বগুড়ায় দখল হচ্ছে নদী, খাস জমি ও দেবোত্তর সম্পত্তি- ভূমি দস্যুতা সমাচার ॥ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ৬

বগুড়া শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া করতোয়া নদী দিনে দিনে নাব্য হারিয়ে শুকিয়ে গিয়ে ভূমি দসু্যদের থাবার মুখে পড়েছে। দুই তীরে বালি ফেলে ভিতরে ঢুকে দখল হয়েও গেছে নদীর চড়ার অনেকটাই।
উঠেছে অবকাঠামো স্থাপনা। কেউ ইটের প্রাচীর দিয়েও দখলে নিয়ে রেখেছে। কেউ আবার নদীর ভিতরের ভূমি পত্তন দিয়ে আবাদ করছে। অবৈধভাবে দখল প্রক্রিয়া থেমে নেই। নদীর চড়া সরকারী খাস খতিয়ানভুক্ত। এ ছাড়াও সরকারী খাস ভূমি আছে। আছে অর্পিত সম্পত্তি, দেবোত্তর সম্পত্তি। রেলের সম্পত্তি। সবই সরকারের খাস তালিকার কয়েকটি বিভাগে অনত্মর্ভুক্ত। বগুড়ায় সামান্য ভূমি লিজ দেয়া আছে। কিছু ভূমিতে গড়ে তোলা হয়েছে আশ্রয়ণ প্রকল্প। বগুড়া অঞ্চলে এই খাস ভূমির বেশিরভাগই চলে গেছে ভূমি দসু্যদের দখলে। খোঁজ খবর করে জানা যায় সেটেলমেন্ট বিভাগের এক শ্রেণীর কর্মকর্তার যোগসাজশে ভূমি দসু্যরা খাস ভূমির খতিয়ান ও দলিল করেও নিয়েছে। শহর ও গ্রামের এমন ভূমি দসু্যতার পাশে যমুনায় জেগে ওঠা চরের ভূমিও চলে যায় প্রভাবশালীদের দখলে। নদীর এই স্থানও সরকারী খাস খতিয়ানভুক্ত। বগুড়া অঞ্চলে খাস জমির পরিমাণ নিয়েও সঠিক তথ্য মেলে না। তবে এক সূত্র জানায় বগুড়া জেলায় আবাদযোগ্য খাস ভূমি ৮ হাজার ৩০ একর, আবাদযোগ্য নয় এমন খাস ভূমি (স্থাপনা, নদী, চর ও অন্যান্য) ২১ হাজার ৩শ' ২৭ একর। এই খাস ভূমির সিংহভাগই প্রভাবশালীদের দখলে।
বগুড়ায় খাস ও অর্পিত সম্পত্তি অবৈধ দখলদারদের কবল থেকে উদ্ধারে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী বড় এক উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি সকলের সহযোগিতা চেয়েছেন। গত আট মাসে তিনি সদর, শাজাহানপুর সোনাতলা উপজেলায় অভিযান চালিয়ে সরকারী ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত ১ দশমিক ৪ একর খাস ও অর্পিত সম্পত্তি অবৈধ দখলমুক্ত করেছেন। দখলদাররা দীর্ঘদিন এই জমিতে আবাসিক ও বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ করে বেআইনীভাবে ব্যবহার করছিল। সরকারের যে পরিমাণ খাস জমি অবৈধভাবে ব্যবহার হচ্ছে সে তুলনায় এই সামান্য উদ্ধার যথেষ্ট নয় তবে সরকারী কর্মকর্তা যদি উদ্যোগ নেন তাহলে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ যে সম্ভব তা তিনি (মুনীর চৌধুরী) প্রমাণ করেছেন। এখন কতটা উদ্ধার করতে পারবেন তা আগামী দিন বলে দেবে। এদিকে এক সূত্র জানায়, এই অবৈধ দখল উচ্ছেদের ওই কর্মকর্তা যখন অভিযান নিয়ে মাঠে নেমেছেন তখন প্রভাবশালীরাও বসে নেই। যুগের পর যুগ ধরে সরকারী ভূমির এই অবৈধ দখলদারদের থাবা মুক্ত হচ্ছে না। এই ভূমি দসু্যরা এতটাই শক্তিধর যে এদের সঙ্গে যুদ্ধে নামতে সরকারকেও কঠোর হওয়া দরকার এমন মনত্মব্য এক কর্মকর্তার। বগুড়ায় এই ভূমি দসু্যরা করতোয়া নদীর তীরে সদর উপজেলা কৃষি অফিসের ৬২ শতাংশ অবকাঠামো স্থাপনাসহ এক ভূমি দখলের পাঁয়তারা শুরম্ন করেছে। ষাটের দশকে এই সরকারী অফিস স্থাপিত হয় খাস ভূমিতে। এখন হঠাৎ করেই এই ভূমির এক মালিকের উদয় হয়েছে। তিনি ওই ভূমি দাবি করে বিক্রি করে দিতে চাইছেন বিতর্কিত এক প্রতিষ্ঠানের কাছে। এভাবেও ভূমিদসু্যরা খাস ভূমির মালিক তৈরি করছে। করতোয়া নদী তীরে গিয়ে দেখা যায় দুই তীরের ভূমি দখল করে বালি ফেলে ভরাট করার পর নদীর ভিতরে গিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে অবকাঠামো। শহরের নবাব বাড়ি রোডের ধারে একটি মার্কেটের পিছনের দিকে নদী দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে বহুতল মার্কেট। এই মার্কেট একটি বেসরকারী সংস্থার। সামনের দিকে তাকালেই দেখা যায় নদীর মধ্যে এক ব্যবসায়ীর অবকাঠামো স্থাপনা। এসপি ব্রিজ এলাকায় জহুরম্নল ইসলাম ঘাটের কাছে নদীর মধ্যে সীমানা প্রাচীর দিয়ে দখল করে নিয়েছে এক প্রভাবশালী। মালতিনগর চানমারী ঘাটে নদী ভূমির মধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে অবকাঠামো। বালি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বালি ফেলে নদী ভরাট করে দখল করে নিয়েছে নদী।
বগুড়ায় করতোয়া নদী ভূমির আয়তন, প্রশসত্মতা কত এই হিসাব ও খতিয়ান পাওয়া যায় না। তবে সূত্র জানায়, ১৯২০ সালের সিএস রেকর্ড ও ১৯৬২ সালের এম আর রেকর্ডে নদী ভূমির পরিমাণ ও দখলের অংশ উলেস্নখ আছে। ঢাকায় এই সিএস ও এমআর বের করলেই করতোয়া নদীর কতটা দখল হয়েছে তা মেপে হিসাব করে বের করলে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা সম্ভব। ১৯৮৭-৮৮ অর্থবছরে করতোয়া নদীর উজানে গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালিতে একটি রেগুলেটর বানিয়ে প্রবাহ অন্য নদীর দিকে টার্ন করার পর করতোয়ার মৃতু্য যাত্রা শুরম্ন হয়। করতোয়া শুকিয়ে গিয়ে এখন এমন অবস্থা যে নদীকে আর চেনাই যায় না। হাঁটু পানির এক মরা খালে পরিণত হওয়া নদীর দখল শুরম্ন হয় তখনই। দিনে দিনে দখলী প্রক্রিয়া বেড়েই গেছে। শাজাহানপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায় নদীর তীরে যার জায়গা তিনি শুকিয়ে যাওয়া সামনের নদী ভূমি দখল করে বোরো আবাদের জন্য পত্তন দিয়েছেন। যে যেভাবে পারছে এই নদী ভূমি দখল করে নিচ্ছে।
শহরের অর্পিত সম্পত্তিগুলোরও একটা অংশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের অফিস হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই সম্পত্তি লিজ নেয়া। তবে সূত্র জানায়, লিজের মাসিক ভাড়া বছরের পর বছর ধরে পড়ে থাকছে। সরকারী বিভাগ বাংলাদেশ রেলওয়ের বগুড়ায় সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ৬০ একর। রেল কর্তৃপ কিছু ভূমি লিজ দেয়ার পরও বড় একটি অংশ দখল হয়ে গেছে। দেবোত্তর সম্পত্তির মধ্যে দখল হয়েছে বগুড়ার শেরপুরের ভবানীপুর মন্দিরের ভূমি। প্রাচীন এই মন্দির অনত্মত দু' শ' বছর আগের। এই মন্দিরের রণাবেণের জন্য ৩শ' বিঘারও বেশি জমি বিভিন্ন সময়ে দান করা হয়। যার বেশিরভাগই নাটোরের রানী ভবানী মন্দিরের অনুকূলে দান করে গেছেন। দেবোত্তর এই ভূমির প্রায় সবই ভূমি দসু্যদের দখলে। এমনকি
মন্দিরের ভিতরের ৪টি শাখা পুকুরের মধ্যে ৩টি অন্যের দখলে চলে গেছে। মন্দির কর্তৃপ তাদের ভূমি উদ্ধারের মামলা মোকদ্দমা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারপরও দেবোত্তর ভূমি উদ্ধার হচ্ছে না।
বগুড়ার সারিয়াকান্দী ও ধুনটে যমুনায় প্রায় নিত্য বছর নতুন করে চর জেগে উঠছে। চর জেগে ওঠার সঙ্গেই প্রভাবশালীদের লাঠিয়ালরা গিয়ে সেই চরের দখল নিয়ে নেয়। এরপর তারা জোতদার সেজে বর্গাদারদের বসতি গড়ে দিয়ে ভোগদখল করতে থাকে সরকারের খাস ভূমি। নিয়ম অনুযায়ী এই চর ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টন করার কথা। প্রায় ৩০ বছর আগে সারিয়াকান্দীতে যমুনার বুকে নান্দিনার চর ও শংকরপুর চর জেগে ওঠে। এই দুই চরসহ অনত্মত ২৪টি চর বছরের পর বছর ধরে দখল করে আছে প্রভাবশালীরা। ধুনটেও একই অবস্থা। প্রতি বছর যমুনার তীরের এই দুই উপজেলায় নদী ভাঙছে। ভাঙন কবলিত মানুষ বসত ভিটা জমি জিরাত হারিয়ে কেউ আশ্রয় নিয়ে আছে বাঁধের ওপর। কেউ চলে যায় ভিন্ন জায়গায়। তবে তারা যমুনার কাছাকাছিই থাকে। নতুন চর জেগে উঠলে এই ভূমিহীন লোকদেরই তা পাওয়ার কথা। তা পায় না। প্রভাবশালী চক্র তা আগেই দখলে নেয়। বগুড়ার গাবতলি সোনাতলা কাহালু উপজেলাতেও আছে অর্পিত ও খাস ভূমি। সোনাতলা উপজেলা এক সময় ছিল পাটের বড় আড়ৎ। বড় গুদাম ছিল পাটের। অর্পিত এই সম্পত্তিগুলো দখল করে নিয়ে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে আবাসিক ভবন।
সরকারের খাস খতিয়ানভুক্ত ভূমির বেশিরভাগ অংশই দখলদারদের কবলে। এই ভূমি উদ্ধার করে অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রকল্প তৈরি রাসত্মাঘাট নির্মাণ, আশ্রয়ণ প্রকল্প নির্মাণসহ রাজস্ব আয়ের ব্যবস্থা করা হলে সরকার কয়েক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পেতে পারে। একই সঙ্গে ভূমিহীনদের মধ্যে খাস ভূমি বন্দোবসত্ম দিলে দারিদ্র্যতাও দূর হবে, এমন মনত্মব্য এক কর্মকর্তার।

No comments

Powered by Blogger.