প্রত্যাশার খতিয়ান by ড. নিয়াজ আহম্মেদ

২০১১ স্বাগতম। বর্তমান মহাজোট সরকার আগামী ৬ জানুয়ারি তাদের দুই বছর অতিক্রম করবে। বিদায়ী বছরটি ছিল ঘটনাবহুল। রাজনৈতিক সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা অন্য যেকোনো সরকারের চেয়ে ঢের বেশি। কেননা, রাজনৈতিক সরকারের রয়েছে জনগণের কাছে জবাবদিহিতা।
জনগণের কাছে সরাসরি জবাবদিহিতার বিষয়টি সবার কাছে বোধগম্য না হলেও পাঁচ বছর পর পর নির্বাচনের সময় তাদের কাছে ভোটপ্রত্যাশার সময় জবাবদিহিতার প্রশ্নটি জোরালোভাবে উপলব্ধি করা যায়। জনগণ মনে করে, যেহেতু তাদের ভোটে সরকার গঠিত হয়, সেহেতু সরকার তাদের কল্যাণে কাজ করবে। এমনকি রাজনৈতিক সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিও জনগণের কল্যাণে কাজ করা। কিন্তু কোনো না কোনো কারণে রাজনৈতিক সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়। যে আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জনগণ ভোট দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেয়, তারা সেই দায়িত্ব যথাযথ সম্পাদন করতে পারে না পারায় পাঁচ বছর পর নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে। অবশ্য মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ছাড়া অন্য অনেক কারণও থাকতে পারে, কিন্তু আশা-আকাঙ্ক্ষাকে খাটো করে দেখলে চলবে না। আবার আশা-আকাঙ্ক্ষা শুধু যে বৈষয়িক, তাও কিন্তু নয়। সরাসরি আর্থিক সুবিধা ছাড়া অন্য অনেক বিষয় সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করে, যা মানুষকে মানসিক সন্তুষ্টির পরিপূর্ণতা অর্জনে সহায়তা করে।
গত ২০ বছরে কোনো রাাজনৈতিক সরকারই পরপর দুবার ক্ষমতায় আসতে পারেনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ_এ ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন মতামত ব্যক্ত করে থাকে। তবে সবার কাছে সাধারণ একটি কারণ হলো, ক্ষমতাসীনদের জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থতা রাজনৈতিক সরকারকে পরপর দুবার ক্ষমতাসীন করতে বাধা প্রদান করে। প্রতিটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনের আগে অনেক প্রতিশ্রুতি দেয়। মূলত ভোটারদের ভোটদানে আকৃষ্ট করাই এর মূল লক্ষ্য। কিন্তু প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নের সঠিক পন্থা নির্ধারণে রাজনৈতিক দলগুলো ব্যর্থ হয়। মানুষ প্রতিশ্রুতির পাল্লা ভারি দেখতে চায় না, দেখতে চায় প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের পাল্লা ভারি। রাজনৈতিক বুলি আওড়ানোর ধারাবাহিকতায় পাঁচ বছর কেটে যায়। একপর্যায়ে দেখা যায়, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবায়িত কর্মকাণ্ডের মধ্যে বড় ব্যবধান। ফলে জনগণ সরকারের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অন্য একটি দলকে ক্ষমতাসীন করে। এভাবেই চলতে থাকে রাজনৈতিক সরকারের পালাবদল। এ দুই বছরে মহাজোট সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা কী ছিল আর এর বিপরীতে প্রাপ্তি কতটা, সে হিসাব-নিকাশ চলছে।
সাধারণ মানুষ আর রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের আশা-আকাঙ্ক্ষার মধ্যে রয়েছে অনেক পার্থক্য। নেতা-কর্মীরা চান দ্রুত সবকিছু পেতে। এটি যেন তাঁদের অধিকার। কেননা, তাঁরা পাঁচ বছর ক্ষমতার বাইরে ছিলেন। ভবিষ্যতে আবার ক্ষমতায় আসতে পারবেন কি না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই তো যত দ্রুত সম্ভব অর্থ উপার্জনের জন্য নেতা-কর্মীরা মরিয়া হয়ে ওঠেন। টেন্ডারবাজি থেকে শুরু করে তদবিরের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের নেশায় মেতে উঠেছেন তাঁরা। ইতিমধ্যে এ চিত্র অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে চোখে পড়েছে। আবার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য মারামারি ও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করতেও পিছপা হয় না। প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সব কিছুর মধ্যে রাজনীতি খোঁজার পাঁয়তারা শুরু হয়। অতিক্ষুদ্র বিষয় যেমন_ পারিবারিক উঠবোসের মধ্যে খোঁজা হয় রাজনীতি। তাই তো দল ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে রিকশাশ্রমিক ইউনিয়ন থেকে শুরু করে বৃহৎ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সবল হতে দেখা যায়। সংগঠনগুলোর অফিস শোভা বর্ধন করে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় তাদের দেখা যায় না। আবার অনেকে দল পরিবর্তন করে সবসময় সরকারি দলে থাকতে পছন্দ করে। সর্বত্রই হালুয়া-রুটির ধান্ধা। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা সাদামাটা ও ক্ষীণ। তারা চায় মোটামুটিভাবে খেয়ে-পরে থাকতে এবং শান্তিতে ঘুমাতে। আমাদের দুর্ভাগ্য, প্রতিটি সরকারই মানুষের নূ্যনতম প্রত্যাশা পূরণ করতে সক্ষম হয়নি। অথচ বাংলাদেশ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে যথেষ্ট এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থপ্রবাহ যথেষ্ট বাড়ছে কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না। গত কয়েকটি রাজনৈতিক সরকারের শুরুটা খারাপ ছিল না। কিন্তু ক্রমান্বয়ে সরকারগুলো তাদের সমর্থন ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের নিজেদের যেমন ব্যর্থতা রয়েছে, তেমনি রয়েছে নেতা-কর্মীদের লাগামহীন দৌরাত্ম্য। রয়েছে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের মহাপরিকল্পনার অভাব। স্বপ্ন, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব, বিগত সরকারের অসমাপ্ত ও দুর্বল কর্মকাণ্ড এবং প্রতিহিংসার রাজনীতি চরিতার্থ করা তাদের ব্যর্থতার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। মোদ্দাকথা, ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় তাদের বোধোদয় খুবই কম হয়। কেউ আঙুল দিয়ে দুর্বলতা ধরিয়ে দিতে চাইলেও তাকে ভুল বোঝা হয়। শুধু এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে শাস্তি দিতে দ্বিধা করা হয় না। তার মতামত নিদেনপক্ষে সঠিক কিন্তু ক্ষমতার অহঙ্কারে তাকে দল থেকে বহিষ্কার পর্যন্ত করা হয়। শুধু ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের চরিত্র এ রকম নয়, বিরোধী দলের চরিত্রও একই।
সরকারের কর্মকাণ্ডের মধ্যে কিছু সফলতা দীর্ঘ সময়ে পাওয়া যায়, আবার অনেক কর্মকাণ্ডের ফল স্বল্পমেয়াদে ফুটে ওঠে। আবার সাধারণ মানুষ সব কিছু দ্রুত প্রত্যাশা করে। একটি সরকারের ভালো কাজগুলো পরবর্তী সরকার এগিয়ে নিয়ে গেলে সাধারণ মানুষ দীর্ঘমেয়াদে এর সুবিধা ভোগ করে। কিন্তু সরকারের মতাদর্শ ও মূল্যবোধের কারণে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সরকারের নীতি ও পরিকল্পনায়ও পরিবর্তন ঘটে। ফলে নতুন নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণে সময়ক্ষেপণ এবং কর্মকাণ্ড শুরু করতে আবার নতুন করে সময় লেগে যায়। এতে করে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ বিলম্বিত হয়। সরকারের ধারণা, ক্ষমতায় থাকাকালে সব কিছু বাস্তবায়ন করতে হবে। না হলে পরবর্তী সময়ে ক্ষমতাসীন হওয়া যাবে না_এ কথাটি একদিকে যেমন ঠিক, অন্যদিকে তেমনি সঠিক নয়। ভালো পরিকল্পনা দীর্ঘমেয়াদি হলে জনগণ তা উচ্ছ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে এবং সরকারকে উৎসাহ জোগায়। ঘুণেধরা এ ধরনের বিশ্বাস থেকে সরকারের বেরিয়ে আশা উচিত। তাহলে সাধারণ মানুষের সাময়িক ক্ষুধা হয়তো বিতাড়িত হবে কিন্তু উন্নতি ও প্রগতির ধীরগতি কমবে না বৈকি। বিশ্লেষকরা হয়তো বলে থাকবেন, বাংলাদেশের উন্নতি ও প্রগতির একটি বড় বাধা বারবার ক্ষমতার পরিবর্তন। তাঁদের কথাটি সত্য হলে কেন রাজনৈতিক সরকারগুলো নিজেদের পরিবর্তন করছে না। বিশ্বের অনেক দেশে দেখেছি যেখানে একটি রাজনৈতিক দল পরপর দুবার ক্ষমতাসীন হয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও কংগ্রেস জোট পরপর দুবার ক্ষমতায় এসেছে। আমরাও চাই, সরকারগুলো তাদের সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন নীতি, পরিকল্পনা ও কর্মসূচির মাধ্যমে বারবার ক্ষমতায় এসে উন্নতি ও প্রগতির ধারাকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাবে। সুন্দর ও ভালোভাবে কাটুক এ বছরটি_এই প্রত্যাশা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সবার।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
neayahmed-2002@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.