নারীর চেয়ে পুরুষ শ্রমিকের আয় ৭২% বেশি- কর্মসংস্থানে লিঙ্গবৈষম্য ১ by শাহ আলম খান

পূর্ণ মানব মর্যাদায় জীবনযাপন নারীর অবিচ্ছেদ্য অধিকার। তবে পুরুষকে বাদ দিয়ে নয়, পুরুষের পাশাপাশি। এই মৌলিক চেতনা জাতিসংঘ ঘোষিত সর্বজনীন মানবাধিকার সনদে রৰিত আছে।
বাংলাদেশের সংবিধানেও এর ব্যতিক্রম নয়। অন্যদিকে রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বৰেত্রে এবং সত্মরে নারীর অগ্রগতি ও সম অধিকার নিশ্চিত করাও একটি দেশের সুস্থ, টেকসই সমাজ গঠনের অত্যাবশ্যক শর্ত।
বাংলাদেশ সংবিধানের ২৮(১) ধারায় বলা হয়েছে_ 'কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না।'
২৮(২) ধারায় বলা হয়েছে_ 'রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বৰেত্রে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করবেন।'
সংবিধানের ধারা বিবেচনা করা হলে সঙ্গত কারণেই নারীদের অবদান কোন অংশেই পুরম্নষের চেয়ে খাটো করে দেখা চলে না। তবে বাস্তবতা হচ্ছে রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে আদৌ তার বালাই নেই। আধুনিকায়ন ও নারী উন্নয়নের যুগেও এদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও সমাজ-সংস্কৃতিতে নারী তার অধিকার, আত্মমর্যাদা রৰা ও প্রাপ্তির ৰেত্রে প্রতিনিয়ত পদদলিত হচ্ছে। বিশেষ করে কর্মসংস্থানে নারী-পুরম্নষের এই লিঙ্গ বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করছে।
একই পারিশ্রমিকের কাজে আয়ের ৰেত্রে পুরম্নষের তুলনায় নারী শ্রমিকের প্রাপ্তি অপমানজনক। গ্রাম অঞ্চলে নারী শ্রমিক পুরম্নষ শ্রমিকের তুলনায় ৮০ শতাংশ মজুরি কম পায়। শহরাঞ্চলেও এই পার্থক্যের হার শতকরা ৪৫ শতাংশ। পুরম্নষ শ্রমিকরা নারী শ্রমিকের চেয়ে গড়ে ৭২ শতাংশ বেশি আয় করে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের উদ্যোগে পরিচালিত বাংলাদেশের উন্নয়ন পর্যালোচনা (আইআরবিডি) সংক্রানত্ম এক গবেষণায় নারী শ্রমিকদের স্বল্প মজুরির জন্য দায়ী করা হয়েছে বিভক্ত শ্রমবাজার এবং 'ক্রাউডিং ইন প্রভাব' বা ভিড় করার প্রবণতাকে। এই ৰেত্রে গবেষকদের যুক্তি মহিলারা স্বল্পশিৰিত কিংবা অপেৰাকৃত কম দৰ হওয়ায় কেবল কিছু নির্দিষ্ট পেশায় এসেই ভিড় করছে। এদের অধিকাংশের পদবিই অধসত্মন পর্যায়ের। ফলে একদিকে যেমন পেশাগুলোর মজুরি হ্রাস পাচ্ছে তেমনি সমগ্র অর্থনীতি জুড়ে মহিলা শ্রমের সরবরাহ মূল্যের অবনতি ঘটছে। এ কারণে নির্দিষ্ট পেশার চাহিদা অতিরিক্ত শ্রমিক থাকায় মজুরি হ্রাসের পাশাপাশি স্বল্প সময়ের কাজ পাচ্ছেন এমন শ্রমিকের সংখ্যাও বাড়ছে।
অপর একটি বেসরকারী সংস্থার পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিতদের ৰেত্রে মাসিক আয় ১৫০০ টাকা অথবা এর চেয়ে কম আয় করে এমন নারীদের হার এখনও ৬৬ শতাংশ। আর পুরম্নষের বেলায় এই হার মাত্র ৭ শতাংশ। আবার ২৫শ' টাকার ওপরে আয় করেন এমন নারীদের হার ১৫ শতাংশ। সেখানে এই হার পুরম্নষের বেলায় ৫৯ শতাংশ।
অন্যদিকে অধসত্মন পদবিযুক্ত নারী কর্মচারীদের ৬১ শতাংশের আয়ই ১০০ টাকার নিচে। অথচ পুরম্নষের ৰেত্রে এই হার মাত্র ১৬ শতাংশ। এই ক্যাটাগরিতে ১৮ শতাংশ নারী ২৫শ' টাকার ওপরে আয় করেন। পুরম্নষের ৰেত্রে এই হার ৫৩ শতাংশ। সকল খাতের শ্রমিকের আয় বিবেচনা করে দেখা গেছে পুরম্নষের আয় নারীদের দ্বিগুণ (যথাক্রমে ৩৪শ' টাকা ও ১৫শ' ৮১ টাকা।)
এদিকে নারী শ্রমিকের বৈষম্য শুধুমাত্র কম মজুরিতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। দিনভর হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেও মজুরি পাচ্ছে না এমন নারী শ্রমিকের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। বিনা পারিশ্রমিকের গ্রামীণ পারিবারিক শ্রমের ৰেত্রে এ ধরনের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। এ সম্পর্কিত জরিপে প্রচলিত সংজ্ঞার আওতায় দেখা গেছে, ৩৪ শতাংশ নারী মজুরি ছাড়া কাজ করছে। পুরম্নষের ৰেত্রে এই হার ১২ শতাংশ। সম্প্রসারিত সংজ্ঞা অনুযায়ী এই হার নারীর ৰেত্রে ৭৩ শতাংশ ও পুরম্নষের ৰেত্রে ১০ শতাংশ।
সংশিস্নষ্ট গবেষকদের মতে, কম সময়ের কাজে নারী শ্রমিকের বেশি নিয়োজিত হওয়াও আয়ের বৈষম্যের একটি অন্যতম কারণ। তাই অর্ধ বেকারত্বের হার নারী শ্রমিকদের ৰেত্রে আরও বেশি। বস্তুত প্রচলিত সংজ্ঞানুযায়ী ১৯৯৯-২০০০ সালে ৫৩ শতাংশ নারীই সপ্তায় ৩৫ ঘণ্টার চেয়ে কম কাজ করেছে। একই সময়ে পুরম্নষের এই হার ছিল মাত্র ৭ শতাংশ। ২০০৫-০৬ অনুযায়ী ৬৮.৩ শতাংশ। মূলত নারী শ্রমিকদের কেন্দ্রীভবন ঘটেছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। শতকরা ৮৪ শতাংশ নারীই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। নন প্রফিট সেক্টরে নারীদের কর্মসংস্থানের হার শতকরা ৫৯ ভাগ।
লেভার ফোর্স সার্ভে অনুযায়ী অকৃষিখাতে নিয়োজিত নারী শ্রমিকের বেশিরভাগই নিয়োজিত আছে ম্যানুফ্যাকচারিং, কমিউনিটি ওয়ার্ক, সামাজিকসহ অন্য সেবা খাতে। তবে খনি খনন ও উত্তোলন বিশেষ করে এই দু'টি সেক্টরে নারীদের সংখ্যাধিক্য লৰ্য করা যায়। প্রচলিত ও সম্প্রসারিত উভয় সংজ্ঞানুযায়ী এই হার যথাক্রমে ৪৫ শতাংশ ও ৬৪ শতাংশ। কমিউনিটি ও অন্যান্য সেবা খাতে এই হার ৫৮ শতাংশ এবং কৃষি খাতে ১৮ শতাংশ ও ৪৬ শতাংশ। ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে যথাক্রমে ৩৭ শতাংশ ও ৩৯ শতাংশ। নির্মাণ, ব্যবসা, হোটেল-রেসত্মরাঁ, পরিবহন ও অন্যান্য সেবা খাতে নারীদের নিযুক্তি খুব কমই দেখা যায়।
তবে কর্মসংস্থানের সকল খাতেই এটা স্পষ্ট যে বাংলাদেশের প্রেৰাপটে নারী শ্রমিকের মজুরি পুরম্নষ শ্রমিকের মজুরির প্রায় অর্ধেক।
এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ ও বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান ২০০৮ সালে কর্মজীবী নারীর উদ্যোগে আয়োজিত বিশ্বায়ন : মুক্তবাজার অর্থনীতি ও নারী সংগ্রাম সম্পর্কিত এক বক্তব্যে তিনি আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন, বিশ্বায়নের কারণে সবচেয়ে বেশি ৰতিগ্রসত্ম হয়েছে নারী শ্রমিকেরা। এ কারণেই তারা তাদের শ্রমের প্রকৃত মজুরি পায় না বলে তিনি জানান।
লেবার ফোর্স সার্ভে ১৯৯৯-২০০০ সালের তথ্যানুযায়ী দেখা যায় ১৫ বছর এবং তার উর্ধে শ্রমশক্তির গড় মজুরি কৃষি, পশুপালন, বনায়ন ও সংশিস্নষ্ট কাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিকের মজুরি ৩২.৯৪ টাকা। কিন্তু পুরম্নষ শ্রমিকের মজুরি ৬০.১৭ টাকা। একইভাবে খনন ও আরোহণ কাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিকের গড় মজুরি ৩০.২২ টাকা এবং পুরম্নষ শ্রমিকের গড় মজুরি ৮০.৫৬ টাকা। এভাবে পণ্য উৎপাদন, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসা, হোটেল ও রেস্টুরেন্ট, মজুদ-পরিবহন ও যোগাযোগ, শিৰা, স্বাস্থ্য ও সমাজসেবা, ব্যক্তিগত ও অন্যান্য সেবা খাতে নিয়োজিত একজন নারী শ্রমিকের গড় মজুরি যথাক্রমে ৩৮.৬৯%, ৪৩.৮৫%, ৩৬.৫৫%, ৩৯%, ৩৫.৭৫%, ৬৫.২৫%, ৫৯.৩৭%। যা পুরম্নষ শ্রমিকের বেলায় যথাক্রমে ৮২.৯৯%, ৮৫.৫৭%, ৭৮.৬৫%, ৭৪.৪৬%, ৮৩.৭৭%, ৮৭.৯৩% ও ৮২.৯৮%। আর সামগ্রিকভাবে গ্রামে গড় মজুরি নারী ৩৪.৭৯ টাকা ও পুরম্নষ ৬২.৮৭ টাকা। শহরে নারী ৫৮.৫৩ টাকা ও পুরম্নষ ৮৫.০৮ টাকা।
সংশিস্নষ্টরা স্বীকার করেছেন, বিশ্বের প্রায় সব দেশের তুলনায়ই বাংলাদেশের শ্রম বাজার অধিক সসত্মা। ফলে শ্রমিকের মজুরি কম। কম মজুরির কারণেই বিদেশী বায়াররা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক নিতে আগ্র্রহী হয়।
এ ব্যাপারে কর্মজীবী নারী নেত্রী শিরিন আখতারের অভিমত, সুস্থ শ্রম পরিবেশ ও ন্যায্য শ্রম অধিকার নিশ্চিত করা ছাড়া শিল্প বিকাশের দ্বিতীয় কোন পথ খোলা নেই। কারণ শ্রমজীবী ও কর্মজীবী নারীর জাতীয় ভিত্তিক সংগ্রামই এদেশের শিল্প বিকাশের পথকে প্রতিনিয়ত প্রশসত্ম করে চলেছে। তাই চাহিদা ও সমতার নিরিখে (প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থিক উভয়ই) গ্রাম ও শহরের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীসমূহ মজুরি শ্রমিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিত শ্রমিক এবং অন্যান্য দুস্থ জনগোষ্ঠীর চাহিদা নিরূপণ করতে হবে। এর জন্য আইএলও প্রবর্তিত সামাজিক বাজেট বিশেস্নষণ কৌশল প্রয়োগ ঘটিয়ে মজুরি বৈষম্য কমিয়ে আনা যায় বলে তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সভানেত্রী আয়শা খানম জানান, বৈষম্য তো অবশ্যই রয়েছে। তবে এটাও সত্য এই অবস্থারও পরিবর্তন হচ্ছে। মেয়েরা এখন শিৰিত ও দৰভাবেই বেড়ে উঠছে। তারাও পুরম্নষের সঙ্গে সমান তালে এগিয়ে চলছে। মজুরির ৰেত্রে সরকারীভাবে এই বৈষম্য নেই। কিন্তু বেসরকারী পর্যায়ে রয়েছে। তবে কোথায়ও কম, কোথায়ও বেশি।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন নারী-পুরম্নষের মজুরি বৈষম্যের বিষয়টি পরিমাপ করছেন কমপস্নায়েন্স ভিত্তিক হিসেবে। তাঁর মতে, যেসব কারখানায় কমপস্নায়েন্স সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান সেখানে এ ধরনের বৈষম্য নেই। তবে মজুরির প্রসঙ্গে তিনি দৰতার বিষয়টিকে উলেস্নখ করে বলেন, নারী শ্রমিকদের জন্য প্রশিৰণের ব্যবস্থা আছে। কোন কর্মজীবী মহিলা এ পেশায় আসার আগে যথাযথ প্রশিৰণ নিয়ে নিজেকে দৰভাবে তৈরি করতে পারলে নিজেই চাহিদা তৈরি করতে পারবে।

No comments

Powered by Blogger.