তরুণ-তরুণীর হাতে নাটাই, নাচ গান ঘোড়ার গাড়ি- ঢাকাবাসীর ঘুড়ি উৎসব

চলতি বছর রাজধানী ঢাকা ৪০০ বছরে পা দিল। ১৬১০ সালে শায়েস্তা খাঁর আমল থেকে রাজধানী হিসাবে এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু। চার শতাব্দী ধরে অনেক ভাঙ্গা-গড়া ও ইতিহাস-ঐতিহ্যেরও সাৰী হয়ে আছে এই রাজধানী।
ইংরেজসহ অনেক ভিনদেশী একে শাসন করেছে, আবার চলে যেতেও বাধ্য হয়েছে। তাই এই শহরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে সরকারী পর্যায় ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নিয়মিত অয়োজন করছে নানা উৎসবের। যেখানে তুলে ধরা হচ্ছে ঢাকা শহরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক নিদর্শন। তারই ধারাবাহিকতায় ঢাকাবাসী শনিবার আয়োজন করেছিল ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ঘুড়ি উৎসবের। বসন্তের তপ্ত দুপুরে এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে গিয়ে দেখি ঘুড়ি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের দাপাদাপিতে ধুলো উড়ছিল মানুষের মাথার উপর দিয়ে। সেই ধুলোর ভেতর দিয়ে দৃষ্টি নিৰেপ করে তাকালাম নীলাকাশের দিকে। দেখলাম রোদের ঝলমলে আলোয় ভেসে বেড়াচ্ছে স্বচ্ছ মেঘ। তার অনেক নিচ দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে নানা রঙের ও নানা ডিজাইনের ঘুড়ি। আকাশের দিকে মুখ করে ধুলোর মধ্যেই লাটাই নিয়ে ছোটাছুটি করছে অনেক তরম্নণ প্রতিযোগী। কেউ আবার মন্থর পায়ে হাঁটছে। তাদের ঘিরে ধরে নানা বয়সী নারী- পুরম্নষ হৈ-হুলেস্নাড়ে মেতে উঠেছে পরমানন্দে। অনেক তন্বীকেও দেখা গেছে এদিন লাটাই নিয়ে ঘুড়ি উড়াতে। শুধু ঘুড়ি উড়ানোতেই সীমাবদ্ধ ছিল না এ উৎসব, এখানে আরও ছিল নাচ, গান , বীনের সুরে সাপের নাচন, আর ঢাকার ঐতিহ্য ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে ঘুড়ে বেড়ানোর আয়োজন। প্রাইম ব্যাংক ঘুড়ি উৎসবটি শুরম্ন হয় ঢাকার ঐতিহ্যবাহী কালচার ব্যান্ডপার্টির বাজনা ও আব্দুল কাদেরের বীনের সুরে।
ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এই উৎসবের উদ্বোধন করেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এবং ঢাকাবাসীর আজীবন সদস্য এ্যাডভোকেট কামরম্নল ইসলাম এমপি। বিশেষ অতিথি ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূত মিন জাল জয়েন্দীন, প্রাইম ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফেরদৌসী সুলতানা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার অধ্যাপক সৈয়দ রেজাউর রহমান। আরও উপস্থিত ছিলেন পাকিসত্মানের হাই কমিশনার আশরাফ কুরেশী ও চায়না এ্যাম্বাসির কালচারাল এ্যাটাশে সু জেমিং। ঢাকাবাসীর প্রধান উপদেষ্টা ইনাম আহমেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে আরও বক্তৃতা করেন ঢাকাবাসী ও ঘুড়ি ফেডারেশনের সভাপতি শুকুর সালেক, মহাসচিব শেখ খোদা বক্স ও নেসলের ম্যানেজার মীর এসত্মাফিজুর রহমান।
কামরম্নল ইসলাম বলেন, ঢাকার বাসিন্দাদের ঘুড়ি উড়ানোর ঐতিহ্য সেই মোঘল আমলের। দীর্ঘদিনের এই ঐতিহ্য এখন বিলীন হতে চলেছে। মাঠ নেই, উঠান নেই, আগের মতো বাড়ির ছাদ নেই, নতুন প্রজন্ম ঘুড়ি উড়াবে যে, সে জায়গা আজ আর নেই। তবে আমাদের এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে হবে, নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে ঢাকার এই ঐতিহ্যের কথা। এ জন্য ঘনঘন ঘুড়ি প্রতিযোগিতা ও ঘুড়ি উৎসবের আয়োজন করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে ঘুড়ি উড়াতে উৎসাহী করতে হবে।
বাপেক্সের এক নারী কর্মকর্তা জাকিয়া ইসলাম বলেন, ছোট বেলা বাড়ির ছাদে ঘুড়ি উড়াতাম, সুতাও মাঞ্জা দিতাম। অনেকদিন পর আজ আবার সেই আনন্দ পেলাম। এখন আমার বারবারই মনে হচ্ছে ছোট বেলার অনেক রোমাঞ্চকর স্মৃতির কথা। এখনকার ব্যসত্ম জীবনে অনেক ঝামেলায় থাকতে হয়, অনেক ঘটনা নিজেকে কষ্ট দেয়, যদি মাঝে-মধ্যে এমন আয়োজন করা হয়, তাহলে সেসব যন্ত্রণা থেকে কিছুটা হলেও স্বসত্মি ফিরে পাওয়া যায়। মন ফ্রেস হয়।
ঘুড়ি উড়ানোর দৃশ্য দেখতে অনেকে ছোট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। তাদের জন্য বাড়তি আনন্দ ছিল ঘোড়ার গাড়িতে চড়া। ঝলমলে বাজানো ঘোড়ার গাড়িতে করে শিশুরা ঘুরে বেড়িয়েছে পুরো মাঠ। অনেকে আবার দেশাত্মবোধক গানেও অংশ নিয়েছে।
ঢাকায় ঘুড়ি উড়ানোর ইতিহাস সেই মোঘল আমলের। তখন ঢাকার অভিজাত লোকজনের বিবিধ বিনোদনের মধ্যে ঘুড়ি উড়ানো ছিল অন্যতম। সূত্র মতে ১৭৪০-এর দশকে নায়েব-ই-নাজিম নওয়াজেশ মোহাম্মদ খানের আমলে ঘুড়ি উৎসব একটা ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছিল। তখন থেকেই বাণিজ্যিক আকারে ঘুড়ি তৈরি শুরম্ন হয় ঢাকায় এবং বাড়ির ছাদে, খোলা জায়গায় বা উন্মুক্ত ময়দান থেকে আকাশে প্রচুর ঘুড়ি উড়াতে দেখা যায়। বর্তমানেও ঢাকায় ঘুড়ি তৈরি ও বিক্রির দোকান রয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং গ্রামের লোকজন ধর্মীয় উৎসবসহ নানা উৎসবে ঘুড়ি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রতিযোগিতা হচ্ছে সুতা কাটাকাটি এবং এতে শেষ পর্যনত্ম যে টিকে থাকে সে হয় চ্যাম্পিয়ন। ঐতিহাসিক বিবরণ ও রেকর্ড থেকে জানা যায়, ১৮ ও ১৯ শতকে ঢাকার অভিজাত লোকেরা ঘুড়ি উড়ানোর প্রতিযোগিতার টিমকে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।

No comments

Powered by Blogger.