বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ' চিত্রকর্ম ৭ বছর অন্ধকারে- তালাবদ্ধের কাহিনী বলতে গিয়ে শিল্পী হাশেম খান আবেগাপস্নুত by নিখিল মানখিন

সাত বছর ধরে অন্ধকারে পড়ে আছে অমূল্য চিত্রকর্ম 'বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ'। এ চিত্রকর্মটি আঁকেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী হাশেম খান। চারদলীয় জোট সরকার 'মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ গবেষণা ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম' বন্ধ করে দিলে এ চিত্রকর্মটি বসত্মাবন্দী হয়।
দীর্ঘদিন অযত্নে থাকায় এ চিত্রকর্মসহ ইনস্টিটিউটের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন সংগ্রহ নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে ৰমতায় আসার পর ইনস্টিটিউটটি পুনরায় চালু করার কাজে হাত দিয়েছে বর্তমান সরকার। বিভিন্ন সংগ্রহের তালিকা তৈরি করছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপৰ। কিন্তু সব ক'টি সংগ্রহ অৰত থাকার ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিতে পারেনি তারা।
আজ রবিবার ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (রেসকোর্স ময়দান) আজকের এ দিনে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর দীপ্ত ভাষণের ওপর একমাত্র ওই অমূল্য চিত্রকর্মটি অাঁকেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী হাশেম খান। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার দ্বারা ওই চিত্রকর্মটির তালাবদ্ধ হওয়ার কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি হাশেম খান। চিত্রকর্মটির করম্নণ পরিণতি জানানোর পাশাপাশি তিনি এর মর্মার্থ জনকণ্ঠের কাছে তুলে ধরেন। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভাষণ। ২৩ বছরের সংগ্রাম শেষে বঙ্গবন্ধু ঠিকই বুঝেছিলেন, এবার বাঙালীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিতে হবে। সশস্ত্র যুদ্ধ ছাড়া নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে স্বাধীনতা আসবে না। তাই ৭ মার্চে তিনি চূড়ানত্ম ঘোষণা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন সকলকে প্রস্তুত থাকতে। বাংলার প্রতিটি ঘরকে দুর্গে পরিণত করতে বলেছিলেন। আমার চিত্রকর্মে ৭ মার্চের ভাষণের চেতনার এ সব দিক প্রাধান্য পেয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সকলের পরিচিত মুখ। দেশবাসীর হৃদয়ে তিনি। তাই আমি চিত্রকর্মে বঙ্গবন্ধুর চেহারা না দিয়ে ভাষণের চেতনামূলক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমার চিত্রকর্মে রয়েছে-বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে একজন মা তার প্রিয় সনত্মানের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন। এই মা হচ্ছে দেশ এবং তরম্নণ ছেলেটি হচ্ছে আপামর জনতার প্রতীক। চিত্রকর্মটির পটভূমিতে রয়েছে লাঙল, জোয়াল, কাসত্মে, কুড়াল, কুদাল_যেগুলো বাঙালীর চিরনত্মন হাতিয়ার। আর সব হাতিয়ার ব্যবহার করা হয়েছে যেকোন অশুভ শক্তিকে রম্নখে দেয়ার জন্য। তিনি আরও জানান, চিত্রকর্মটিতে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর সেই অমোঘ উচ্চারণ_"ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল-তোমাদের যা কিছু আছে তা দিয়ে শত্রম্নর মোকাবেলা করতে হবে। মনে রেখো_রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো_এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশালস্নাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। এই অমূল্য চিত্রকর্মটির করম্নণ পরিণতি জানাতে গিয়ে শিল্পী হাশেম খান বলেন, দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে কাজ করার পর আমি এই চিত্রকর্মটি আঁকা সম্পন্ন করি। বছরের পর বছর ধরে ড্রয়িং ও স্কেচ করতে হয়েছে আমাকে। গত ২০০০ সালে এই চিত্রকর্মটির কাজ শেষ হয়। ওই বছরেই জাতীয় জাদুঘরে অনুষ্ঠিত আমার একক চিত্রমেলায় সবচেয়ে আকর্ষণ ছিল 'বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ' চিত্রকর্মটি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপৰ বিপুল আগ্রহ নিয়ে মেলা থেকে আমার ওই চিত্রকর্মটি সংগ্রহ করে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ওই সময় 'মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ গবেষণা ইনস্টিটিউট' নামে একটি প্রকল্পের কাজ শুরম্ন করে। ইনস্টিটিউটের সম্মানি পরিচালক ছিলেন অধ্যাপক মুনতাসির মামুন। আর ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। এই ইনস্টিটিউটের সংশিস্নষ্টরা অনেক মেধা, শ্রম ও সময় দিয়ে আমার চিত্রকর্মসহ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনেক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেন। সেগুলোর মধ্যে ছিল ১৯৭১ সালের দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকা, আলোকচিত্র, শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত বিভিন্ন পোশাক ও জিনিসপত্র ইত্যাদি। কিন্তু ২০০১ সালের শেষ দিকে বিএনপি-জামায়ত সরকার ৰমতায় এসেই ইনস্টিটিউটের সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। ইনস্টিটিউটের পরিচালক মুনতাসির মামুনসহ প্রো-ভিসি অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান ও সংশিস্নষ্ট অনেককে তদনত্মের নামে হয়রানি করা হয়। আর 'বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ' চিত্রকর্মসহ ইনস্টিটিউটের সব সংগ্রহ ফেলে দেয়া হয় অন্ধকার কৰে। বর্তমান সরকারের কাছে ইনস্টিটিউটটি চালু করাসহ মু্িক্তযুদ্ধভিত্তিক সংগ্রহগুলো সাধারণ মানুষের দর্শনের সুযোগ করে দেয়ার জোর দাবি জানান শিল্পী হাশেম খান।
এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যৰ অধ্যৰ কাজী ফারম্নক আহমেদ শনিবার জনকণ্ঠকে জানান, মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সংস্কার কার্যক্রম শুরম্ন হয়েছে। এই ইনস্টিটিউটটি বন্ধ করে দিয়েছিল চারদলীয় জোট সরকার। অবহেলায় ফেলে রাখা হয় ইনস্টিটিউটের জন্য সংগৃহীত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনেক তথ্য-উপাত্ত। এ সব সংগ্রহ ইতোমধ্যে রাজধানীর মোহাম্মদপুর ইনস্টিটিউটের অস্থায়ী কার্যালয় থেকে গাজীপুরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্থানানত্মর করা হয়েছে। ইনস্টিটিউটটির মূল ক্যাম্পাস নির্মাণের কাজ চলছে গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায়। সেখানে রয়েছে ৪ একর জমিতে তিনতলা বিশিষ্ট ভবন। আরও ১৫ একর জমির বন্দোবসত্ম হচ্ছে। সেখানে দেয়া হয়েছে বিদু্যত সংযোগ। তিনি বলেন, অনেক কিছু নষ্ট করে গেছে চারদলীয় সরকার। গুছিয়ে আনতে একটু সময় লাগবে। শিল্পী হাশেম খানের অাঁকা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ' চিত্রকর্মটি রৰিত রয়েছে। তবে সব ক'টি তথ্য-উপাত্ত ঠিক মতো রয়েছে কিনা তা এখনো বলা যাবে না। সংগ্রহগুলোর তালিকা তৈরি হচ্ছে। আগামী ৬ মাসের মধ্যে ইনস্টিটিউটটি পুনরায় চালু করা যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

No comments

Powered by Blogger.