জীবন কথন- একাত্তর শোকের একাত্তর পাথার- রণজিৎ বিশ্বাস

ওরা বললো রোদনে শব্দেআমরা বললাম, আমাদের হৃদিমধ্যে। ওরা শহীদ পরিবারের সদস্য। কেউ ভ্রাতা, কেউ পিতা, কেউ সহকর্মী, কেউ পুত্র; যারা কেঁদে কেঁদে এসব বলছিল, তাদের মধ্যে ছিল শহীদদের জায়াজননীকন্যা ভগিনী। তাদের ওপর সরাসরি নির্ভরশীল ও ঘনিষ্ঠজনেরা।
কী বলছিল তারা! অশ্রুবাষ্পে ঝাপসা হয়ে যাওয়া চশমা চোখের 'পরে নিয়ে লে. কর্নেল শামছুল আজমের কবর ছুঁয়ে তার স্ত্রী মুনমুন আখতার পুত্র জিসানকে পাশে নিয়ে কাঁদছিলেন। হাহাকার করছিলেন কাঁদতে কাঁদতে; আর আমাদের বুকে ছোটছোট ও তীব্রতীব্র ঘা দিয়ে বলছিলেন_ কাউকে কিছু বলি না আমি, কাউকে কিছু বলি না। শুধু নিজের মনে নিজেকে বুঝ দিই। মেজর মোমিনের প্রাণ ওরা কেড়ে নেয়ার এগারো দিন পর জন্ম নিয়েছিল তার প্রথম সন্তান। সর্বশেষে মমতাঠাসা মায়ের দেহের ভেতরে থেকে যে পেয়েছিল সংসারের সবচেয়ে বড় বঞ্চনা, বড় প্রতারণা,অভাবনীয় নিষ্ঠুরতা_ পাথর গলিয়ে কান্না নামানো টোল পড়া গালের ও হাসিমাখা মুখের সেই সনত্মানকে পাশে নিয়ে মোমিনের স্ত্রী বলছিলেন_ একেবারে কেটে এসেছে ওর বাবাকে বাবার ডুপিস্নকেট। একেবারে বাবার ছবি, বাবার মতই ওর 'বকা' দেয়ার ভঙ্গি। আমি ওর বাবার সঙ্গে মনে মনে কথা বলি। একা একা। বলি দেখো, তোমার ছেলেকে দেখো। তুমি কি দেখতে পাচ্ছো, ও ঠিক তোমার মত হয়েছে। ঠিক তোমার মত। মেজর তানভীর এর স্ত্রী তাসনুভা। স্বামীর শেষ চিহ্নটুকু দেখার ভাগ্যও তার হয়নি। ডিএনএ টেস্ট যাকে চিনিয়ে দিয়েছে তার তানভীর হিসেবে, তিনিও শহীদ, তিনিও কারও না কারও বুক খালি করেছেন, কিন্তু কে জানে তিনি কে। বিজ্ঞান তাকে বলেছে এই যে যাকে চেনা যাচ্ছে না, আমরা পরীৰা করে বলছি_ খাঁচাটির মাঝেই তোমার স্বামীর ও তোমার ছেলেদের বাবার প্রাণ নড়তো চড়তো।
তিনি বলছিলেন তার ছেলে শুধু বাবার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে। মাঝ রাতে ঘুম ভাঙ্গার পর তিনি দেখেন, তার ছেলে তাকিয়ে আছে বাবার ছবির দিকে।
কত কষ্ট বুকে চেপে যে তিনি বলেন তুমি যদি অমন কর, তোমার বাবার সব ছবি আমি খুলে রাখবো, সংসারের সবচেয়ে নিষ্ঠুর মানুষটিরও বোঝার কথা। ছেলে বলে আমি কি করবো মা। বাবাতো মা নড়াচড়া করে না, সামনেও আসে না। কথাও বলে না।
এক মা বলছেন ওর বাবা ওকে এ,বি,সি,ডি লিখতে শিখিয়েছিল। এখন সবাইকে তাই শুধু বলে বেড়ায় বাবা আমাকে এই শিখিয়েছে, সেই শিখিয়েছে। বাবা আমাকে এ,বি,সি,ডি শিখিয়েছে।
সেই মায়ের বয়সী আরেক মা বলছেন আলস্নাহ ভালো করতেন, যদি আমাকেই নিয়ে যেতেন, তখন ও শুধু তার মাকে পেতো না, ওর বাবা দুনিয়ার সব সুখ সাচ্ছন্দ্য ওকে দেয়ার চেষ্টা করতেন। এখন আমি না পারছি ওকে বাবা দিতে, না কোন সুখ সাচ্ছন্দ্য দিতে।
জেনারেল শাকিল -এর ছেলে এখনও কিশোর, এখনও লাজুক। সে একই সঙ্গে বাবাকেও হারিয়েছে, মাকেও। মায়ের হাতের পোলাও ওর খুব ভালো লাগতো। সেই ছেলে বলছে ওদের ফাঁসি হতে হবে, সাত বছরের কারাদ-ে কিছুই হবে না।
ওর চেয়ে একটু বেশি বয়সী, অথবা হয়তো ওর বয়সীই কর্নেল এলাহীর (কর্নেল শফিকুর রহমান কুদরত-ই-এলাহী) একটি ছেলে ছিল। সাকিব ইলাহী আর লবী রহমানের একমাত্র ছেলে। ছেলেটিকে টিভি ফ্রেম এ পেলাম না, পেলাম লবী রহমানকে। বলছেন তিনি কুড়িটি বছর কত ছোট ছোট পরিকল্পনাইতো ছিল এই সংসারকে সাজাবার। কত স্বপ্নইতো ছিল। সবইতো শেষ হয়ে গেলো একটি মাত্র গুলিতে।
আরেক বাড়িতে পিতৃহারা একটি শিশু চারটিমাত্র শব্দে মৃদু উচ্চারণে জাতির কাছে সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নটি ছুড়ে দিয়েছে-ওরা কী করলো এসব।
এমন করে ধরে ধরে আর কতজনের কথা বলা যাবে। একাত্তর জনের কথাতো একাত্তর রকম। একাত্তর পরিবারকে একাত্তর রকমের কান্নার সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে ঘাতকেরা। যাদের অর্ডার তারা তামিল করেছে, মানুষ হিসেবে সর্বনিকৃষ্ট ধাপে নেমে গিয়ে ওরা পশুকেও লজ্জা দিয়েছে। ভাবেনি যে আমারও ভাই আছে, আমারও স্ত্রী আছে, আমারও ছেলেমেয়ে আছে। আমার ঘরেও আমার স্ত্রীর দেহের ভেতর আমার প্রথম সনত্মানের ভ্রূণ থাকতে পারে।
এমন হৃদিবৃত্তিক মানবিক বিবেচনা যুদ্ধের সময় থাকে না। কারণ, যুদ্ধের দাবি অন্যরকম, যুদ্ধের দাবি ভিন্ন রকম। আমরা কার সঙ্গে যুদ্ধ করলাম। মন যদি আমাদের ৰোভের ভাটা হয়ে বসে থাকে, যদি তাতে চাঁই চাঁই আঙরা জ্বলতেও থাকে, বিডিআর জওয়ানদের হাতে যা আমরা হতে দেখেছি, তার প্রস্তুতিতো কারও থাকে না।
একটা পরিসংখ্যান চোখে পড়েছে বিডিআর এর অন্ধাতি অন্ধ 'ব্রেইন-ওয়াশড' অসৈনিকরা একবছর আগে, ২৫ ফেব্রম্নয়ারি একদিনে যা করেছে, কোন যুদ্ধে কিংবা মহাযুদ্ধেও তা একদিনে হয়নি। সেদিন প্রাণ হারানো ৭১ জনের মধ্যে ৫৭ জন ছিল সেনাকর্মকর্তা, তাও আবার ক্যাপ্টেন থেকে জেনারেল পর্যনত্ম সকল পদসোপানের। একদিনে ৫৭ জন অফিসারের, দেশের ৫৭ জন বিশিষ্ট সনত্মানের এমন প্রাণপরিণতি আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ও হয়নি। নয় মাসে আমরা হারিয়েছিলাম ৫৯ জন অফিসার।
এই হত্যাকা- যদি হয় টিপ অভ দ্য আইসবার্গ (জলমধ্যে লুক্কায়িত বরফখ-ের দৃষ্টিগ্রাহ্য শীর্ষ দেশ), হতে পারে। আমাদের বিশ্বাস জাগে। যদি থাকে এর পেছনে কোন ষড়যন্ত্রীছক, থাকতে পারে। আমাদের বিশ্বাস জাগে। যদি থাকে সমাজে সংসারে অস্থিরতা সৃষ্টির মহাঘৃণ্য কোন পরিকল্পনা, থাকতে পারে। আমাদের বিশ্বাস জাগে। কারণ, আমাদের এই সুন্দর দেশে মানবায়ব অনেক প্রাণী আছে কীটানুকীটের মত। তারা এসব করতে পারে।
কিন্তু, এই পাশবেতর প্রাণীগুলোর যথাপ্রাপ্য পেতে দেখায় অস্থির হয়ে ওঠা মন কিছুতেই মানতে চাচ্ছে না যে শহীদের অতগুলো আত্মা কোনভাবে অপমানিত হবে। নিদের্াষের শাসত্মি হোক চাই না, দোষী তার প্রাপ্যবঞ্চিত হোক তাতো একেবারেই চাই না। একেবারেই না, কোনভাবেই না। তাতে শোকের অতগুলো ৰত শুকোবে না, প্রশমিত যদি হয়।
লেখক : কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.