উন্নয়নের সঙ্গে রাজনীতিও ডিজিটাল হোক by মাসুদা ভাট্টি

সজীব ওয়াজেদ জয়ের রাজনীতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেয়াটা সময়ের ব্যাপার ছিল মাত্র, এর মধ্যে কোন প্রকার দ্বিধা ছিল না কারোরই। বিশেষ করে গত বছর কয়েক যাবত তিনি যেভাবে শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক ও দেশ পরিচালনায় সহায়তা করে আসছিলেন তাতে তিনি যে রাজনীতিতে আসছেন সে বার্তা আগেই মানুষের কাছে পেঁৗছেছিল।
গত সপ্তাহে এই বার্তাটিই আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে স্থায়িত্ব লাভ করেছে। এই যোগদান একদিকে যেমন সময়োপযোগী তেমনই অন্যদিকে এর প্রয়োজনীয়তা ও প্রভাবও ব্যাপক বলে পর্যবেক মহলের ধারণা। আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল, এই দলটি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছে। সবচেয়ে বড় কথা হলা, জন্মের পর থেকে এ পর্যনত্ম বাঙালির প্রতিটি গণ-আন্দোলনে এই দলটি জনগণের পাশে থেকেছে। সমাজের প্রতিটি সত্মরে এই দলটির রয়েছে দৃঢ় গণভিত্তি এবং জনমানসে এই দলটির নেতৃত্বের একটি বিশাল প্রভাব। সুতরাং ভবিষ্যতে যদি জয় এই দলটির নেতৃত্বভার নেন তাহলে তার আধুনিক মনস্কতা, তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর শিা এবং পশ্চিমে দীর্ঘকাল বসবাসের ফলে লব্ধ জ্ঞানের প্রয়োগও আমরা এই দেশে দেখতে পারবো বলে আশা করা যায়। ব্যাপারটি কাকতালীয় কিনা জানি না, তবে একথা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, জয়ের রাজনীতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে অংশগ্রহণ এবং তার পরই দেশে এসে টেলিকমিউনিকেশন সংক্রানত্ম এক অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প উপস্থাপন, যে কোন আধুনিক প্রযুক্তি-নির্ভর মানুষকে আশাবাদী করে তুলবে। বাংলাদেশে টেলিকমিউনিকেশন সেক্টরটি এই গত দশকেও সম্পূর্ণ অবহেলিত ছিল। বিগত সরকারের আমলে বাংলাদেশের পাশ দিয়ে যাওয়া আনত্মর্জাতিক সাবমেরিন কেবলে বাংলাদেশের যোগদান প্রসঙ্গে সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রীর ধারণা ছিল যে, যদি বাংলাদেশ এই সাবমেরিন কেবলে যোগ দেয় তাহলে বাংলাদেশের তথ্যাদি পাচার হয়ে যাবে। যদিও ভারত সে সময় এই কেবলে যোগ দেয় এবং তার ষোলআনা সুযোগ নিয়ে আজ পৃথিবীর অন্যতম তথ্যপ্রযুক্তির দেশ হিসেবে খ্যাত। যাই হোক পরবর্তীতে বাংলাদেশ এই কেবলে যোগ দিলেও টেলিকমিউনিকেশন সম্পর্কিত ধারণা এখানে বিগত জোট আমলেও তেমন আলোচিত ছিল না। অথচ এখন আধুনিকতা মানেই হচ্ছে 'কানেকটিভিটি', এর মানে হচ্ছে আধুনিক, উন্নত এবং কম সময়ে যোগাযোগ, এর ওপরই নির্ভরশীল দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি। কিন্তু বাংলাদেশ যে এেেত্র বেশ পিছিয়ে আছে সেটা বলাই বাহুল্য বিশেষ করে এই খাতটিকে সরকারের অবহেলিত খাত হিসেবেই চিহ্নিত করা হতো এই কিছুদিন আগ পর্যনত্মও। কিন্তু বুদ্ধিমান মানুষ মাত্রেই বুঝবেন এই খাতের গুরম্নত্ব কতটুকু।
বর্তমান সরকার মতায় আসার আগে যখন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দিয়েছিল তখন অনেকেই সন্দেহ পোষণ করতে শুরম্ন করেছিলেন যে, এই সেস্নাগানও কেবলমাত্র একটি সেস্নাগানই থেকে যাবে না তো? তবে নতুন প্রজন্ম এই সেস্নাগানে বিশ্বাস করে তাদের সম্পূর্ণ সমর্থন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটের প েপ্রদান করে। বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করার পর থেকেই দেখা যায় যে, বর্তমান সরকার টেলিকমিউনিকেশন খাতটিকে বেশ গুরম্নত্বের সঙ্গেই গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে টেলিকমিউনিকেশনের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু একজন সজ্জন, জনপ্রিয় নেতাই নন, তিনি যে তথ্যপ্রযুক্তিকে জাতীয় উন্নতির সূচক হিসেবে ধরে নিয়ে অসম্ভব পরিশ্রমী একজন সংগঠকও তার প্রমাণ পাওয়া যায় অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি যেভাবে এই সেক্টরটিকে আয়ত্তে এনেছেন এবং ঢেলে সাজিয়েছেন তার প্রমাণ দেখে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজিউদ্দিন রাজু প্রবেশ করেছিলেন 'হাংরি জেনারেশন'-এর যুগে 'এ্যাংরি ইয়ংম্যান' ইমেজ নিয়ে। তিনিই এখন পরিণত বয়সে এমন একটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়েছেন যার সঙ্গে দেশের ভবিষ্যত সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। তিনিই যখন জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের সেক্রেটারি জেনারেলের সামনে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সদ্য যোগদানকারী সজীব ওয়াজেদ জয়কে 'ডিজিটাল ভিশন' উপস্থাপনের সুযোগ করে দেন তখন আমাদের বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আসলেই গুণগত কিছু পরিবর্তন এসেছে। এবং অদূর ভবিষ্যতে রাজনীতি সম্পূর্ণ নতুন একটি অবয়ব ধারণ করতে যাচ্ছে, যার মূল প্রতিপাদ্য হবে 'কানেকটিভিটি'-এর শাব্দিক অর্থের মতোই একে যে যেভাবেই ভাবুন না কেন, এই সংযোগের ওপরই নির্ভর করছে আধুনিক বাংলাদেশের ভিত্তি। বিশেষ করে বাংলাদেশকে সম্পূর্ণভাবে দ্রম্নত গতির ইন্টারনেট সুবিধার আওতায় আনতে না পারলে আমাদের উন্নয়ন যে তিমিরে ছিল সেখানেই রয়ে যাবে। আশার বিষয় যে, এই ব্যাপারটি বর্তমান সরকার গুরম্নত্ব দিয়ে উপলব্ধি করেছে এবং এ নিয়ে কাজ করছে।
রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর আয়োজনে ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের সেক্রেটারি জেনারেলের অনুষ্ঠানে জয় প্রদত্ত ভাষণকে আমরা যদি তার ভবিষ্যত রাজনীতির রূপরেখা হিসেবে ধরে নিই তাহলে আমাদের আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ থেকে যায়। বিশেষ করে, আমরা এমন এক দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি যে, এই সময়টিকে যদি যথাযথ ব্যবহার না করা যায় তাহলে আমাদের ভবিষ্যত বিপর্যয়কে ঠেকানো যাবে না কোনভাবেই। সেটা কীভাবে? একটু বিশদ বলার প্রয়োজনবোধ করছি এখানে। স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স আর কিছুদিন পরেই চলিস্নশ ছুঁবে। মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম এখন বলতে গেলে বৃদ্ধ এবং অবসরপ্রাপ্ত। স্বাধীনতার পর থেকে সমাজে, রাষ্ট্রে এবং মানুষের মাঝে যে সব বিরূপ স্রোত সক্রিয় ছিল তারা এখন পরিণত হয়েছে বহুদিক থেকে। যেমন আমরা বলতে পারি বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী এবং ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির কথা। এরা ইতোমধ্যেই রাষ্ট্রমতার স্বাদ পেয়েছে এবং এখন তারা সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশকে দখল করতে চাইছে। আনত্মর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের চরিত্র হিসেবে বলা হচ্ছে 'মডারেট মুসলিম কান্ট্রি' কিন্তু বাংলাদেশের জন্ম-পরিচয়ের সঙ্গে এই আরোপিত পরিচয়ের কোন মিল নেই। যে আদর্শ বাঙালীকে পাকিসত্মানের বিরম্নদ্ধে অস্ত্র ধরতে বাধ্য করেছিল তা নানাভাবে ভূলুণ্ঠিত। রাষ্ট্রযন্ত্র যারা চালিয়েছে তারাই এই ভূলুণ্ঠনের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে এবং সেই সুযোগে রাষ্ট্রের ভেতরে নতুন নতুন বিরম্নদ্ধ শ্রোতের জন্ম নিয়েছে। আজকে জেএমবি, হুজি ইত্যাদি সব উগ্রবাদী সংগঠন রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েই এই পর্যায়ে এসে গোটা রাষ্ট্রকেই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। এর সঙ্গে আজ বাঙালী জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে তথাকথিত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী এই বিভ্রানত্ম প্রজন্মই এখন দেশের কর্ণধার। যেহেতু এই বিভ্রানত্মি সামষ্টিক সেহেতু এর সমাধানও হতে হবে সামষ্টিক, এখানে ব্যক্তির ভূমিকা সামান্যই। এবং বলাই বাহুল্য যে, আজকের বাংলাদেশে আমরা যে সমস্যাটিকে বলতে চাইছি জাতীয় সমস্যা তা আর কিছুই নয়, এই বিভ্রানত্মি, সামগ্রিকতার অভাব এবং রাষ্ট্রের চেয়ে দল ও জাতির চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দেয়ার অপকৌশল। এর সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্রের ভেতরকার অপস্রোতগুলো মরণকামড় দিতে উদ্ধত। এই অপস্রোতের মূল পুঁজি হচ্ছে অশিা, দারিদ্র্য, অসচেতনতা এবং সর্বোপরি আদর্শহীনতা। আর এর থেকে মুক্তিরও পথটি হচ্ছে এগুলো থেকে বেরিয়ে আসার কৌশল নির্ধারণে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সর্বাত্মক ব্যবহার। আমি মনে করি যে, সেদিক দিয়ে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সেদিনকার বক্তৃতাটি ছিল আধুনিক বাংলাদেশের ভবিষ্যত রূপকল্প। যদি এর অর্ধেকও কিছুটাও বর্তমান সরকার বাসত্মবায়ন করতে পারে তাহলে তা হবে বাংলাদেশের জন্য এক অভূতপূর্ব ঘটনা।
মজার ব্যাপার হলো, সজীব ওয়াজেদ জয় বা শেখ হাসিনা যে 'কানেকটিভিটির' কথা বলছেন, তা আসলে সমাজকে, ব্যক্তিকে দল-মত নির্বিশেষে সংযুক্ত করার স্বপ্ন দেখায়। বাংলাদেশের বর্তমান বাসত্মবতায় এর বিকল্প কিছুই হতে পারে না, কারণ আগেই বলেছি যে, মানুষ বিচ্ছিন্ন, সমাজ বিচ্ছিন্ন, এমনকি রাষ্ট্রও বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির চিনত্মা-চেতনা থেকে। মানুষের সামনে কোনও স্বপ্ন নেই, নেই কোনও রূপকল্প। মানুষ নিজেই নিজের মতো এগুনোর চেষ্টা করছে এবং যে যেভাবে পারছেন সুযোগ খুঁজছেন টিকে থাকার, এগিয়ে যাওয়ার। এখানেই সামগ্রিকতার অভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদ, উগ্রবাদ আর আদর্শহীনতার রাজনীতি শক্তিশালী হওয়ার পস্ন্যাটফরম খুঁজে পেয়েছে। যে সীমাহীন দুর্নীতি বিগত বছরগুলোতে গোটা দেশটাকে একটা খোলশে পরিণত করেছে তা ঠেকানোর জন্যও আমাদের আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা গ্রহণ জরম্নরী হয়ে পড়েছে। আমরা আশাবাদী যে, রাজনীতিতে যোগদান করেই সজীব ওয়াজেদ জয় দুর্নীতি প্রতিরোধে, দেশের সম্পদ লুট ঠেকানোর কৌশল হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগানোর ঘোষণা দিয়েছেন। 'বৃ তোমার নাম কি ফলে পরিচয়', কিন্তু বৃ ফল দেয়ার উপযুক্ত হওয়ার আগ পর্যনত্ম সেটা জানা সম্ভব নয়, কিন্তু আমরা যদি আগে থেকেই জানি যে, যে বীজটি বপন করা হচ্ছে তা আসলে একটি নির্দিষ্ট ফলের তাহলে বৃরে নাম জানার জন্য আর ফল দেয়া পর্যনত্ম অপোর দরকার হবে না। আমরা এখন জানি যে, আমাদের একটি 'ডিজিটাল ভিশন' আছে এবং এই রূপকল্পের নিরিখে কাজ করবে সরকার এবং সে কারণেই আমরা একটি ভাল ফলও আশা করতে পারি, কারণ আমরা জানি যে, আমরা কি 'ইনপুট' দিচ্ছি, অতএব 'আউটপুট' নিয়ে আশাবাদী হওয়াই যায়। জয় আমাদের আশাবাদী করে তুলছেন, একথা তাই নির্দ্বিধায়ই বলা যায়।

ঢাকা, ৫ মার্চ, শুক্রবার। ২০১০।
সধংঁফধনযধঃঃর@যড়ঃসধরষ.পড়স

No comments

Powered by Blogger.