চরাচর-কালের সাক্ষী গঙ্গাসাগর দিঘি by শরাফত হোসেন

ত্রিপুরা রাজ্যের ভাটি অঞ্চলের খাজনা আদায়ের মহল অফিস ছিল রাজদরগঞ্জ বাজারে। মোগড়া বাজারের পার্শ্ববর্তী এলাকা রাজদরগঞ্জ বাজার। এখানে 'সেনাপতি বাড়ি' নামে একটি জায়গা আছে।
তাই মনে করা হয়ে থাকে, ত্রিপুরা রাজ্যের কোনো এক সেনাপতি স্থায়ী কিংবা অস্থায়ীভাবে বসবাস করতেন এই অঞ্চলে। ত্রিপুরার রাজা এখানে বিরাট একটি দিঘি খনন করিয়ে গঙ্গা দেবীর নাম অনুসারে দিঘির নামকরণ করেন 'গঙ্গাসাগর দিঘি'। সেই থেকে ক্রমে ক্রমে জায়গাটি গঙ্গাসাগর নামে পরিচিতি লাভ করে। অতীতে নৌপথের গুরুত্ব যখন বেশি ছিল, তখন হাওড়া নদীর তীরবর্তী গঙ্গাসাগর ছিল মূলত আগরতলার নদীবন্দরস্বরূপ। গঙ্গাসাগর দিঘির উত্তর পাড়ে রয়েছে বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা। সংরক্ষণের অভাবে সবই এখন জীর্ণ। কিছু স্থাপনা গাছগাছালিতে জঙ্গলপ্রায়। উত্তর-পূর্ব কোণের মেরামত করা একটি ভবনে চলছে মোগড়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কাজ। রাজদরগঞ্জ বাজারে তৎকালীন সময়ে দি অ্যাসোসিয়েটেড ব্যাংক লিমিটেড অব ত্রিপুরার প্রধান অফিস স্থাপিত হয়েছিল। তখনো উপমহাদেশে ব্যাংকের প্রচলন সঠিকভাবে হয়নি। মোগড়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সহকারী ভূমি কর্মকর্তা শেখ মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, 'নথি অনুযায়ী ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে এখানে জমিদারদের রাজস্ব অফিস কাজ শুরু করে। পরে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে পাকিস্তান সরকার জায়গাটি অধিগ্রহণ করে সরকারি রাজস্ব অফিস স্থাপন করে। সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও স্থানীয় ভূমি অফিস গড়ে ওঠে এই স্থানেই।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গঙ্গাসাগর দিঘির পাড়ে পাকিস্তানি বাহিনী ক্যাম্প তৈরি করে। এই ক্যাম্প থেকে আশপাশের এলাকায় তারা নির্যাতন, হত্যা চালাত। ২২ আগস্ট বিকেলে পার্শ্ববর্তী টানমান্দাইল ও জাঙ্গাল গ্রামে আক্রমণ চালিয়ে চারজন মুক্তিযোদ্ধাসহ ১৩০ জনকে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। দিঘির উত্তর পাড়ে তহশিল কাছারিতে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পের পাশে ছোট্ট একটি মসজিদে তাঁদের আটকে রেখে নির্যাতন চালানো হয়। মসজিদটি এত ছোট ছিল যে এর ভেতর এত মানুষের শ্বাস নেওয়ার মতো অবস্থাও ছিল না। মানুষের ওপর মানুষ, গাদাগাদি করে এক দিন এক রাত অনাহারে কাটাতে হয় তাঁদের। ২৩ আগস্ট রাতে মসজিদ থেকে বের করে নিয়ে তাঁদের গঙ্গাসাগর দিঘির পশ্চিম পাড়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হয়। স্থানীয় রাজাকারদের প্ররোচনায় চারজন মুক্তিযোদ্ধাসহ ৩৩ জন গ্রামবাসীকে রাতের অন্ধকারে গুলি করে হত্যা করা হয়। গুলির আওয়াজে সে রাতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে সারা এলাকা। এলাকাবাসীও ভয়ে বিমূঢ় হয়ে যায়। হত্যার পর সেখানে গর্ত খুঁড়ে মাটিচাপা দেওয়া হয় সবাইকে। এখানে যাঁরা হত্যার শিকার হয়েছেন তাঁরা হলেন টানমান্দাইল গ্রামের রামজুল হক মুন্সি, তারাচান্দ মোল্লা, খেলু মিয়া, বাবরু মিয়া, তারু মিয়া মুন্সি, মালু মিয়া মুন্সি, আবুল বাশার, ডা. আবু তাহের, তোতা মিয়া, আবুল হাশেম মোল্লা, গোলাম মাওলা মোল্লা, গোলাম কাদির মেম্বার, আব্দুল খালেক মোল্লা, হায়দার আলী, শামসু সরকার, মোজাউল হক সরকার, আবদুল মন্নাফ মিয়া, সোবহান মিয়া, রাজু মিয়া, আবুল ফায়েজ, রিয়াজ উদ্দিন, আবদুল হান্নান, আবদুল গনি, জজু মিয়া, জাঙ্গাল গ্রামের সাধন মিয়া, ওমর আলী, মুসলিম মিয়া, মালু মিয়া, ডেংগু মিয়া, সরল মিয়া, হেলাল মিয়া, গাংভাঙ্গা গ্রামের আবু মিয়া এবং গঙ্গাসাগর দিঘির পাড়ের ফজলুল হক। গঙ্গাসাগর দিঘির পশ্চিম পাড়ের এই হত্যাযজ্ঞের পর এলাকায় ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। নিহতদের লাশ তাঁদের আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে যেতে দেওয়া হয়নি।
শরাফত হোসেন

No comments

Powered by Blogger.