পরীক্ষাময় শিক্ষা by বিভাষ বাড়ৈ

শিৰাব্যবস্থা নিয়ে চলা অব্যাহত পরীক্ষা-নিরীক্ষার চক্রে আটকে যাচ্ছে শিৰার্থীরা। একদিকে বিশাল পাঠ্যক্রমের বোঝা, তার ওপর পরীৰার বৃত্তে আটকা_ এ চক্র থেকে রেহাই পাচ্ছে না শিশুরা।
শিৰাব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে মেধাবী করার নামে তাদের ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে একের পর এক পরীৰার বোঝা। দেশব্যাপী ভর্তিযুদ্ধের উৎকণ্ঠা তো আছেই, তার ওপর মেধার মূল্য দিতে প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত কমপক্ষে ৩০টি পরীৰার মুখোমুখি হতে হচ্ছে শিৰার্থীদের। এসএসসির সঙ্গে পঞ্চম শ্রেণীর পর এবার দেয়া হয়েছে অষ্টম শ্রেণীতে পাবলিক পরীৰা নেয়ার ঘোষণা। কিন্তু এসএসসি পরীৰার আগেই শিশুদের দুটি পাবলিক পরীৰার মুখোমুখি করা নিয়ে অসনত্মোষ বাড়ছে শিৰার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে। শিৰাকে দিন দিন পরীৰাকেন্দ্রিক বিষয়ে পরিণত করার প্রবণতায় উদ্বিগ্ন্ন শিৰাবিদ, শিশু বিশেষজ্ঞসহ অভিভাবক মহল। তাঁদের অভিমত, বিদ্যালয় কেবল কোন পরীৰা কেন্দ্র নয়; অসংখ্য পরীৰার চাপে শিৰা নিয়ে শিশুদের মধ্যে বাড়ছে আতঙ্ক। যা শিৰার আসল উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করছে মারাত্মকভাবে।
কোমলমতী শিশুদের ওপর চাপ কমাতে স্কুলে চলা ভর্তি পরীৰার প্রক্রিয়া বাতিলের দাবি বহুদিনের। বিশেষজ্ঞরা দাবি জানিয়ে আসছেন, প্রাথমিক সত্মরের শিশুসহ সকল শিশুর ওপর অসংখ্য পাঠ্যবইয়ের যে বোঝা আছে তা তাদের মনোবিকাশের স্বার্থেই কমাতে হবে। শিশুদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত পাঠ্যক্রমের কড়া সমালোচনা করে গত ডিসেম্বরে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেনের দেয়া একটি বক্তব্য আমাদের শিৰাব্যবস্থার জন্য গুরম্নত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গের শিশু শিৰাক্রম নিয়ে অমর্ত্য সেন বক্তব্য দিলেও অভিন্ন সঙ্কট বিরাজ করায় বিষয়টি আমাদের দেশের জন্যও একই গুরম্নত্ব বহন করে। তাঁর বক্তব্যে শিশু ও তাদের শিৰার স্বার্থে তাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ কমানোর স্পষ্ট সুপারিশ আছে। তিনি বলেছিলেন, শিশুদের ওপর অতিমাত্রায় পাঠ্যক্রমের চাপ শিৰার উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করছে। বিশেষজ্ঞরা শিশুশ্রেণী থেকে শুরম্ন করে সকল শ্রেণীতে ৫ থেকে ১০টি বিষয়ের পাঠ্যক্রমের বোঝা কমানোর পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন অনেক দিন থেকে। কিন্তু বাসত্মবতা হলেও শিৰার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া পাঠ্যক্রমের বোঝা তো কমেইনি, বরং মেধা যাচাইয়ের নামে শিশুদের ওপর চাপছে একের পর এক পরীৰার বোঝা। দেশব্যাপী এসএসসি ও সমমানের পরীৰার সঙ্গে গত নবেম্বরে প্রাথমিক সত্মরের শিশুদের জন্য যুক্ত হয়েছে পঞ্চম শ্রেণীর প্রাথমিক শিৰা সমাপনী পরীৰা। দেশের প্রায় ২০ লাখ শিশুকে গত বছরের ২১, ২২ এবং ২৪ নবেম্বর প্রাথমিক শিৰা অধিদফতরের অধীনে ভিন্ন প্রশ্নপত্রে এ পরীৰায় অংশ নিতে হয়েছে। সমালোচিত হলেও প্রতিদিন অনুষ্ঠিত ২টি করে পরীৰার মুখোমূখি হতে হয়েছে প্রায় ২০ লাখ শিশুকে। এ পর্যনত্ম দেশের সবচেয়ে বড় এ পাবলিক পরীৰার ফলাফল ব্যাপকভাবে আলোচিত হলেও অসনত্মোষ আছে শিশুদের এ ধরনের পরীৰার মুখোমুখি করার প্রভাব নিয়ে। শিশুদের নিজ প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য এলাকায় নিয়ে বিশাল এ পরীৰার মুখোমুখি করার কারণে তাদের ওপর অকারণেই চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে বলেও মনে করেন অনেকে। আবার এ পরীৰার সনদ যেহেতু তাদের ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তির মাপকাঠি সেহেতু পরীৰা তাদের শিৰা প্রতিষ্ঠানের প্রতি আতঙ্ককে বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর এ পরীৰার ভয় শিশুদের স্কুলের প্রতি অনাগ্রহী করে তুলতে পারে বলে মনে করেন তাঁরা। এদিকে প্রাথমিক শিৰা সমাপনী পরীৰা শিশুশিৰায় বৈষম্য দূর করবে বলে মনে করা হলেও এর ফলে প্রাথমিক সত্মরে ঝরে পড়া শিশুর সংখ্যা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। পরীৰাভীতি আর্থিক সঙ্কটসহ নানা কারণে যারা পরীৰার মুখোমুখি হয়নি কিংবা ফেল করেছে তাদের অধিকাংশেরই ঝরে পড়ার আশঙ্কা আছে। জানা গেছে, ২০০৯ সালের শুরম্নতে দেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিল ২০ লাখ ১৭ হাজার ২৪২ শিশু। কিন্তু সমপ্রতি শেষ হওয়া সমাপনী পরীৰায় অংশগ্রহণের জন্য নিবন্ধন বা রেজিস্ট্রেশন করে ১৯ লাখ ৭৯ হাজার ৮৯৫ শিশু। পরীৰার হলে উপস্থিত ছিল ১৮ লাখ ২৩ হাজার ৪৬৫। আর পরীৰায় পাস করেছে সারাদেশে ১৬ লাখ ২০ হাজার ৫৪ শিশু। ফলে কেবল পঞ্চম শ্রেণী অতিক্রম করার আগেই নানা কারণে শিৰা থেকে প্রায় ৪ লাখ শিশুর ঝরে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিৰা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক শিৰা অধিদফতরের কর্মকর্তারাসহ সংশিস্নষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এক বছরে যে ৩ লাখ ৯৭ হাজার ১৮৮ শিশু পিছিয়ে পড়েছে সরকারীভাবে বিশেষভাবে নজর না দিলে তাদের অধিকাংশই ঝরে পড়বে শিৰা থেকে।
এদিকে পঞ্চম শ্রেণীর পরীৰা নিয়ে যখন সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে নানা হিসেব কষা হচ্ছে, সেই মুহূর্তে সরকার ঘোষণা দিয়েছে এ বছর থেকে অষ্টম শ্রেণীতেও এসএসসি পরীৰার আদলে নেয়া হবে পাবলিক পরীৰা। যার নাম হবে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীৰা (জেএসসি)। ১০ শিৰা বোর্ডের অধীনে পরীৰা নেয়া হবে অভিন্ন প্রশ্নপত্রের আলোকে। সরকারের বক্তব্য হলো, প্রাথমিক শিৰা সমাপনী পরীৰার সফলতাকে মাথায় রেখেই অষ্টম শ্রেণীতে নেয়া হচ্ছে এ পরীৰা। তবে সরকারের অবস্থান যাই হোক না কেন, এসএসসি পরীৰার আগেই শিশুদের দুটি পাবলিক পরীৰার মুখোমুখি করা নিয়ে অসনত্মোষ বাড়ছে শিৰার্থী, অভিভাবক, শিৰক, শিৰাবিদ, শিশুবিশেষজ্ঞসহ সংশিস্নষ্ট অনেকের মাঝেই। শিৰানীতি অনুযায়ী অষ্টম শ্রেণী পর্যনত্ম প্রাথমিক শিৰাসত্মর করা হলে পঞ্চম শ্রেণীর পরীৰার গ্রহণযোগ্যতা ও ভবিষ্যত নিয়েও প্রশ্ন আছে। যারা শিৰা দেন সেই শিৰকরাও একের পর এক পরীৰা আয়োজনকে ভালভাবে গ্রহণ করছেন না। অনেক শিৰকই একে শিশুদের ওপর অতিরিক্ত বোঝা চাপানোর পদৰেপ বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু সরকারের উদ্যোগ বলে সমালোচনা করে কিছু বলারও সাহস পাচ্ছেন না অনেক শিৰক। বৃহস্পতিবার রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজ এবং গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের একাধিক শিৰকের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার চেষ্টা করা হলে তাঁরা বলেন, আমাদের মনে হয় অনেক সিদ্ধানত্মই নেয়া হচ্ছে পরিকল্পনা ছাড়া। কারণ সরকারের শিৰানীতিতে যদি অষ্টম শ্রেণী পর্যনত্মই প্রাথমিক শিৰা হয় তা হলে পঞ্চম শ্রেণীতে তো আর প্রাথমিক শিৰা সমাপনী পরীৰা নেয়া যাবে না। শিৰকরা বলেন, একটা শিশুর ওপর একের পর এক পাবলিক পরীৰার বোঝা চাপিয়ে তাদের আসলে পরীৰার মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে ফেলা হচ্ছে।
শিৰার্থী অভিভাবকদের সংগঠন অভিভাবক ফোরামের নেতৃবৃন্দরা সকলেই ৰোভ প্রকাশ করে বললেন, প্রথমে বাচ্চারা রীতিমতো ভর্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে। এরপর বিদ্যালয়ের নিজস্ব নিয়মিত পরীৰা তো আছেই, তার ওপর দশম শ্রেণী পর্যনত্ম তাকে প্রথম সাময়িক পরীৰা, দ্বিতীয় সাময়িক পরীৰা এবং বার্ষিক পরীৰাই দিতে হয় কমপৰে ৩০টি। আরও আছে এসএসসি ও সমমানের পরীৰা, নির্বাচনী পরীৰাও। এরই সঙ্গে এখন আবার নতুন দুটি পাবলিক পরীৰার বোঝা বহন করা আমাদের সনত্মানদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে বলে অভিযোগ করলেন অভিভাবকরা। এমনকি অব্যাহত পরীৰার চাপ সামাল দিতে শিশুরা গাইড বই এবং প্রাইভেট টিউশনির দিকে আরও বেশি ঝুঁকে পড়ছে বলে অভিমত প্রকাশ করলেন তাঁরা। শিৰার্থীদের অসংখ্য পাঠ্যক্রমের বোঝা আর অব্যাহত পরীৰার মুখোমুখি করার প্রবণতা শিৰার উদ্দেশ্যকেই ব্যাহত করছে বলে মনে করেন বিশিষ্ট জন। বিশিষ্ট শিৰাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বিষয়টিকে ৰতিকর অভিহিত করে বলেন, শিৰা পরীৰাকেন্দ্রিক হয়ে উঠলে শিৰার উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে বাধ্য। এখন কে কোন্ গ্রেড পেল? কে জিপিএ-৫ পেল এসবই শিৰার গুরম্নত্বপূর্ণ অর্থ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিৰার্থী, অভিভাবক, তাঁর শিৰক সবার চোখ শিৰা নয়_ বরং পরীৰার দিকে। শিশুদের ওপর চাপ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অব্যাহত চাপ ৰতি, শিৰার প্রতি আকর্ষণের পরিবর্তে এটা বরং কোমলমতী শিশুদের শিৰার প্রতি ভয়কেই বাড়িয়ে দিচ্ছে। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আৰেপ করে বলেন, বিদ্যালয় কেবল কোন পরীৰা কেন্দ্র নয়; শিশুরা সামাজিকতা, বিজ্ঞান শিৰাগ্রহণ করবে, সংস্কৃতির চর্চা করবে, খেলাধুলা করবে, দেয়াল পত্রিকা লিখবে। কিন্তু আমাদের পরীৰাকেন্দ্রিক শিৰার মাধ্যমে শিশুদের কৃত্রিম মানুষ হিসেবে তৈরি করছি। অন্যদিকে কথা বলে জানা গেল, শিৰানীতি অনুযায়ী অষ্টম শ্রেণী পর্যনত্ম প্রাথমিক শিৰাসত্মর করা হলে পঞ্চম শ্রেণীর পরীৰার গ্রহণযোগ্যতা ও ভবিষ্যত নিয়েও প্রশ্ন প্রায় সকলেরই। তবে জানা গেছে, শিৰানীতি অনুযায়ী অষ্টম শ্রেণী পর্যনত্ম প্রাথমিক শিৰা না হওয়া পর্যনত্ম এভাবেই দুটি পরীৰা নেয়া হবে। ঐ প্রক্রিয়ায় যেতে কতদিন লাগবে তা নিয়ে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সবার মনে। এ বিষয়ে জাতীয় শিৰানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্যরা জানিয়েছেন, বিষয়টি অত্যনত্ম জটিল ও ব্যাপক। তাই এক লাফে হঠাৎ করে না গিয়ে পর্যায়ক্রমে বাসত্মবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে শিৰানীতিতে। এজন্য পুরো প্রক্রিয়ায় যেতে কমপৰে ৩ থেকে ৪ বছর লাগবে।

No comments

Powered by Blogger.