অভিমত- স্বাগত সজীব ওয়াজেদ জয়- by অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী

এই সময়ের সবচেয়ে চমকপ্রদ খবর হচ্ছে সজীব ওয়াজেদ জয়ের আওয়ামী লীগে যোগদান। আমি একথা ২৫ ফেব্রম্নয়ারি ২০১০ জানতে পেরে যারপরনাই খুশি হয়েছি। দীর্ঘদিন যাবত মননে, লেখায়, বক্তব্য ও সাাতকারে এই প্রত্যাশাটা আমি ব্যক্ত করেছি।
নবম সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী মনোনয়নের বেশ আগে আমি একটি দৈনিকে লিখেছিলাম ''শেখ হাসিনার সনত্মান বলে নয়। স্বযোগ্যতায় জয়কে ঢাকার বা রংপুরের কোন একটি আসন থেকে নির্বাচনের সুযোগ দেয়া বাঞ্ছনীয়।" নির্বাচনের পর একটি সাপ্তাহিকীকে দেয়া সাাতকারে কোন একটি উপনির্বাচনে জয়কে মনোনয়নের জন্য আমি আহ্বান জানিয়েছিলাম।
জয়ের সঙ্গে আমার কোন পরিচয় আছে বা কোন দিন কথা হয়েছে বলে মনে পড়ছে না। কিন্তু তাঁর শিক্ষা, নিষ্ঠা, প্রজ্ঞা ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও বাচনভঙ্গিতে আমি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম শেখ হাসিনা বা ড. ওয়াজেদ মিয়ার সনত্মান হিসেবে নয়; বরং তার আপন বৈশিষ্ট্য বা স্বকীয়তায় তাকে রাজনীতিতে আনা উচিত। আমি জানতাম রাজনীতিতে জয় আসলে সে নিজে তিগ্রসত্ম হবে, তবে প্রথমত আওয়ামী লীগ ও দ্বিতীয়ত দেশটা বিশেষভাবে উপকৃত হবে। আমি বলেছিলাম যে আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতা-নেত্রীর সুযোগ্য সনত্মানদেরও আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে টেনে আনা উচিত। আমি এটা স্বজনপ্রীতি বা পরিবারতন্ত্র কায়েমের কৌশল না বলে বরং মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে রাখার উপায় হিসেবে দেখছি।
আমার অভিজ্ঞতা বলছে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতের পরে আওয়ামী লীগ যে পথে চলছিল তা চলতে দিলে আজ কোথায় থাকত বঙ্গবন্ধু, কোথায় থাকত আওয়ামী লীগ, আর কোথায় থাকত মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ! সেই ১৯৮২ সালে দেশে ফিরে শেখ হাসিনা যদি আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব না নিতেন তাহলে এদেশে বার ভঁূইয়ার রাজত্বের ন্যায় বহু আওয়ামী লীগের জন্ম হতো আর সতীনের সনত্মানের ন্যায় একদিন সবাই এসব ছেড়ে কুচক্রীদের দলে মিশে যেত। শেখ হাসিনা দেশে প্রত্যাবর্তনের পরও আওয়ামী লীগকে মেরে কেটে খাবার প্রবণতা ছিল। এমনকি ১৯৯১ সালে নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের বহু বড় নেতা বিএনপি কিংবা ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে মিশে যেতে চেয়েছিল। শেখ হাসিনা শীর্ষে ছিলেন বলে তাদের সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি। তারপর কত ঝড়-ঝঞ্ঝা বয়ে গেল। শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে না থাকলে কি হতো তা শুধু কল্পনা নয়, বাসত্মবে দেখা যেত। গ্রেনেড, বোমা, গুলির আঘাত সয়ে আর কে আওয়ামী লীগকে মায়ের মতো আগলে রাখত?
সম্ভবত আওয়ামী লীগের উপর সবচেয়ে বড় আঘাত আসে দু' বছর মেয়াদী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। নেত্রী শেখ হাসিনা সাব-জেলে নীত হলে ষড়যন্ত্র এমনভাবে জমছিল যে বলতে গেলে আওয়ামী লীগ এক মহাসঙ্কটে পড়ে যাচ্ছিল। এমন দুর্দিনে শেখ হাসিনা যদি আওয়ামী লীগের প্রধান না থাকতেন এবং তার নেতৃত্বের অনুগত সত্যিকার বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ প্রেমিক এক ঝাঁক তরম্নণ-তরম্নণী না থাকত তাহলে এবারে আওয়ামী লীগ বহু শাখায় বিভক্ত হয়ে যেত। তার পরিণতি কী হতো তা চিনত্মা করলে গা শিউরে ওঠে। তাই শেখ হাসিনা বা পরিবারের স্বার্থে নয়। বরং বাঙালীর স্বার্থে, বাংলার স্বার্থে, মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশের স্বার্থে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শেখ হাসিনা বা তার পরিবারের কাউকে না কাউকে থাকতে হবে।
শেখ হাসিনা চিরঞ্জীব হবেন না; হলে বরং খুশি হতাম। এমনকি সুস্থ ও সবল থেকে আর একবার প্রধানমন্ত্রিত্বের পর হয়ত তিনি আর রাজনীতিতে থাকবেন না। ২০০১ সালে কারচুপির নির্বাচন না হলে বাংলাদেশের চেহারাটা ভিন্ন হতো। শেখ হাসিনা এত দিনে অবসরে চলে যেতেন। তাহলে আওয়ামী লীগকে সনত্মানের মমতা দিয়ে কে লালন পালন করত?
যে কোন কারণেই হোক শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগকে কে বা কারা লালন পালন করত? পরিবারের যোগ্য সদস্যরা যদি পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারকবাহক হয়, তাহলে সে ঐতিহ্যকালে সমৃদ্ধ ঐতিহ্যে পরিণত হয়। সে দৃষ্টিকোণ থেকে যোগ্য ব্যক্তি যদি ঐতিহ্যের হাল ধরে, তাহলে তাকে পরিবারতন্ত্র বলা যাবে না।
জয়ের আওয়ামী লীগে যোগদানে দুটো বিষয় নিশ্চিত হলো। এক, জয় এখন থেকে মায়ের সংস্পর্শে থেকে পরিপক্বতা অর্জন করবে, যেমনটি ঘটেছিল নেহরম্নকন্যা ইন্দিরার েেত্র। আজ হোক কাল হোক আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তাকে আসতেই হবে। দুই, শেখ হাসিনার কতিপয় স্বপ্নের সারথী হিসেবে দলের মধ্যেও সামাজিকীকরণটা ত্বরান্বিত হলো। শেখ রেহানাকে, রাজনীতিতে আসার আমন্ত্রণ জানানো হোক। ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী পালন বা ২০২১ সালে বাংলাদেশের রূপকল্প মানসপটে গাঁথার সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কে কীভাবে থাকবেন তার রূপকল্প তৈরি কি জরম্নরী নয়? তার পরে আছে নব প্রজন্মের প্রেরণার উৎস বা রোল মডেলের কথা।
অনুপ্রেরণার কথাটায় আসি। আমাদের কালে দেখেছি বড় বড় রাজনীতিবিদ, সাংসদ, মন্ত্রীদের সনত্মানাদি হয় যতনে রাজনীতি পরিহার করত, কিংবা বাবা-কাকার বিপরীতে অবস্থান নিত। আমরা তাদের সমালোচনা করতাম। অথচ দুর্যোগ দুর্দিনে আমরা শেখ পরিবারের সদস্যদের কাছে গিয়ে কী প্রেরণাই পেয়েছি সে কথা আজকে শুধু স্মৃতি হিসেবে চারণ করতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগেই শেখ হাসিনার প্রত্য ছাত্র রাজনীতিতে পদার্পণ অনেকের জন্য অননত্ম প্রেরণার উৎস ছিল। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমনের পর থেকে ছাত্রীহলের সংসদে ছাত্রলীগ নির্বাচিত হতে শুরম্ন করে, যা একদিন ছাত্র ইউনিয়নের দখল ছিল। তার উপস্থিতিতে তদানীনত্মন লড়াই সংগ্রামে আমরা অভূতপূর্ব স্পৃহা পেয়েছি। '৬৯-এর গণ-আন্দোলনের সময়ে তাঁর সরব উপস্থিতি আমাদের সারাণ স্মরণ করিয়ে দিত যে শেখ মুজিবের কন্যা যখন রাজপথে নামতে পারেন, আমরা বসে থাকব কেন? মুক্তিযুদ্ধকালে ইলিয়াছ আহম্মদ চৌধুরী (দাদাভাই), মণিভাই, সেলিম, কামাল, মারম্নফ ও জামালকে কাছে পেয়ে গর্বভরে সবাইকে বলতে পেরেছি যে বঙ্গবন্ধুর স্বজনরা যখন যুদ্ধে নামতে পারেন, তখন কারও কি বসে থাকার কোন অবকাশ আছে? দেরাদুনে প্রশিণকালে জামাল ও মারম্নফ আমার রম্নমমেট ছিল। শুধু সেদিন নয়, আজও অতিশয় আনন্দ ও বেদনার সঙ্গে সে স্মৃতি স্মরণ করে উদ্বেলিত হই। এসব কারণে শুধু জয় কিংবা শেখ রেহানার রাজনীতির কারণে রাজনীতিতে পর্দাপণ নয়, বরং ২০২১ সালের রূপকল্প বাসত্মবায়নের জন্য আওয়ামী লীগের সকল নেতাকর্মীর সনত্মানাদিকে উত্তরাধিকার হিসেবে এবং যোগ্যতা নিয়ে একই রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে।
তারা রাজনীতিতে আওয়ামী বলয়ের বাইরে কোথাও বিকশিত হলে তাকে বলি গাদ্দারীপনা। আর আওয়ামী লীগে এলে বলব পরিবারতন্ত্র। ওরা যাবেটা কোথায়? অযোগ্য কেউ উড়ে এসে জুড়ে বসলে তাকে পরিবারতন্ত্র বললেও যোগ্যতার মাপকাঠিতে আত্মস্থ হলে তাকে কি বলব? নিঃসন্দেহে তাকে বলব দল প্রেম যা ত্রেভেদে বিশেষত আওয়ামী লীগের জন্য দেশপ্রেমের নামানত্মর। আমরা সবাই জানি, আমার মতো আমার জমি অন্য কেউ বেশি ভালভাবে চষবে না। মায়ের চেয়ে মাসীর দরদও বেশি হবে না। তাই আমার দেশের জন্য, আমার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাসত্মবায়নের জন্য আমার সনত্মানকেই মুখ্য ভূমিকা নিতে হবে। আমার স্বাধীনতা আমার সম্পদ। এই সম্পদের উত্তরাধিকার আমার সনত্মানরাই হবে; বৈমাত্রের ভাইয়ের সনত্মানেরা নয়।
জয়ের আওয়ামী লীগে যোগদানকে দেশে সুস্থ রাজনীতির স্বার্থে অনেকেই স্বাগত জানিয়েছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে বেশ ক'টি আলোচনা সভাতেও জয়কে আওয়ামী লীগে যোগদানের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলাম। সর্বশেষ মহাজোট সরকারের বর্ষপূর্তির এক অনুষ্ঠানেও তাকে আহ্বান জানিয়েছিলাম।
সেদিন হল ভর্তি তরম্নণ দর্শক শ্রোতা বিপুল করতালিতে আমার আহ্বানটিকে স্বাগত জানিয়েছিল। আজকে যখন আমরা 'ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু' শীর্ষক আলোচনায় প্রসঙ্গত জয়ের কথা বলছি, হলটিতে দর্শক শ্রোতা তুমুল করতালিতে জয়কে স্বাগত জানিয়েছেন। যুগানত্মর পত্রিকায় জয়ের একটি সাাতকার দেখলাম। আমি আশ্বসত্ম হলাম যে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার দৃপ্ত শপথে জয় আওয়ামী লীগে যোগদান করেছে। আমার কাছে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাই মুখ্য রূপকল্প, আমাদের চূড়ানত্ম গনত্মব্যস্থল। তাই বলে এটা ভিশন ২০২১-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক ত নয়, বরং সম্পূরক। এই ল্যে উপনীত হতে আরও বিশাল ল্য ও সাময়িক গনত্মব্য নির্ধারণ করতে হবে। একটি গনত্মব্যে পেঁৗছতে একাধিক কৌশল বা রণনীতি প্রয়োজন। এক একটি রণনীতিকে বাসত্মবায়ন করতে সম্পূরক ও পরিপূরক রণনীতি প্রয়োজন হবে। বঙ্গবন্ধু যেভাবে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখতেন এবং যে রণকৌশল নিয়ে তিনি এগিয়ে যাচ্ছিলেন। কৃতঘ্নদের দল তাকে হত্যা না করলে, ১৯৮০ দশকেই আমরা মধ্য-আয়ের দেশে পরিণত হতাম। আজকে গরিব দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে গরিব দুঃখী হয়ত তেমন একটা খুঁজে পাওয়া যেত না। বিলম্বে হলেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা আবার সঠিক গনত্মব্য নির্ধারণ করেছি। সঠিক পথে ফিরে এসেছি, সঠিক যান ও সঠিক চালক পেয়ে যাচ্ছি। একদিন সজীব ওয়াজেদ জয় হবে একজন সঠিক চালক_ সেদিনের প্রত্যাশায় আছি।
দেশ একটি ক্রানত্মিকাল অতিক্রম করছে। এ সময় সজীব ওয়াজেদ জয়ের মতো একজন তারম্নণ্যদীপ্ত মানুষের আওয়ামী লীগে যোগদান শুধু প্রগতির ধারাকে নিশ্চিত করবে না, শত ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে আমরা আমাদের কাঙ্ৰিত ল্যে পেঁৗছে যাব। এ সময়ে সবচেয়ে বড় ষড়যন্ত্র হচ্ছে তরম্নণ সমাজকে প্রথমে বিভ্রানত্ম করা, তারপর তাদের শেখ হাসিনাবিমুখ করা এবং সর্বশেষ তাদেরকে দিয়ে তাদেরই ধ্যানের ছবি প্রাণপ্রিয় নেত্রী হাসিনাকে বিধ্বসত্ম করা। ইতোমধ্যে কিছু নিবন্ধ এবং দুটো বই আমার চোখে পড়েছে। এগুলো পড়ে আমার মনে হচ্ছে উপরি-উক্ত ল্য বাসত্মবায়নে একটি কিংবা একাধিক প কোমর বেঁধে নেমেছে। তবে জয়ের মতো তরম্নণের আওয়ামী লীগে যোগদানের কারণে নতুন প্রজন্মের তরম্নণ-তরম্নণীরা আবার মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ এবং বর্তমান বাংলাদেশের কর্ণধার শেখ হাসিনার মাঝে বঙ্গবন্ধুর রূপকল্পই শুধু নয়, তা বাসত্মবায়নে কৌশল, পথ ও পাথেয় খুঁজে পাবে।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও শিৰাবিদ

No comments

Powered by Blogger.