কর্মক্ষেত্রে নারী প্রায়ই শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার হন- লিঙ্গবৈষম্য ৪ by শাহ আলম খান

শরীরটাই আমার জন্য কাল হয়েছে। কর্মস্থলে পুরুষ সহকর্মী থেকে শুরু করে নিয়ন্ত্রণকারী সবার বাঁকা চোখই পড়তে দেখি আমার শরীরের বিশেষ অঙ্গগুলোর ওপর।
কারণে-অকারণেই আমাকে অতিরিক্ত কাজ করতে হচ্ছে অথবা ত্রুটির নামে একই কাজ বার বার করতে হচ্ছে। আমি বুঝতে পারি আমার শরীরটা আরও একবার কাছ থেকে দেখা এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ছুঁয়ে দিতেই এসব করা হচ্ছে। কর্মস্থলে নারীর কর্মপরিবেশ সম্পর্কে এ রকম বর্ণনাই দিলেন গার্মেন্টকর্মী শায়লা বানু (ছদ্মনাম)। রাজধানীর প্রাণ কেন্দ্রেরই একটি গার্মেন্টসে সে গত দুই বছর ধরে কাজ করছে বলে জানায়।
কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে গার্মেন্টকমর্ী ফারহানা (ছদ্মনাম) স্থানীয় এক বখাটে যুবকের ইভটিজিংয়ের শিকার হতেন প্রায়ই। এক দিন-দু'দিন এভাবে প্রতিদিন। অবলা ওই গার্মেন্টকর্মী একই কারখানায় কর্মরত তার আপন বড় ভাইকে বিষয়টি জানায়। বোনের সম্ভ্রম রক্ষায় বড় ভাই ওই বখাটে যুবকের কাছে মিনতি জানায় বোনকে আর উত্ত্যক্ত না করার জন্য। কিন্তু চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী। এতে উল্টো ৰিপ্ত হয় ওই বখাটে যুবক।
পরের দিন রাত দশটা। ডিউটি সেরে কারখানা থেকে অন্য সঙ্গীর সঙ্গে বের হয় ফারহানা। তার বড় ভাইটি তখনও রাতের শিফটে কাজ করছেন। ভাড়া বাসাটি দূরে হওয়ায় একে একে সঙ্গীদের দল ছোট হয়ে আসে ফারহানার। রাসত্মায় দলবল নিয়ে ওঁৎ পেতে ছিল ওই বখাটে যুবক। তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় আসা মাত্রই ফারহানার গতিরোধ করে তারা। প্রচ- ৰিপ্ত হয়ে ওই বখাটে যুবক ঝাঁপিয়ে পড়ে ফারহানার ওপর। ফারহানা চিৎকার-চেঁচামেচি করে। কেউ সাহায্যের জন্য এগোয় না। ঘটনাটি কয়েক মাস আগে রাজধানীর ডেমরা-যাত্রাবাড়ী সংলগ্ন এলাকার।
গৃহকর্মী ইয়াসমীন ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের বিষয়টিও দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল। এর বিচারিক প্রক্রিয়াও শেষ হয়েছিল। তবু পৰপাতদুষ্ট সমাজে নারীর শরীরের ওপর পুরম্নষের অনৈতিক লোভ এতটুকু কমেনি।
গৃহকর্মী ইয়াসমীন জীবন দিয়ে লাঞ্ছনা থেকে রেহাই পেলেও প্রতিনিয়তই শায়লা বানু ও ফারহানার মতো অসংখ্য নারী শ্রমিক কর্মস্থল, যাতায়াত ও ভাড়াটে বাসায় নিরাপত্তার অভাবে এভাবেই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
কারখানা আইন ১৯৬৫ অনুযায়ী প্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমিকরা মজুরি ছাড়াও অন্যান্য সুবিধা যেমন বাসস্থান, যাতায়াত সুবিধা, ভতর্ুকিযুক্ত খাদ্য, স্বাস্থ্য সুবিধা, বোনাস, পেনশন, প্রভিডেন্ট ফান্ড, বীমা এ জাতীয় সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখে।
অথচ দেশের বিভিন্ন খাতের অধিকাংশ শিল্প-কারখানায় কর্মরত শ্রমিকরা এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে কোন ৰেত্রে পুরোপুরি বঞ্চিত। আবার কোন ৰেত্রে আংশিক বঞ্চিত। আর বাসস্থানের সুবিধাপ্রাপ্তির কথা তো চিনত্মাই করা যায় না।
যদিও রাজধানী ঢাকাতে বর্তমানে দু'টি কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল চালু রয়েছে। অতি সম্প্রতি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি আরও দু'টি মহিলা হোস্টেল চালু করার কার্যক্রম শুরম্ন করার কথা জানিয়েছে। তবে সংশিস্নষ্টরা জানান, সরকারের এ উদ্যোগ মধ্যবিত্ত ও পদবিযুক্ত নারীদের ৰেত্রেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। শীর্ণকায় শরীর নিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে দরিদ্র নারী শ্রমিক দেশকে সমৃদ্ধির লড়াইয়ে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করছে। যারা শুধু কাজের জন্যই শহরে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের স্বল্পমূল্যে ও নিরাপত্তাসংবলিত কোন নিশ্চিত বাসস্থানের জন্য সরকারীভাবে কোন উদ্যোগ নিতে কখনও দেখা যায়নি। এমনকি শিল্প মালিকদেরও শ্রমিকের বাসস্থানের ব্যবস্থা রাখায় উৎসাহিত করতে কিংবা বাধ্য করতে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
অথচ শিল্প-কারখানায় কর্মরত নারী শ্রমিকের অধিকাংশই অল্প বয়সী। বিভিন্ন তথ্য সূত্রে দেখা গেছে, ১৫-৩৪ বা ১৫-২৪ বছর সময়সীমার মহিলাদের ৰেত্রে কর্মসংস্থানের হার সবচেয়ে বেশি। এই অল্প বয়সী নারী শ্রমিকের একটি বড় অংশই শহরের নতুন জীবন ব্যবস্থা, বাসস্থান, নিরাপত্তা, কাজের পরিবেশ_এসব ৰেত্রে অভ্যসত্ম না হওয়ায় প্রতিনিয়ত বিপর্যস্ত অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) একাধিক গবেষক গার্মেন্টস নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতার কারণ খতিয়ে দেখেছেন। গবেষকরা তাদের অনুসন্ধানে দেখেছেন দেশে অধিকাংশ গার্মেন্টস অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে এবং তা বিশেষ কিছু এলাকায়ই কেন্দ্রীভূত। আইনশৃঙ্খলা রৰাকারী বাহিনীর উপস্থিতিও এসব এলাকায় খুব কম। এ কারণেই একজন অল্পবয়স্ক নারী শ্রমিক নিজ বাড়ি কিংবা ভাড়া বাসা থেকে কারখানায় আসা-যাওয়ার পথে প্রায়ই যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে।
অন্যদিকে বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন বাসা-বাড়িতে কর্মরত গৃহভৃত্যদের সম্পর্কে বলেন, গৃহভৃত্যের কাজে সাধারণত কিশোরী কিংবা অল্প বয়স্ক মহিলাই বেশি নিয়োজিত। এরা মূলত বাসস্থানের অভাবেই দুঃসম্পর্কের কারও বাড়ি কিংবা পূর্ব পরিচিত কারও মাধ্যমে অন্য কোন বাড়িতে কাজ নেয়। কিন্তু গৃহভৃত্যের কাজ করতে গিয়ে এসব কিশোরী কিংবা অল্প বয়স্ক মহিলা দিনের পর দিন গৃহকর্তা-গৃহকত্রর্ীর অমাণবিক আচরণের শিকার হন। কখনও কখনও গৃহকর্তা কিংবা গৃহকর্তার পুত্রদের দ্বারা এরা শারীরিক নির্যাতন কিংবা যৌন হয়রানিরও শিকার হচ্ছে। অথচ এদের সম্ভ্রম রৰায় রাষ্ট্রীয়ভাবেই নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। তিনি মনে করেন, ঘটনা প্রকাশিত হলে এই ৰেত্রে কখনও কখনও নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের প্রয়োগ হলেও দুর্বল আইনের কারণে তাতেও ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে অভিযুক্তরা। আর এ ৰেত্রে অধিকাংশ গৃহকমর্ীর শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের ঘটনাই অপ্রকাশিত থেকে যাচ্ছে।
বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ সংশ্লিষ্টরা এ ধরনের অনাকাঙ্ৰিত ঘটনার কথা স্বীকার করেছে। সরকারও এসব বিষয়ে যথেষ্ট অবগত রয়েছে। পত্রপত্রিকায়ও এ ধরনের অনাকাঙ্ৰিত ঘটনা সরেজমিন তুলে ধরা হচ্ছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে কর্মস্থলে নারী শ্রমিকের নিরাপত্তা রৰায় গৃহীত কোন উদ্যোগ এখনও চোখে পড়ে না। কেউ কেউ দাবি করছেন, কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এর সমাধান সম্ভব। আবার কেউ বলছেন, পুরম্নষের মানসিকতার পরিবর্তন না হলে নারীরা এর থেকে কখনও পরিত্রাণ পাবে না।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী কর্মস্থলে নারী শ্রমিকদের নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। বাসত্মবতার নিরিখেই তিনি বলেন, সামাজিকভাবেই মেয়েরা দুর্বল। দেশের প্রেৰাপটে এখনও মেয়েরা সেভাবে গড়ে উঠতে পারেনি। তাই কর্মস্থলে বিশেষ করে শিল্প-কারখানায় কর্মরত মেয়েরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তাঁর মতে, নারী শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও শিল্প-কারখানা রৰায় জরম্নরী ভিত্তিতে প্রয়োজন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ বাহিনী গঠন।

No comments

Powered by Blogger.