নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির জন্য সিন্ডিকেট দায়ী- ৬৩ %ব্যবসায়ীর অভিমত ॥ গবেষণা রিপোর্ট আজ প্রকাশ by মিজান চৌধুরী

নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির নেপথ্যে ৬৩ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন সিন্ডিকেট দায়ী। গুটিকয়েক বড় কোম্পানি সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছে। তবে ৭১ শতাংশ ব্যবসায়ীর মতে, চাহিদা অনুযায়ী বাজারে পণ্যের সরবরাহ কম থাকায় দাম বাড়ছে।
দাম বাড়ার জন্য ৫৬ শতাংশ ব্যবসায়ী দায়ী করেন সরকারের পরিকল্পনার ঘাটতিকে এবং ৩৭ শতাংশ ব্যবসায়ী ঘুষের কারণও মনে করছেন। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ও বেসরকারী সংস্থা মাইডাস যৌথভাবে পরিচালিত বাজারের ওপর সম্প্রতি এক গবেষণা থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। ওই গবেষণা পত্রটি আজ রবিবার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে।
নিত্যপণ্যের দাম কেন বাড়ছে এ ব্যাপারে আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ব্যবসায়ীদের মতে, বাজারে চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি, অধিক পরিবহন খরচ, ঘুষ প্রদান, সরকারের পরিকল্পনায় ঘাটতি, আনত্মর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অধিক মুনাফার প্রবণতা, মজুদ প্রবণতা, অপর্যাপ্ত পরিবহন ব্যবস্থা, মধ্যস্বত্বভোগীদের তৎপরতা বৃদ্ধি ও আমদানি পণ্যের মূল্য বাড়ানোর কারণে জিনিসপত্রের বাজারে অস্থিরতা বিরজা করছে।
এদিকে পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহের অব্যবস্থাপনার কারণেও দাম বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমান নিত্যপণ্য চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম হচ্ছে। বিশেষ করে বছরে চালের চাহিদা হচ্ছে ৩ কোটি ৩৪ লাখ ৫৮ হাজার মেট্রিক টন। কিন্তু স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হচ্ছে ২ কোটি ৮৯ লাখ ৩১ হাজার টন। চালের ঘাটতি হচ্ছে ৪৫ লাখ ২৭ হাজার মেট্রিক টন। পিঁয়াজের চাহিদা হচ্ছে ১০ লাখ ৮৫ হাজার টন। ওই চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হচ্ছে ৮ লাখ ৮৯ হাজার মেট্রিক টন। ঘাটতি হচ্ছে এক লাখ ১১ হাজার টন। সয়াবিন তেলের চাহিদা হচ্ছে ৭ লাখ ৪২ হাজার মেট্রিক টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হচ্ছে ৫৯ হাজার মেট্রিক টন। সয়াবিনের ঘাটতি হচ্ছে ৬ লাখ ৮৩ হাজার টন। ডালের বার্ষিক চাহিদা হচ্ছে ৬ লাখ ৩ হাজার মেট্রিক টন। ওই চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হচ্ছে ২ লাখ ৪ হাজার টন। ঘাটতি হচ্ছে ৩ লাখ ৯৯ হাজার টন। এভাবে পণ্যেও চাহিদার তুলনায় ঘাটতি রয়েছে। ওই ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে বিদেশ থেকে আমদানির মাধ্যমে। এই সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে গড়ে উঠেছে অতিমুনাফার প্রবণতা।
অতিমুনাফার প্রবণতা ॥ গবেষণায় দেখা গেছে, পণ্য বিক্রি করে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ মুনাফা করছে পাইকারি পর্যায়ের ৫ শতাংশ, উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ও খুচরা পর্যায়ে ৩০ শতাংশ ব্যবসায়ী। বাজার থেকে ১০ শতাংশ মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে পাইকারি পর্যায়ে ৫ শতাংশ, উৎপাদন পর্যায়ে ২৫ শতাংশ ও খুচরা পর্যায়ে ৪০ শতাংশ ব্যবসায়ী। একইভাবে আট শতাংশ মুনাফা করছে পাইকারি পর্যায়ের ১৮ শতাংশ, খুচরা পর্যায়ে ৪০ শতাংশ ও উৎপাদন পর্যায়ে ১০ শতাংশ ব্যবসায়ী। ৫ শতাংশ মুনাফা করছে খচুরা পর্যায়ের ৩০ শতাংশ, পাইকারি পর্যায়ে ৪৫ শতাংশ ও উৎপাদন পর্যায়ে ৩০ শতাংশ ব্যবসায়ী।
সিন্ডিকেট ॥ ব্যবসায়ীরা নিজেরাও মনে করে সিন্ডিকেট করে জিনিসপত্রের দাম বাড়ানো হচ্ছে। পণ্যেও পাইকারি পর্যায়ে ১৭ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করছে সিন্ডিকেটের কারণে দাম বাড়ছে। তবে উৎপাদন পর্যায়ে ১৭ শতাংশ ও খুচরা পর্যায়ে ২০ শতাংশ এবং আমদানিকারক পর্যায়ে ৯ শতাংশ ব্যবসায়ীরাও মনে করেন জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির পিছনে সিন্ডিকেটই দায়ী।
ঘুষ প্রদান ॥ পণ্য আমদানি, পণ্য সরবরাহ, রাসত্মাসহ বিভিন্ন স্থানে ঘুষ দিয়ে পণ্য খালাস করতে হয়। এ জন্য উৎপাদন পর্যায়ে ১৬ শতাংশ উদ্যোগ মনে করেন ঘুষের কারণেও পণ্যের দাম বাড়ছে। তবে ঘুষ দেয়ার কারণে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি হচ্ছে পাইকারি ব্যবসায়ীদের মধ্যে ৫ শতাংশ, আমদানিকারক পর্যায়ে ৯ শতাংশ ও খুচরা পর্যায়ে ৭ শতাংশ ব্যবসায়ী মত দিয়েছেন।
পণ্য সরবরাহ কম ॥ চাহিদা অনুযায়ী অনেক পণ্য বাজারে কম সরবরাহ করা হয়। অনেক ৰেত্রে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পণ্য বাজারে কম সরবরাহ করা হয়। বাজারে পণ্য সরবরাহ কমের কারণে দাম বাড়ছে ২০ শতাংশ পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান। একই কারণে দাম বাড়ছে বলে জানান, খুচরা পর্যায়ে ১৭ শতাংশ, আমদানি পর্যায়ে ১৮ শতাংশ ও উৎপাদন পর্যায়ে ১৬ শতাংশ ব্যবসায়ী।
সরকারের পরিকল্পনার ঘাটতি ॥ জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির পিছনের সরকারের পরিকল্পনার ঘাটতিকে দায়ী করেছেন ব্যবসায়ীরা। পাইকারি পর্যায়ে ১১ শতাংশ, উৎপাদন পর্যায়ে ১৭, খুচরা ১৫ ও আমদানি পর্যায়ে ১৩ শতাংশ ব্যবসায়ীর মত হচ্ছে সরকারের সঠিক পরিকল্পনা নেই।
মজুদ প্রবণতা ও আমদানি সমস্যা ॥ পণ্য আমদানিগত সমস্যার সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি একশ্রেণীর ব্যবসায়ী পণ্য মজুদ করার কারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাচ্ছে। পাইকারি পর্যায়ে ৫ শতাংশ, উৎপাদন পর্যায়ে তিন, খুচরা পর্যায়ে এক ও আমদানি পর্যায়ে ২ শতাংশ ব্যবসায়ী এ মত দিয়েছেন।
ওই গবেষণায় বলা হয় বাজার স্থিতিশীল করতে হলে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটটে চিহ্নিত করে এফবিসিসিআইকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মার্কেট চেইনকে আরও উন্নত করতে হবে। মূল্য নিয়মিত মনিটরিং করা এবং পিপিপির মাধ্যমে সরকার ও বেসরকারী এ খাতে কাজ করতে হবে। এছাড়া স্থানীয়ভাবে উৎপাদন বাড়ানো, অধিক মুনাফা আদায়ের ব্যাপারে মনিটরিং জোরদার, সঠিকভাবে সরকারের মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনা ও ব্যবস্থা গ্রহণ, সরকারের নগদ সহায়তা প্রদান, সময়মতো পণ্য আমদানি এবং মূল্য নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা বাড়াতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.