বাংলাদেশের রাজনীতির বাস্তবতা by মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

বিগত বছরটা রাজনীতিতে কেমন কাটল এমন প্রশ্নের উত্তরে কেউ বলবেন ভালো, কেউ তা বলতে চাইবেন না। অথচ দেশের রাজনীতিটাই মোটা দাগে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে।
যাঁরা ডানের চিন্তায় বিশ্বাস করেন, তাঁদের কাছে বছরের রাজনীতির মূল্যায়ন কী হতে পারে তা প্রতিদিন বেসরকারি টিভি চ্যানেলের খবরে সেই রাজনীতির নেতাদের মুখ থেকেই শোনা যাচ্ছে। এ ছাড়া তাঁদের আদর্শে পরিচালিত পত্রিকাগুলোর পাতার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। উদার গণতন্ত্রে বিশ্বাসীদের অবস্থান এবং বক্তব্য ততটা একরৈখিক বলে মনে হচ্ছে না। সমালোচনা এ ক্ষেত্রে ছিল, আছে এবং থাকবেই। তবে বিশ্লেষক, গবেষক ও পর্যবেক্ষক মহলকে সংকীর্ণ দলীয় অবস্থানের ঊর্ধ্বে উঠেই মতামত দিতে হয়, তাতে বাস্তবতার প্রতিফলিত ধারণা পাওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশে রাজনীতির বিশ্লেষণে তেমন অবস্থানে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এখন সেদিকেই দৃষ্টি দিতে হবে।
২০১০-এ যাত্রা শুরু হয়েছে পূর্ববর্তী বছর ২০০৯-এর বাস্তবতা ও প্রত্যাশাকে সম্বল করেই। সবারই জানা কথা যে ২০০৯ সাল বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি উত্তরণীয় পর্ব। ২০০৭ ও ২০০৮ দুই বছর ছিল একটি বিশেষ ক্রান্তিকাল, সেনাসমর্থিত বিশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরের শাসন ছিল এক ধরনের অনিশ্চয়তার সময় এবং বাস্তবতা। অথচ হাজারো দ্বিধাদ্বন্দ্ব, হতাশা এবং অনিশ্চয়তার মধ্যেও দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হলো সেই সময়ে, জনগণের প্রকৃত রায়ও পাওয়া গেল, গণতন্ত্রে উত্তরণের আকাঙ্ক্ষার বিস্ফোরণও ঘটল। তবে বড় ধরনের পরিবর্তনের উত্তাল ঢেউ বয়ে গেল রাজনীতির বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের ওপর দিয়ে। অবশেষে দিনবদলের পালে হাওয়া দিয়ে দেশের রাজনীতি ২০০৯ সালে প্রবেশ করেছে। কেউ কেউ পরিবর্তনটি যতটা দেখতে চেয়েছিলেন ততটা না দেখে হতাশ হয়েছেন। তবে রাজনীতির সব প্রবণতা ও প্রপঞ্চ সব সময় খালি চোখে দেখা যায় না; বোঝাও যায় না। কিন্তু গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখলে কিংবা তুলনামূলক বিশ্লেষণের চেষ্টা করলে পরিবর্তনের প্রকৃত ধারা ও গতিপ্রবাহ কমবেশি দেখা বা বোঝা যাবেই। ২০০৯ সালে রাজনীতিতে পরিবর্তনের যে ধারা সূচিত হয়েছে, তা ২০১০ সালে কমবেশি অব্যাহত ছিল বা আছে। ২০০৯ সালে গঠিত গণতান্ত্রিক সরকার বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ধারায় ফিরিয়ে আনার অবস্থানকে অনেকটাই অতীতের দোদুল্যমানতা থেকে মুক্ত হয়ে দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করেছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের বিপুল রায়, যা প্রত্যাশা, বাস্তবতাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। একসময় ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে বাংলাদেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভুলে গেছে; রাজাকার, সুবিধাবাদী ও ইতিহাস বিকৃতকারীদের কাছে আত্মসমর্পণ করে ফেলেছে। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে সেই প্রচারণা খুবই ঠুনকো ছিল, মোটেও বাস্তবতানির্ভর ছিল না। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের রাজনৈতিক দৃশ্যপট মানুষের মনে মুক্তিযুদ্ধের আবেগকে নতুনভাবে নাড়া দেয়, ৩০ লাখ শহীদের আত্মার আর্তনাদ ও ক্রন্দন যেন ভেসে উঠতে থাকে, তারই ফলে সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এ সবই যেন রাজনীতির ইতিহাসে নীরব এক সমাজ অভিঘাত সৃষ্টি করে। ২০০৯ সালে সেই অভিঘাত পরিবর্তনই যেন রাজনীতিতে দৃশ্যমান হলো। বাহ্যিকভাবে এর বিস্তার প্রত্যাশামতো হয়তো মনে হয়নি; কিন্তু বাংলাদেশের মতো সামগ্রিক পশ্চাৎপদ দেশ ও সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের বস্তুগত ভিত্তিই অত্যন্ত দুর্বল, অনেকটাই অনুপস্থিত। সুতরাং প্রত্যাশা ও বাস্তবতার যৌক্তিক ভিত্তিটা বিবেচনায় নিয়েই পরিবর্তনের মূল্যায়নকে দেখতে হবে। আমার রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ বলছে যে, ২০০৯ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, উদার গণতান্ত্রিক ধারণা এবং অসাম্প্রদায়িক ধারার রাজনীতিতে উত্তরণ ঘটিয়েছে। সমাজের অভ্যন্তরে টিকে থাকা বিভাজিত নানা শক্তির সমাবেশ এ বাস্তবতাকে ২০০৯ সালে গুণগত পরিবর্তনের এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে আসে, যা আগে এতটা স্পষ্ট, দৃঢ় ও অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল না। একই সঙ্গে ৭৫-পরবর্তী ধারার রাজনীতি এই সময়ে একটি বড় ধরনের ধাক্কায় পড়ে, যা ডান, উগ্র ও জঙ্গিবাদী রাজনৈতিক শক্তির বিবেচনা তেমনভাবে ছিল না। তারা ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে বেপরোয়া আচরণ করেছিল, উদার গণতান্ত্রিক শক্তিসহ সব শুভবুদ্ধিকেই অবজ্ঞা করেছিল, তছনছ করে দেওয়ার সব ষড়যন্ত্র করেছিল। এরই প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাংলাদেশের সমাজবাস্তবতার মধ্যে লীন হয়ে থাকা প্রগতিশীলতার বেশির ভাগ শক্তিই নতুনভাবে অস্তিত্বকে জানান দেওয়ার চেষ্টা করে। তাতে কুপোকাত হয়ে পড়ে ডান প্রতিক্রিয়াশীল, পশ্চাৎপদ, ভ্রান্ত জাতীয়তাবাদের ছায়াতলে আশ্রয় নেওয়া সব রাজনৈতিক অপশক্তি। বাংলাদেশের সমাজ-অভ্যন্তরে এই দুই রাজনৈতিক ধারার লড়াই অনেকেরই চোখের বা বিশ্লেষণের বাইরে থাকে, ধরা দেয় না। কিন্তু দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও লড়াইটা মূলত এই দুই ধারার রাজনীতিরই। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়ায় মুক্তিযুদ্ধের ধারার রাজনীতিতে, সেই রাজনীতিই ২০১০ সালেও লড়াই করেই অবস্থান করছে। জঙ্গি, উগ্র, হটকারী এবং মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি ২০১০ সালে সর্বতোভাবে ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করেছে। বিএনপিকে ব্যবহার করে এই শক্তি অতীতে যতটা তাড়াতাড়ি শক্ত অবস্থানের ওপর দাঁড়াতে পেরেছিল, ২০১০ সালে কিন্তু তাদের পক্ষে সেটি করা সম্ভব হয়নি। সরকার রাজনৈতিকভাবে ২০১০ সালে বড় ধরনের কোনো ভুল করেনি, ২০০৯কেই যেন অনেকটা টেনে এনেছে এই বছরেও। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিকে ২০১০ সালে ট্রাইব্যুনাল গঠনসহ বাস্তবে রূপ দেওয়ার একটি পর্যায়ে উন্নীত করেছে। নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদী, সাকা চৌধুরীসহ ১৯৭১-এর কয়েকজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করাসহ ইস্যুটিকে বিচারের আওতায় আনতে পারাটি ২০১০ সালের অন্যতম আলোড়িত রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হতে পেরেছে। বাংলাদেশে নিজামী-মুজাহিদ, সাঈদী-সাকাসহ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা যাবে, কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে_তা অনেক বছরই দেশে ভাবা যায়নি, কিন্তু ২০১০ সালে সেটিই সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি জনগণের বিশ্বাস ও আস্থার পুনর্জনম না ঘটলে ২০১০ সালের রাজনীতিতে এসব বিস্ময়কর ঘটনা হয়তো ঘটত না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে উদারবাদী গণতন্ত্রের একটি সবল দিক দৃশ্যমান হওয়ার ইঙ্গিতই এসব ঘটনা প্রদান করছে। দেশের রাজনীতিকে যাঁরা সমাজের অভ্যন্তরের নানা উপাদানের ক্রিয়া, প্রতিক্রিয়া ও মিথস্ক্রিয়ায় দেখেন, বিচার-বিশ্লেষণ করেন তাঁরা ২০১০-কে সেভাবেই হয়তো মূল্যায়ন করবেন।
বছরের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ঘটনার অন্য প্রান্তে বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা লক্ষ করা গেছে। তবে বিএনপি পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতাকে এ সময়েও খুব একটা আমলে নেয়নি। ভারতবিরোধিতা, ধর্ম ইত্যাদি ইস্যুকে বিএনপি আঁকড়ে ধরার চেষ্টা বারবার করেছে, কিন্তু সেগুলো অতীতের মতো কাজে লাগেনি। জনগণের কাছে বিএনপির কথাগুলো তেমন একটা সমাদৃত হয়নি। বিএনপি রাজনৈতিক ইস্যুগুলোর চেয়েও বেগম খালেদা জিয়ার বাড়ি, তারেক-কোকোর মামলা প্রত্যাহারসহ ব্যক্তিগত বিষয়গুলোকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে দলীয়ভাবে ঘুরে দাঁড়াতে সচেষ্ট ছিল। তবে জাতীয় রাজনীতির কোনো শক্তিশালী ইস্যু নিয়ে বিএনপি বা তার মিত্র দলগুলো জনগণের কাছে ২০১০ সালে যায়নি_এটি বেশ লক্ষণীয় বিষয়। ২০১০ সালের রাজনৈতিক গতিপ্রবাহ যে সত্যটি তুলে ধরে তা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের ধারার রাজনীতি যদি ২০০৯ সালের পরিবর্তিত বাস্তবতার প্রতি দায়বদ্ধ থেকে দেশের জনগণের আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা-সংস্কৃতিসহ সর্বক্ষেত্রে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে চলতে পারে, কাজ করে যায়, তাহলে বাংলাদেশে উদার গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে সক্ষম হবে; একই সঙ্গে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসী, প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর বিস্তার ঐতিহাসিক নিয়মেই দুর্বল হতে বাধ্য। বাংলাদেশ আগামী দিনের রাজনীতিতে সূচিত এসব বাস্তবতাকে কতখানি ধরে রাখতে কিংবা বিকশিত করতে পারবে, তা অবশ্যই নির্ভর করছে বর্তমান মহাজোট সরকারের সতর্ক পদক্ষেপের ওপর। আবেগ বা বাগাড়ম্বরতা_এর কোনোটিই কাম্য নয়। কেননা, রাজনীতিতে এ দুটিরই পরিণতি প্রগতিশীলদের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনে। সুতরাং আত্মতৃপ্তি নয়, বরং ব্যাপক রাজনৈতিক সচেতনতাই দেশকে উন্নতি ও অগ্রগতির দিকে এগিয়ে নিতে পারে।

লেখক : ইতিহাসতত্ত্ববিদ ও অধ্যাপক
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.