে আর যাই হোক ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন কখনও সত্যে পরিণত হবে না। অপ্রয়োজনীয় বইয়ের আধিক্য এবং পরীৰার চাপ বৃদ্ধির শঙ্কা থেকে শিৰাথর্ীদের মুক্ত করতে হবে। অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনকারী নষ্টদের হাত থেকে শিৰা ব্যবস্থাকে সংস্কার করে সাজাতে গেলে ভাল মানুষের কাছে সকল শিৰা প্রতিষ্ঠানকে ছেড়ে দিতে হবে। শিৰা মন্ত্রণালয়ের অধীনে সকল কার্যালয়েও ভাল মানুষের অবস্থানকে দৃঢ় করতে হবে। সর্বোপরি শিক্ষার্থীর চিত্তকে ভীতিশূন্য রাখতে হবে। সবই সরকারের দায়িত্ব। সচেতন এবং দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নাগরিকরা এমনটিই ভাবছেন।

No comments

Powered by Blogger.