কোথায় যাবে এ দেশের গণতন্ত্র? by এ জেড এম আবদুল আলী

দেখতে দেখতে আরেকটি বছর অতিক্রান্ত হলো। নতুন বছরের শুরুতেই আমরা মনে মনে, কখনো প্রকাশ্যে অন্যদের শুনিয়েই ব্যক্তিগত নানা রকম প্রতিজ্ঞা করে থাকি। এটা করব না, ওটা করব। এটা হতে দেব, ওটা হতে দেব না।
তারপর বছর শুরু হওয়ার কিছু পরই ভুলে যাই সেসব কথা। ফলে কোনো কিছুই হয় না। আমরা যেখানে ছিলাম, সেখানেই থেকে যাই। শুধু বয়সটা বাড়ে। আমরা মৃত্যুর দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে যাই। জানি না, আমাদের সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে এ রকম, মানে নতুন বছরের শপথ নেওয়ার মতো কিছু করে কি না। সেটা জানতে পারলে আমরা দেশের সাধারণ নাগরিকরা অনেক কিছু বলতাম। বলতাম, কোন কাজটি সরকারের ভালো হয়েছে, কোনটি ভালো হয়নি। সরকার হয়তো কিছু শুনত, কিছু শুনত না। শুনলে আমরা খুশি হতাম। আরেকটি নির্বাচন এবং বর্তমান সরকারের আরেকটি টার্মের আশা করতাম।
এ সরকারের দুই বছর হয়ে গেল। এখন পর্যন্ত কোন দিকে পাল্লা ভারী? অনেক দিকেই ভালো কাজ হয়েছে। তবে খারাপ হয়েছে যে দু-একটি, সেগুলোই বোধ হয় পাল্লাটি সরকারের বিরুদ্ধে ভারী করে রেখেছে। দ্রব্যমূল্য সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। কেন পারেনি, তার ব্যাখ্যা হয়তো অনেক আছে; কিন্তু ব্যাখ্যা শুনে মানুষ খুশি হয় না। আইনশৃঙ্খলা? সেখানেও বিশেষ কিছু বলার নেই। এসব খারাপ খবরের ওপর আবার মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো নেমে এসেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের শেষ প্রতিবেদনটি। মানুষ হতবাক হয়েছে এ কথা শুনে যে ওদের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের বিচার বিভাগে গত তিন বছরে দুর্নীতি সর্বাপেক্ষা বেশি বেড়েছে। একটি ইংরেজি পত্রিকায় খবরটি এভাবে এসেছে, 'Corruption in Service Sectors : National Household Survey 2010' says among the judiciary, the High Court is where exchange of kickback takes place the most. কী ভয়াবহ কথা! দেশের উচ্চ আদালতই যদি দুর্নীতিতে ভরে যায়, তবে নিম্ন আদালত এবং অন্যান্য ক্ষেত্রের কথা তো না বলাই ভালো। শুনেছি, ট্রান্সপারেন্সির সম্পূর্ণ প্রতিবেদনে নাকি বলা হয়েছে যে শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি কমেছে। কিন্তু সে খবর আর কে শুনতে চায়? যদিও ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, সেটা একটা বড় খবর। সে যা-ই হোক, কিভাবে এ জরিপ করা হলো সে সম্পর্কে অনেকে অনেক প্রশ্ন তুলছেন। জরিপের মেথডলজি একটি বড় কথা। কী পদ্ধতি অবলম্বন করে জরিপটি হলো? দুর্নীতির মতো জটিল বিষয়টি কতখানি বেড়েছে বা কতখানি কমেছে তা জানার কোনো সহজ বা নিশ্চিত পদ্ধতি আছে কি?
যা-ই হোক, আমরা একটি বড় খবরের কথা জানি। যদিও খুব কম কাগজেই সে খবরটি বিস্তারিতভাবে উঠেছে। খবরটি জানতে আমি সেই খবরের উৎসে গিয়েছি ওদের ওয়েবসাইটে। ইকোনমিস্ট পত্রিকার ইন্টেলিজেন্স ইউনিট একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা। সেখানে যা বের হয়, তা নিয়ে সারা বিশ্ব চিন্তাভাবনা করে। সেখানেই লেখা হয়েছে যে গত দুই বছরে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের যাত্রায় অভাবিত অগ্রগতি হয়েছে। পৃথিবীর ১৬৭টি দেশের গণতন্ত্রের এগোনো বা পেছানো নিয়ে এরা প্রতি দুই বছর পর পর একটি সূচক বের করে। দেখা যাচ্ছে, সেই সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশের গণতন্ত্র আগের চেয়ে ৯ ধাপ এগিয়েছে। ২০০৮ সালে যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল সূচকের ৯১তম স্থানে, সেখানে গত দুই বছরে দেশটি ওপরে উঠে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৮৩তম স্থানে। উল্লেখ্য, এ সূচকটি যাঁরা করেছেন তাঁরা কোন পদ্ধতিতে এ সূচক তৈরি করেন, কী কী বিষয় নিয়ে এ সূচক তৈরি হয় সেগুলোর লিখিত ব্যাখ্যা দিয়ে দেন। দুর্নীতি সম্পর্কে ধারণার মতো কিছু নয়। একেবারে নিরেট তথ্য-উপাত্ত থাকে সেখানে। সবচেয়ে বড় কথা এই যে গণতন্ত্রের অগ্রগতি হওয়া একটি দেশের জন্য সবচেয়ে বড় পাওয়া। গণতন্ত্র যদি ঠিকমতো শিকড় বাঁধতে পারে, তবে সে দেশ সব রকম ঝড়ঝঞ্ঝা সামলে উঠতে পারে; ঠিক যেভাবে পশ্চিমের দেশগুলো সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। ভারত যেমন সামলানোর চেষ্টা করছে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সেখানের মোবাইল টেলিকমিউনিকেশন ওয়েভলেংথ বণ্টনসংক্রান্ত দুর্নীতির বিষয়টি।
আমরা বাঙালিরা অত্যন্ত আবেগপ্রবণ জাতি। আমাদের সামনে আজ যা ঘটে, তাই আমাদের দারুণ প্রভাবান্বিত করে। আমরা পেছনের কথা ভুলে যাই। অতীতের তিক্ততা কি আমাদের কম রয়েছে? তবু আমরা আজ সেসব কথা ভুলে গিয়ে বর্তমানের কথাই ভাবছি। সে জন্যই এখন আমাদের প্রয়োজন এ গণতন্ত্রের কথা ভাবার। ১৬৭টি দেশের মধ্যে ৮৩তম অবস্থানে পেঁৗছানো খুব সামান্য একটি অর্জন নয়। এটি প্রকৃতপক্ষে একটি বিরাট সাফল্য।
ওই সূচকের নির্মাতারা জরিপ করা ১৬৭টি দেশকে চারটি ভাগে ভাগ করেছেন। ০ থেকে ১০ পর্যন্ত নম্বরের একটি সারণি করা হয়েছে। যেসব দেশ ৮ থেকে ১০ নম্বর পেয়েছে, সেগুলোকে বলা হচ্ছে, পূর্ণ গণতন্ত্র (Full Democracy)। সেগুলো অত্যন্ত টেকসই গণতন্ত্রের দেশ, যেমন_নরওয়ে, সুইডেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ইত্যাদি। তারপর যেসব দেশ পেয়েছে ৬ থেকে ৭.৯ পর্যন্ত নম্বর, তাদের বলা হচ্ছে ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র (Flawed Democracy)। ভারত রয়েছে এই দলে। আরো রয়েছে ফ্রান্স, ইতালি প্রভৃতি দেশ। এরপর যেসব দেশের অর্জন ৪ থেকে ৫.৯ পর্যন্ত, তাদের বলা হচ্ছে সংকরতন্ত্র (Hybrid Regime)। বাংলাদেশ এখন এ ধাপেই আছে। তবে এই ধাপের অনেক ওপরে আছে। যেসব দেশের অর্জন এরও নিচে অর্থাৎ যে দেশগুলোর অর্জিত নম্বর ০ থেকে ৩.৯ পর্যন্ত, তাদের বলা হচ্ছে স্বৈরতন্ত্র (Authoritarian Regime)।
জানি না, আগামী বছর আমাদের দেশের ভাগ্যে কী আছে। দুর্নীতি বাড়বে কী কমবে অথবা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা-ও বলা খুব কঠিন। দেশের জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে, তাতে দ্রবমূল্য কমার বা স্থিতিশীল হওয়ার সম্ভাবনা কতখানি আছে, তা নিয়েও ভাবার অনেক কিছু আছে।
আমরা বিশেষ করে একটি আশাই করব_আমাদের দেশের গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা যেন আগামী ২০১১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এমনি অব্যাহত থাকে। আমরা আর মাত্র তিন ধাপ এগোলেই এ সূচকের দ্বিতীয় পর্যায়ে অর্থাৎ ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রে বা ওরা যাকে ইংরেজিতে বলছে ঋষধবিফ উবসড়পৎধপু, সেই পর্যায়ে উঠে যাব। পূর্ণ গণতন্ত্র হওয়া হয়তো আমরা আমাদের জীবনে দেখে যেতে পারব না, কিন্তু ওই দ্বিতীয় ধাপটিতে উঠতে পারলেই চলবে। মনে রাখতে হবে যে সেখানে আছে ভারত, ফ্রান্স এবং ইতালির মতো দেশ। ফ্রান্স একসময় ছিল স্বাধীনতা, সাম্য এবং বন্ধুত্বের_লিবার্টি, ইকুয়ালিটি এবং ফ্র্যাটারনিটির দেশ। আমরা যদি তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারি সে কি ছোটখাটো সাফল্য হবে?
এ বছর আমরা বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার করে সেই শাস্তি কার্যকর করেছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। পঞ্চম এবং সপ্তম সংশোধনী বাতিল করতে পেরেছি, পেয়েছি সংবিধানকে আবার তার পুরনো অবস্থানে ফিরিয়ে আনার যোগ্যতা। এসব এক হিসেবে কিছু কম অর্জন নয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় অর্জন হিসেবে আমি ধরব গণতন্ত্রের এ অগ্রযাত্রাকে। ইতিমধ্যে জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থা বা ইউএনডিপি আমাদের দেশের মানবোন্নয়ন অগ্রগতির স্বীকৃতি দিয়েছে।
বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মানবোন্নয়নের অগ্রগতি। এবার এই সূচকটি গণতন্ত্রের অগ্রগতির কথা বলছে। গণতন্ত্র যদি থাকে, তবে সব কিছুই ঠিক পথে চলতে পারে। ছোটখাটো হোঁচট খেলেও জাতি আবার সঠিক পথে চলতে পারে। আমরা 'জয় বাংলা' বলে হাঁটতে শুরু করেছিলাম। আবার আমরা সেই জয়ের পথে হাঁটব। কেউ আমাদের আর থামাতে পারবে না।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.