বৈদেশিক সম্পর্ক-সবার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলতে পারাই সফলতার শক্তি by আবুল হাসান চৌধুরী

জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে পরিচালিত এ ধরনের কূটনৈতিক উদ্যোগ আরও কয়েকটি বছর বঙ্গবন্ধু চালিয়ে যেতে পারলে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি দ্রুত উন্নত হতো। ফলে আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জিত হতো। বেড়ে যেত মর্যাদা। এখনকার তুলনায় তখন কূটনীতির জগৎ ছিল প্রকৃতই জটিল।
দুই শিবিরে বিভক্ত ছিল বিশ্ব। একের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে গিয়ে অপরের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টির শঙ্কা ছিল। তিনি তা সাফল্যের সঙ্গে মোকাবেলা করে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলায় সচেষ্ট হয়েছিলেন



বাংলাদেশের গৌরবের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পূর্ণ মহিমায় আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। আমাদের নেতৃত্বের তরফে এটা ছিল সফল কূটনৈতিক তৎপরতা। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সম্পর্কের ক্ষেত্রে 'কূটনীতি' শব্দটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। 'কূট' শব্দের অর্থ কপটতা, জটিল, কুটিল প্রভৃতি। বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে কূটনীতি শব্দের অর্থ দিয়েছে : কৌশল বা কুটিলতাপূর্ণ রাজনীতি সম্বন্ধীয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষায় বেশ কিছু সুন্দর নতুন শব্দ প্রয়োগ করেছেন। ভাষান্তরিত কিছু শব্দও আমাদের ভাণ্ডারে রেখে গেছেন। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার কাছ থেকে 'কূট-যুক্ত' শব্দের পরিবর্তে অন্য শব্দ হয়তো আমরা পেয়ে যেতাম। তবে এটা নিতান্তই আক্ষেপ। আমরা একাত্তরের গৌরবের সময়ে ফিরে যাই। সময়টি ছিল স্নায়ুযুদ্ধে উত্তপ্ত। একদিকে পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রবর্গ। তাদের পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব বলত কেউ, কেউবা বলত মুক্ত দুনিয়া। তাদের সামরিক জোট ন্যাটো। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব। সেখানে গণতন্ত্র নেই, এটা ছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্রদের অভিযোগ। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো ঔপনিবেশিক শাসনের কবল থেকে মুক্ত হতে চাওয়া জাতিগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছিল পূর্ণ আন্তরিকতায়। এই দুই শিবিরকে দেখা গেছে, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করতে। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র যে দেশ, অবধারিতভাবেই তারা থাকবে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু বিস্ময়করভাবে বাংলাদেশের সমর্থন মিলেছে শিবির নির্বিশেষে প্রায় সব দেশের কাছ থেকে। এ ক্ষেত্রে প্রধান নিয়ামক ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর দিকদর্শন। তিনি স্বাধীনতার জন্য বাঙালির যে মহত্তম স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা সেটা ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন অন্যদের মধ্যেও। এ কারণে পূর্ব ও পশ্চিম উভয় মেরু থেকেই নিন্দিত ও ধিক্কৃত হয়েছে পাকিস্তানি শাসকদের গণহত্যা অভিযান। আর সমর্থন ব্যক্ত হয়েছে আমাদের মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রতি। তিনি ছিলেন জনগণের নেতা, দরিদ্র মানুষের নিকটজন এবং গণতন্ত্রের একনিষ্ঠ সমর্থক। বিশ্ববাসী একাত্তরে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরুর আগেই তার এ পরিচয় পেয়েছিল।
আমাদের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করায় অবশ্যই ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল এগিয়ে। ভারতে বাংলাদেশ থেকে প্রায় এক কোটি নারী-পুরুষ-শিশু আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাও গিয়েছিলেন দলে দলে। ২৫ মার্চের পর ঢাকাসহ বাংলাদেশের সর্বত্র পাকিস্তানি সৈন্যরা যেভাবে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে তাতে এর বিকল্প ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল সে সময়ে ভারতের স্বাভাবিক মিত্র। তাছাড়া মুক্তিসংগ্রামের প্রতি সমর্থন জানানো ছিল তাদের বিঘোষিত নীতি। কিন্তু তাদের পাশাপাশি অন্যপক্ষের সমর্থন আদায় করতে পারা নিঃসন্দেহে ছিল সফল কূটনীতির পরিণতি।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ একাত্তরের এপ্রিল-মে মাসে জানত না যে বাংলাদেশ কতদিনে স্বাধীন হবে। কিন্তু প্রতিদিন লাখ লাখ লোক তাদের ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে এবং তাদের জন্য প্রস্তুত ছিল আতিথেয়তার উদার হাত। আমি অনেক শরণার্থীর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে কথা বলেছি। কেউ অভিযোগ করেনি যে তাদের অযত্ন বা অবহেলা-উপেক্ষা করা হচ্ছে।
একাত্তরে ব্রিটেনে ছিল এডওয়ার্ড হিথের নেতৃত্বে রক্ষণশীল দলীয় সরকার। ঔপনিবেশিক শাসন অবসানে সংগ্রামে লিপ্ত জাতিগুলো তাদের সমর্থন তেমন পেত না। তদুপরি এ দলের সরকার ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ মিত্র। অথচ একাত্তরের মে মাসেই ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের যেসব ছাত্রছাত্রী ব্রিটেনে পড়াশোনা করছে তাদের কেউ আর্থিক সমস্যায় পড়লে সহায়তা প্রদান করা হবে। এসব ছাত্রছাত্রীর বেশিরভাগ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সংগ্রামের প্রতি শুধু সমর্থন জানায়নি, সক্রিয়ভাবে তাতে শামিল হয়েছে। পাকিস্তান সরকার এ তথ্য তুলে ধরে তাদের বৃত্তি এমনকি ব্রিটেনে অবস্থানের অনুমতি বাতিলের চেষ্টা করেও সফল হয়নি। এ বিষয়টিকেও আমরা এক ধরনের স্বীকৃতি হিসেবে ধরে নিতে পারি। ব্রিটিশ সরকারও জানত না যে কতদিন এসব ছাত্রছাত্রীকে সহায়তা দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু নবজাত বাংলাদেশ তার যোগ্যতা বলেই আদায় করে নিয়েছিল। এ জন্য অবশ্য কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালনা করতে হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিও আমরা দৃষ্টি দিতে পারি। সে সময়ে ক্ষমতায় ছিল রিপাবলিকান পার্টি। প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। তারা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরোধিতা করেছেন শুরু থেকেই এবং ডিসেম্বরে বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর প্রেরণ করা হয় পাকিস্তানি সেনাদের সমর্থনে। কিন্তু এ সময়েই রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয় দলের অনেক সিনেটর এবং প্রতিনিধি পরিষদ সদস্যের সমর্থন বাংলাদেশ পেয়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের করপোরেট জগতেরও সমর্থন ছিল বাংলাদেশের প্রতি।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দফতরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ সরকার সফল কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালনা করতে পেরেছিল। এ সময়ও ছিল সেখানের সরকারি ও বিরোধী উভয় দলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতার সমর্থন। ডিসেম্বরে জাতিসংঘে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের সমর্থনে দুই দফা ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে। যুক্তরাষ্ট্র সপ্তম নৌবহর পাঠালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পাল্টা নৌবহর প্রেরণ করে বাংলাদেশের সমর্থনে। কিন্তু একইসঙ্গে এটাও সত্য যে, যুক্তরাষ্ট্রের করপোরেট মহল দুই পারমাণবিক শক্তি যেন আরেকটি বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ে, সে ব্যাপারে সতর্ক ছিল। তাদের এ ভূমিকাও বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে সহায়ক হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে প্রথম এলেন লন্ডন শহরে। তিনি যে দেশের নেতা তাকে ব্রিটিশ সরকার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা দু'জনেই তাকে সম্মান দেখান একটি স্বাধীন দেশের নেতা হিসেবে।
পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশও বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়। তারা ন্যাটো জোটের সদস্য ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নীতি ও কৌশল তাদের কাছে নিজস্ব স্বার্থের বিষয় হিসেবেই গণ্য হতো। কিন্তু বাংলাদেশ প্রশ্নে তারা ভিন্ন অবস্থান নেয়। তারা গণহত্যার নিন্দা জানায় এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি করে বিবৃতি প্রদান করে।
এখন ভাবলেও বিস্ময় লাগে, যখন বিশ্বের প্রায় সবকিছুই নির্ধারিত হতো ওয়াশিংটন ও মস্কোতে, তখন বাংলাদেশ এমন সার্বিক সমর্থন কী করে অর্জন করতে পারল। পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে উৎসাহী ছাত্রছাত্রীরা এ বিষয়টিকে সিরিয়াস গবেষণার বিষয় করতেই পারেন।
স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনের নীতি গ্রহণ করেন। এটা কেবল কথার কথা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে যেসব দেশের সরকার বিরোধিতা করেছিল তাদের জনগণের অবস্থানকে তিনি পৃথকভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। চীনের সঙ্গে সমঝোতার জন্য তিনি চেষ্টা চালান এবং এজন্য এমনকি ফ্রান্সের আদ্রেঁ মারলোকে উদ্যোগী হতে রাজি করান। আরব বিশ্বের সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য তিনি উদ্যোগ গ্রহণ করেন। আবার একই সময়ে তিনি নীতিগত অবস্থানে ছিলেন দৃঢ়সংকল্প। তিনি বলেছিলেন, সৌদি আরবসহ অন্য আরব দেশগুলো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল কি-না তাতে বাংলাদেশের কিছু যায় আসে না। কিন্তু ফিলিস্তিনি জনগণের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি আমাদের সমর্থন শর্তহীন। বাংলাদেশ তাদের পাশে আছে।
১৯৭৪ সালে ইসলামী সম্মেলন সংস্থার সম্মেলনেও তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল যোগ দিয়েছিল মাথা উঁচু করে। এর আগে তিনি পাকিস্তানের স্বীকৃতি আদায় করতে সফল কূটনীতি পরিচালনা করেন। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে পাঠানো হয় প্রতিনিধি দল। এদের একটি দলে ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।
জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে পরিচালিত এ ধরনের কূটনৈতিক উদ্যোগ আরও কয়েকটি বছর বঙ্গবন্ধু চালিয়ে যেতে পারলে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি দ্রুত উন্নত হতো। ফলে আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জিত হতো। বেড়ে যেত মর্যাদা। এখনকার তুলনায় তখন কূটনীতির জগৎ ছিল প্রকৃতই জটিল। দুই শিবিরে বিভক্ত ছিল বিশ্ব। একের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে গিয়ে অপরের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টির শঙ্কা ছিল। তিনি তা সাফল্যের সঙ্গে মোকাবেলা করে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলায় সচেষ্ট হয়েছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি গতিশীলতা হারিয়ে যায়। এ সময়ে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায় না। নিজেদের অবস্থান কোনো রকমে ধরে রাখাই মুখ্য হয়ে ওঠে। তবে ১৯৯০ সালে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন কুয়েত দখলের অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ গ্রহণ করলে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে মিত্রশক্তি গঠিত হয় এবং বাংলাদেশ তাতে শামিল হয়ে যায়। এটা ছিল দূরদর্শী সিদ্ধান্ত। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের বাণিজ্য সুবিধার ক্ষেত্রে।
কূটনৈতিক উদ্যোগ পরিচালনার ক্ষেত্রে আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় খেয়াল রাখা দরকার। উদাহরণ হিসেবে আমরা বলতে পারি যে, ১৯৭৭ এবং ১৯৯৬ সালের গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির কথা। দুটি চুক্তিতেই বাংলাদেশ প্রত্যাশামতো পানি না পেলেও প্রাপ্তি ছিল মোটামুটি সন্তোষজনক। কিন্তু প্রথম চুক্তির দুর্বলতা হচ্ছে এর মেয়াদ ছিল পাঁচ বছর। পরেরটি শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে সম্পাদন করেন এবং মেয়াদ ধরা হয় ৩০ বছর। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন সহজ হয়। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন বিষয়ে চুক্তি করার প্রক্রিয়ায় আমাদের এ অভিজ্ঞতা স্মরণ রাখতে হবে। ভারতের সঙ্গে যৌথ ইশতেহার স্বাক্ষরকেও আমরা বাংলাদেশের কূটনীতিকে একটি মাইলফলক বলতে পারি। এখন জরুরি কাজ হচ্ছে এর প্রতিটি ক্ষেত্রে পৃথক চুক্তি সম্পাদন এবং তা বাস্তবায়নে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ। এ ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে, ভারতের সিভিল সোসাইটি ও গণমাধ্যম বাংলাদেশের প্রতি আরও উদার মনোভাব গ্রহণ করার জন্য নয়াদিলি্ল কর্তৃপক্ষের প্রতি ক্রমাগত আহ্বান জানাচ্ছে। এটা আমাদের জন্য চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি করেছে এবং তা কাজে লাগাতেও চাই দক্ষ কূটনৈতিক উদ্যোগ।
চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি করতে পারাও চার দশকের বড় অর্জন। এ ক্ষেত্রেও আমি শেখ হাসিনার সরকারকে বিশেষ কৃতিত্ব দেব। বিএনপি আমলে তাইওয়ানের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করতে গিয়ে বাংলাদেশ বেইজিংয়ের কর্তৃপক্ষের বিরাগভাজন হয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পর প্রথম সফরে গিয়েছিলেন চীনে। এর রয়েছে সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য। বিশ্বের জনবহুল এ দেশটির সঙ্গে আমাদের বড় প্রতিবেশী ভারতের বৈরী সম্পর্ক রয়েছে এবং তা রাতারাতি দূর হবে না। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, তারা বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরস্পরের কাছাকাছি এসেছে। চীন চট্টগ্রামে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করে দিতে পারে, এমন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। আমার মনে হয় ভারতও এতে আপত্তি করবে না। কারণ, ভারত এখনই এ ধরনের বৃহৎ বিনিয়োগে আর্থিক ও কারিগরিভাবে প্রস্তুত নয়। কিন্তু বন্দরটি আধুনিক হলে তাদেরও অর্থনৈতিক সুবিধা হবে। মিয়ানমারে চীন ও ভারত সমানতালে বিনিয়োগ বাড়িয়ে চলেছে। বাংলাদেশ এ অভিজ্ঞতা থেকেও পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে শিক্ষা নিতে পারে।
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক চার দশকে থেমে থেমে এগিয়েছে। বর্তমানে সেখানে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে এবং আশু অবসান ঘটবে বলেও মনে হয় না। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে সেখানের প্রকৃত কর্তৃপক্ষ কে সেটা বোঝা কঠিন। পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী এ দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা কর্মকর্তারা ঘন ঘন সফরে আসছেন এবং তাদের বেশিরভাগ সেনাবাহিনী প্রধানের সঙ্গে বৈঠক শেষ করেই স্বদেশে ফিরে যান।
উগ্রধর্মান্ধতা বিশ্বের নিরাপত্তার জন্য যে সমস্যা সৃষ্টি করেছে তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ যথেষ্ট। ১৮ কোটি মানুষের দেশ পাকিস্তান কোন পথে চলছে, সেটা তাদেরও বোধকরি ভালোভাবে জানা নেই। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রায় ১৬ কোটি লোকের দেশ বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা বিরাজ করুক, সেটা তারা আন্তরিকভাবে চাইছে। এখানে নারীর ক্ষমতায়নকে তারা মৌলবাদী ধ্যান-ধারণা মোকাবেলায় কার্যকর মনে করে। গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে ওয়াশিংটন কর্তৃপক্ষের অতিমাত্রায় সংবেদনশীলতার এটা অন্যতম কারণ বৈকি। তারা মনে করছে, ধর্মান্ধ শক্তিকে ধীরস্থিরভাবে মোকাবেলার একটি কার্যকর কৌশল হচ্ছে দরিদ্র নারীদের ক্ষমতায়ন। গ্রামীণ ব্যাংক এ কাজে অসাধারণ ভূমিকা রাখছে।
বর্তমানে পাশ্চাত্যের কেন্দ্র এক নয়, কিন্তু তারা পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুবিধা আদায়ে তা কাজে লাগানো দরকার। তারা একটি স্থিতিশীল ও উন্নত বাংলাদেশ দেখতে চায়। এ লক্ষ্য অর্জনে আমাদের তৎপর হতে হবে। এ জন্য একটি শর্ত হচ্ছে জাতীয় স্বার্থের ইস্যুতে; দলীয় সংকীর্ণতার ঊধর্ে্ব ওঠা। বিশ্বের কাছে আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি বার্তা দিয়েছিলাম এবং তা সুফল দিয়েছে। এখনও আমরা উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে যেন একটিই বার্তা দিতে পারি।
কূটনীতিতে সাফল্যের আরেকটি শর্তর্ হচ্ছে পররাষ্ট্র দফতরের দক্ষতা ক্রমাগত বাড়িয়ে চলা। এ দফতরে রাজনৈতিক প্রভাব থাকবেই। কিন্তু মনে রাখা চাই যে, পেশাদারিত্বের কোনো বিকল্প নেই। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্তরা যদি বেশি গুরুত্ব পেতে থাকেন তাহলে পেশাদার কূটনীতিকরা হতাশ হবেন, তাতে সন্দেহ নেই। কূটনৈতিক অঙ্গনে আমাদের বড় বড় লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। রাজনীতির পাশাপাশি অর্থনীতির জন্যও রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সম্পর্কের এই নীতি কাজে লাগাতে হবে। এজন্য পেশাদারিত্বের বিকল্প আদৌ নেই। বিশ্ব সম্প্রদায় এটাও দেখতে চায় যে, দেশটি কেমন চলছে। আমাদের জন্য আর্থিক সহায়তা ও অন্যান্য সমর্থন বাড়ানোর জন্য সুশাসন বজায় রাখাও কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।

আবুল হাসান চৌধুরী : সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী
ahc51@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.