আমাদের কেজি ভাই by বেলাল চৌধুরী

এক সময় কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের পরিচিতি ছিল তাঁদের নামের ইংরেজী আদ্যৰর দিয়ে। সেই সুবাদেই তিনি ছিলেন কেজিএম। বিভাগপূর্ব কাল থেকেই সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি।
এখানে যে কালের কথা বলা হচ্ছে তখন বিশেষ করে সাংবাদিকতার ৰেত্রে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। আমাদের কেজি ভাই সেই হাতে গোনাদেরই একজন হয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন। অবশ্য কেজি ভাইদের আগের প্রজন্মে যে মুসলমানরা একেবারেই ছিল না তাও নয়। মাওলানা আকরম খাঁ, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, মোহাম্মদ মোদাব্বের, আবদুর রহিম সিদ্দিকী, সৈয়দ নুরম্নদ্দিন প্রমুখদের পরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে কেজি ভাইরাই হচ্ছেন সত্যিকারের পথপ্রদর্শক। উল্লিখিত নামের তালিকাটি ক্রমানুসারে বা সাংবাদিকতার পেশার সঙ্গে জড়িতদের সম্পৃক্ত না হলে ক্ষমাপ্রার্থী। আসলে শুধু সময়টাকে চিহ্নিত করবার জন্যই এই উল্লেখ।
কেজি ভাইকে আমি প্রথম চিনি তৎকালীন সময়ে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময় থেকে। সেই সুদূর বাল্যকাল থেকেই আমি কমিউনিস্ট পার্টির অনুগত ছাত্র ফেডারেশনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম আমার কয়েকজন দীক্ষাগুরুর প্রভাবে। এদের মধ্যে একজন ছিলেন ফেনী কলেজের লাইব্রেরিয়ান সিরাজুল ইসলাম। বাইরে থেকে দেখলে যাকে মনে হতো পাক্কা মুসল্লি মানুষ। তিনি আবার ছিলেন তৎকালীন সময়ে অর্থাৎ অখ- বাংলার রাজধানী শহর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামজাদা আরবী ও ফারসী শিক্ষক নূরুল আবসারের জামাতা। তলে তলে করতেন কমিউনিস্ট পার্টি_ এ যেন বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা। আর ছিলেন কুমিল্লা অমূল্য স্মৃতি পাঠাগারের গ্রন্থাগারিক দ্বারিক দা। এদের দু'জনের কাছে আমার সাম্যবাদী দর্শনের প্রথম পাঠ।
সময়টা ছিল মহান ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। যে নির্বাচনে জামানত বাজেয়াফত ছাড়াও মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিল হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী গঠিত যুক্তফ্রন্ট। কমিউনিস্ট পার্টির তেমন কোন উল্লেখযোগ্য কার্যকর ভূমিকা না থাকলেও গোটা দেশে পাঁচজনের মতো কমিউনিস্ট প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। বরিশালে চিত্তরঞ্জন সুতার সর্বাধিক ভোট পেয়ে নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। আর কুমিল্লা জেলার বরুড়া এলাকার প্রার্থী হয়েছিলেন হাসনাবাদ বিদ্রোহখ্যাত মুহম্মদ এয়াকুব আলী বা বড় মিয়া। যশোরে প্রার্থী হয়েছিলেন কমরেড আবদুল হক সাহেব। ঐ এয়াকুব মিয়ার এলাকা গালিমপুরে পার্টির নির্দেশে এসেছিলেন তখনকার প্রভিন্সিয়াল অর্গানাইজিং কমিটির সদস্য কেজি মুস্তাফা। সময়টা ছিল চৈত্র-বৈশাখ মাস। আমি পার্টির নির্দেশে কুমিল্লা হয়ে বরুড়া পৌঁছে দেখলাম একান্তভাবে ত্যাগী ও সংগ্রামী নেতা কমরেড মুহম্মদ এয়াকুব মিয়ার অতি সাধারণ বাসস্থান। কেজি ভাইসহ আরও কয়েকজন নামে ছদ্মনামে অবস্থান করছেন। এমনি খরার কাল যে তখন দীঘি পুকুরগুলো পর্যন্ত শুকিয়ে চৌচির। প্রায় মাইলখানেক হেঁটে গিয়ে গোসল করতে হতো হাঁটুজল তপ্ত কর্দমাক্ত পানিতে। আবার একইভাবে ঘর্মাক্ত বদনে খেতে বসতে হতো সাধারণ খড়ের ঘরে বসে। ভাত ডাল সবজি, কচিৎ কখনও এক চিলতে মাছ কিংবা এক টুকরো মাংস।
কমিউনিস্টরা রণে ভঙ্গ দেয়ার পাত্র নয়। আমাদের এভাবে স্থানীয় কৃষিজীবী মানুষদের সঙ্গে মিলেমিশে প্রায় তিন মাসব্যাপী নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যেতে হয়েছিল। তা সে চাই রাতের আলো-আঁধারই হোক বা ঘর্মাক্ত লিদাখই হোক আমাদের কর্মস্পৃহাতে কোন শৈথিল্য ছিল না। তখন কাছে থেকে কেজি ভাইকে দেখেছিলাম কত বড় আদর্শবান ও কর্মনিষ্ঠ না হলে দিবারাত্রি ঐ রকম অখণ্ড মনোযোগ সহকারে খেটে চলেছেন।
কিন্তু দুঃখের বিষয় যুক্তফ্রন্টের শরিক দল নেজামে ইসলামের দ্বিচারিতায় কমরেড এয়াকুব আলী পরাজিত হন। নির্বাচনোত্তর সময়ে কেজি ভাইর সঙ্গে ঢাকাতে দেখা হলো এবং তারই কথামতো তার অগ্রজ 'ভাসানী যখন ইউরোপে'র লেখক খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের পত্রিকা তার স্ত্রী মাজেদা খাতুন সম্পাদিত রাতারাতি বাজারি পত্রিকা থেকে ভোল পাল্টে যাওয়া 'যুগের দাবী'তে লিখতে হলো তখনকার দিনের সবচেয়ে ঘৃণিত ও কুখ্যাত পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির বিরুদ্ধে যুক্তিনিষ্ঠভাবে একটা লেখা লিখতে হয়েছিল। রচনাটি প্রগতিপন্থীদের কাছ থেকে প্রচুর সুখ্যাতি অর্জন করেছিল তো বটেই কিন্তু আমার কাছে সবচেয়ে বড় পাওনা মনে হয়েছিল কেজি ভাইর অকুণ্ঠ প্রশংসা।
তারপর আমার বাউণ্ডেলে প্রকৃতির অনিশ্চিত জীবনযাপনের ফলে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে চলে যাওয়ার পরও কেজি ভাইর স্নেহ-ভালবাসা থেকে কখনও নিজেকে বিচ্যুত মনে হয়নি।
৯২ক ধারার সময় দীর্ঘদিন কারাগারে থাকার সময়েও কেজি ভাইর অকুণ্ঠ সমর্থন সর্বদাই আমাকে প্রেরণা জুগিয়ে চাঙ্গা করে রেখেছিল। এমনকি কেজি ভাই বিয়ের পরও তার নবপরিণীতা স্ত্রী পরবর্তীকালে আমাদের বিশেষ বন্ধু হয়ে ওঠা অকাল প্রয়াত লব্ধপ্রতিষ্ঠ কবি আবু হেনা মোস্তাফা কামালের বোন সাবেরা খাতুন শামসুন আরার নতুন সংসারে আজও মনে আছে এক অলস দুপুরে সুস্বাদু খাবার দাবারে আপ্যায়িত হওয়ার ঘটনা।
এরপর আমার চরিত্র অনুযায়ী দীর্ঘকালের অনুপস্থিতি আর তার অদর্শনের পরও কিন্তু ১৯৭৩ সালে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে একদিন হঠাৎ প্রেসকাবে দেখা হতেই বুকে টেনে নিয়ে কুশলাদি বিনিময়ের পর জানালেন যে তিনি শিগগিরই কূটনৈতিক কাজের দায়িত্ব পালনে বিদেশ চলে যাওয়ার আগে তার ধানমণ্ডির বাসস্থানে একবেলা অন্তত কিছু আহারাদি করলে তিনি খুশি হবেন।
কথা রেখেছিলাম বলে তিনি যারপরনাই আনন্দ প্রকাশ করলেন। এরপর আবার দীর্ঘদিনের বিচ্ছেদ। তাঁর বিদেশ অবস্থানকালে খবরাখবর জানতে পারতাম এর ওর মুখে। সর্বোপরি একটি বিদেশী দূতাবাসে কর্মসূত্রে ইরাকে তাঁর সম্পাদিত কাগজ দু'টির সুবাদে।
তারপর তো দেশেই ফিরে আসার পর একটা সময় আমরা খুবই কাছাকাছি দু'টি অফিসে বসতাম। সুযোগ পেলেই চলে যেতাম কেজি ভাইয়ের কাছে। অবাক মানতাম যখনই দেখা হতো কুশলাদি বিনিময়ের পরও জানতে চাইতেন আমার সংসার ধর্ম পালনের খুঁটিনাটি বিষয়েও।

No comments

Powered by Blogger.