স্বাগত ২০১১-দুঃখী মানুষের প্রত্যাশার সূর্য উঠুক by সেলিনা হোসেন

খ্রিস্টীয় নববর্ষের শুরুর দিন আজ। বাঙালির জীবনেও এই দিন বছরের শুভ সূচনার দিন। বাংলা নববর্ষের মতো আনন্দ-উচ্ছ্বাসের জায়গা তৈরি করে না খ্রিস্টীয় নববর্ষ। রমনার বটমূলে এ নববর্ষকে আহ্বান জানাতে আয়োজন করা হয় না অনুষ্ঠানের। কারণ এর সঙ্গে জাতিসত্তার সাংস্কৃতিক বোধের যোগ নেই।
কিন্তু যোগ আছে আন্তর্জাতিক বিশ্বের সঙ্গে। বিশ্বের মানবিক বোধের সঙ্গে। তাই শুভেচ্ছাবার্তা উড়ে যায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সীমান্ত অতিক্রম করে। যা কিছু শুভ, তাকে সত্যি বলে মেনে নেয় বিশ্বের মানুষ।
মানবকল্যাণবোধ এর মধ্যে অন্যতম দিক। বাংলাদেশও মানবিক বোধের চেতনা থেকে স্বাগত জানায় নতুন বছরকে। স্বাগত ২০১১।
নতুন বছরের প্রথম দিন যে সূর্য উঠবে, সেই সূর্যটি নতুন নয়। হাজার বছরের বেশি সময় ধরে পৃথিবীতে আলো বিকিরণ করে যাচ্ছে এটি। কিন্তু নতুন বছরে নতুন হয়ে জেগে ওঠে মানুষের প্রত্যাশা। এ প্রত্যাশা সূর্যের মতো আলো বিকিরণ করে ব্যক্তির জীবনে, জাতির জীবনে। প্রত্যাশাই নতুন বছরের সূর্য। দেশের প্রতিটি মানুষ চায় প্রত্যাশার সূর্য জ্বলে উঠুক জাতির জীবনে�জ্বলে উঠুক মানুষের ভালোভাবে বেঁচে থাকার মৌলিক আকাক্সক্ষায়।
দেশীয় প্রেক্ষাপটে দেশের মানুষ বিগত বছরে জাতীয় জীবনে পাওয়া-না পাওয়ার খতিয়ান করে। যে প্রত্যাশা বিগত বছরে পূর্ণ হয়নি, সেটি পূর্ণ হওয়ার আকাক্সক্ষা থাকে মানুষের মনে। এ প্রত্যাশার সূর্য বিকিরণ করে আলো। এ আলো চোখ ধাঁধিয়ে দৃষ্টি আড়াল করে দেবে না, এ আলো পথ দেখাবে। যিনি সরকারে দায়িত্ব পালন করবেন, তাঁকে এ আলো দেখতে হবে। যিনি বড় জায়গার কর্ণধার হবেন, তাঁকে দেখতে হবে। যিনি জ্ঞানের আলো ছড়ান, তাঁকেও দেখতে হবে। যিনি দেখবেন না, তিনি অন্ধ। এ অন্ধত্ব শুভ ও কল্যাণের বিপরীত চেতনা।
গণমানুষের প্রত্যাশার জায়গা থেকে প্রবল আকাক্সক্ষা যে, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রিত হোক। জনজীবনে স্বস্তি ফিরে আসুক। মানুষের ভাতের থালায় পুষ্টিকর খাবার থাকুক। স্বাধীনতার ৪০ বছর পরে শুধু ডাল-ভাতের জীবন আর কেউ চায় না। বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনীতি শুরু করেছিলেন গণমানুষের কষ্টের জীবনযাপন বুকের মধ্যে নিয়ে। তিনি তাঁর জীবনের প্রায় সব বক্তৃতায় �দুঃখী মানুষ� শব্দ দুটি অনবরত উচ্চারণ করেছেন। এমনকি তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ থেকেও �দুঃখী মানুষ� শব্দ দুটি বাদ পড়েনি। প্রত্যাশিত বছর ২০১১ এসব মানুষের জীবনে আলো ফেলবে�এই প্রত্যাশা। আলো ফেলতে হবে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছ থেকে, এককভাবে সরকারের কাছ থেকে নয়। সে জন্য প্রয়োজন দুর্নীতিমুক্ত সমাজ।
গত বছরের শুরুর মাসটিতে বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনির রায় কার্যকর করা হয়েছে। তারিখটি ছিল ২৮ জানুয়ারি। গত বছরে শুরু হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া। প্রত্যাশার সূর্যের আলো ছুটে যায় এ বিচারের রায়ের দিকে। নতুন বছরে জাতি যেন পায় বিচারের রায় এবং রায় কার্যকর করার বাস্তবতা।
গত বছর জাতীয় শিক্ষানীতি জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে। স্বাধীনতার ৪০ বছরে বেশ কয়েকটি শিক্ষা কমিশন ও কমিটি গঠিত হলেও কার্যকর হয়নি কোনোটিই। এ বছর এমন একটি পূর্ণাঙ্গ জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন হবে�এ প্রত্যাশা সবার। মাদ্রাসা শিক্ষার কারিকুলামে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে, তা আলোকিত করবে মাদ্রাসায় পড়া শিক্ষার্থীদের। দ্রুত বাস্তবায়নে শিক্ষার পরিবর্তন আনলে আলোকিত হবে প্রজ��। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড�এটি একটি বহুল প্রচলিত বাক্য। নতুন শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন হলে তা সরকারের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হবে। এমন কোনো শিক্ষক তৈরি হবেন না, যাঁরা শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে প্রাপ্য বই নিয়ে মিথ্যার আশ্রয় নেন। আর এমন লজ্জাজনক আচরণকারী শিক্ষক দেখতে চায় না কেউ। এমন কোনো শিক্ষার্থী তৈরি হবে না, যারা রামদা হাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলা করবে।
এ বছর একটি কার্যকর জাতীয় সংসদ দেখতে চায় জাতি। জাতীয় সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধি হয়ে সংসদ বর্জন করা কোনো মর্যাদার কাজ নয়। এভাবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখা যায় না। ২০১১ সাল জাতীয় সংসদ কার্যকর করার বছর হোক। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জায়গাটিতে গণমানুষের প্রত্যাশার সূর্যের আলো পড়�ক।
প্রত্যাশা পূরণ হতে হবে বিদ্যুতের ক্ষেত্রে, গ্যাসের ক্ষেত্রে। প্রতিদিনের জীবনযাপনের ক্ষেত্র সেবা পাওয়া ছাড়া বাধাগ্রস্ত হয়। প্রত্যাশা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন। শান্তিপূর্ণ, সুস্থ-স্বাভাবিক পরিস্থিতি ছাড়া মানুষের দিন কাটানো কষ্টকর। নতুন বছরের সূর্য আলো ফেলুক আগামী দিনগুলোর ওপর। শুভবোধের আলো�মঙ্গল ও কল্যাণের আলো।
আগামী দিনের প্রত্যাশা এমন যেকোনো নতুন বছরের সূচনায় কাউকে যেন লিখতে না হয় বছরের নেতিবাচক ঘটনার দিক। কবে সে বছরটি আসবে, যার সবটুকু উজ্জ্বল হয়ে থাকবে ইতিবাচক ভাবমূর্তিতে। কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে থাকবে জাতির প্রত্যাশা।
লেখক : কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.