আমলীগোলা মসজিদ হৈমনত্মী by শাহনাজ চৌধুরী

আমলীগোলা সরম্ন গলির ভেতর এক গম্বুজ মসজিদ। স্থাপিত হয়েছিল ১৬৭৬ খ্রিস্টাব্দে। মসজিদের শিলালিপি এখনও বর্তমান। কিন্তু যেখানে থাকার কথা সেখানে নেই। কারণ পুরনো ঐতিহ্য স্থাপনাটিকে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে আজ থেকে ৩০ বছর আগে ১৯৭৮ সালে।
দেখা গেল, শিলালিপিটি পড়ে আছে অবহেলায় সিঁড়ির চাতালে। স্থানীয় প্রবীণদের মতে, এলাকায় লোকসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় মসজিদে লোক ধরত না। তাই আধা কাঠারও কম জমিতে নির্মিত মসজিদটিকে বাড়িয়ে দেড় কাঠায় সম্প্রসারিত করা হয়েছে। কারণ ঠাঁই হচ্ছিল না পরহেজগার নামাজিদের। ফলে ভাঙতে হলো আরও একবার। এ ঘটনাটি ঘটেছে মাত্র ৫ বছর আগে। লালবাগ কেলস্নার কাছাকাছি জগন্নাথ সাহা রোডের অনেক অলিগলি পেরিয়েই এ মসজিদ। মোঘল আমলে এলাকাটি ছিল অনেক গুরম্নত্বপূর্ণ। কিংবদনত্মি ঢাকা বই হতে জানা যায় আমীর ওমরাহ এবং অভিজাতদের বসতি ছিল এখানে। ঢাকা হতে রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানানত্মরিত হওয়ায় মহলস্নাটি তার ঐতিহ্য হারাতে বসে। অভিজাতরা পাড়ি জমায় নতুন রাজধানীতে। মহলস্নাটি হয়ে পড়ে নিষ্প্রভ। কোম্পানি আমলে এসে বসতি গড়ে হিন্দু ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। মোঘল আমলে মহলস্নাটির নাম ছিল গোলা আমীরগঞ্জ। পুষ্পরাজ সাহা নামক এক ব্যবসায়ী মহলস্নায় কিছু উন্নয়নমূলক জনহিতকর কাজ করেন। তার পিতার নামানুসারেই গোলা আমীরগঞ্জ জগন্নাথ সাহা রোড নামে পরিচিত হতে থাকে। কিছু সুচতুর হিন্দু ব্যবসায়ী গোলা আমীরগঞ্জকে আমলীগোলা নাম দেন। এলাকায় একটি পুরনো তেঁতুল গাছ ছিল (উদর্ুতে ইমলী বা আমলী অর্থ হচ্ছে তেঁতুল)। এ গাছটিকেই তারা যুক্তি হিসেবে দাঁড় করান। এই হিন্দু সম্প্রদায়ের আধিপত্যে সংখ্যালঘু মুসলমানরা এর প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি। তবে কাগজেকলমে এখনও গোলা আমীরগঞ্জ জগন্নাথ সাহা রোড নামে সমধিক পরিচিত। অভিজাত এলাকাটি কালের প্রবাহে পরিণত হয় বসত্মিতে। গড়ে উঠেছে সেখানে ঘনবসতি।
সরেজমিনে অনুসন্ধানে জানা গেল যে, আধা কাঠারও কম জমির ওপর নির্মিত হয়েছিল মোঘল আমলের আমলীগোলার ছোট মসজিদ। বর্তমান মসজিদের জমির আয়তন দেড় কাঠা। তার ওপরই পুনর্নির্মিত হচ্ছে পাঁচতলা বিশিষ্ট মসজিদটি। এখনও অর্ধনির্মিত অবস্থায় আছে। দোতলা পর্যনত্ম হয়েছে। জানা যায়, ওয়াদ আলী সর্দার নামে এক ব্যক্তি অনেক দিন পর্যনত্ম এ মসজিদের মোতাওয়ালিস্ন হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাই আমলীগোলার এ ছোট মসজিদটি কিছুকাল ওয়াদ আলী সর্দারের মসজিদ নামেই পরিচিত ছিল।
বর্তমান মসজিদে দেখা গেল চারদিকে চারটি ছোট ছোট টারেট এবং সুদৃশ্য মনোরম একটি মিনার। দেিণ রয়েছে অজুখানা। পুনর্নির্মাণের সময় নির্মিত হয়েছে। অজুখানা নির্মাণের আগে এখানে একটি কবর ছিল। সম্ভবত কোম্পানি আমলে মসজিদের এক ইমাম সাহেবকে দাফন করা হয়েছিল এখানে।
একতলার বিশাল হল রম্নমটিতে থাই গস্নাস বসিয়ে বিভাজন করা হয়েছে। দেয়ালে বসানো হয়েছে টাইলস। ভেন্টিলেটারের মতো বড় পাঁচটি কাচের জানালা রয়েছে। ২৫ বছর ধরে কর্মরত মসজিদের প্রথম মোয়াজ্জেন কারি আব্দুল আলী। তার কাছ থেকে জানা গেল প্রতিদিন ১০০-১৫০ জন লোক আসে নামাজের জন্য। শুধু শুক্রবারের জুমার নামাজে জমায়েত হয় ৫০০-৬০০ জন লোক। তখন ব্যবহৃত হয় দোতলার হল ঘরটিরও। মসজিদে কোন মেহরাব নেই। তবে ইমাম সাহেবের বসার আলাদা জায়গাটা তৈরি করা হয়েছে কিছুটা ভিন্ন আকারে। মোগল আমলে নির্মিত মসজিদটির অবস্থা কিন্তু এমনটি ছিল না। মসজিদের সেক্রেটারি হাজী মোহম্মদ মাইজউদ্দীন জানালেন দুই কাতারে কেবল ৫/৬ জন মানুষ নামাজ পড়তে পারতেন। এখনকার স্থাপনাটিতে দেখা গেল উত্তর ও দণি দিকের বাউন্ডারি দেয়াল দুটো মসজিদের দেয়াল হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে। ৩০ বছর আগে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাটি ছিল ভিন্ন। অল্প পরিসরে নির্মিত হলেও উত্তর দণি ও পশ্চিম দিকে কিছু জায়গা রেখে নির্মিত হয়েছিল। ৩০ বছর আগের নির্মিত মসজিদটি ভাঙার সময় উত্তর দিকের দেয়ালের কিছুটা ভেঙে ফেলা হয়েছিল। বাকি দেয়ালটা একই রকম আছে।
এ মহলস্নায় তিন পুরম্নষ ধরে বসবাস করছেন সেক্রেটারি সাহেব। ব্রিটিশ আমলেই তার জন্ম, ব্রিটিশ আমল, পাকিসত্মান এবং বাংলাদেশ_ এ তিন আমলেই অনেক পরিবর্তন দেখেছেন মহলস্নার। তিনি জানালেন ব্যক্তিমালিকানায় নির্মিত হয়েছিল আমলীগোলার ছোট মসজিদ। শোনা যায়, খনকার (খন্দকার) বংশীয় এক পরিবারের বাস ছিল। এ পরিবারের দুই ভাইয়ের তত্ত্বাবধানেই নির্মিত হয়েছিল। তার তথ্যানুযায়ী আমলীগোলার ছোট মসজিদ নির্মিত হয়েছিল আমলীগোলার বড় মসজিদেরও আগে। এক গম্বুজ বিশিষ্ট ছোট মসজিদের একটি মিনার ছিল। মিনারটি ছিল সরকারী খাস জমির ওপর। বাইরে সিঁড়ির ছাদের ওপর নির্মাণ করা হয়েছিল। বর্তমানে মসজিদের সামনে যে রাসত্মা রয়েছে সে সময় তা ছিল একেবারেই অন্যরকম। মসজিদের সামনে ছিল বিশাল এক কাঁচা নর্দমা। হাঁটা কাঁচা রাসত্মা। কোন যানবাহন চলাচল করতে পারত না। ১৯৬৫ সাল আইয়ুব খানের আমলে রাসত্মা তৈরি হলো। তবে স্বাধীনতার পর বাইপাস রাসত্মা নির্মাণ করা হয়। যেহেতু মিনারটি ছিল খাস জমির ওপর। তাই ভাঙা পড়ল মিনারটি। তার কাছ থেকেই জানা গেল আগে কোন মোয়াজ্জেম ছিলেন না। আজান দিতেন ইমাম সাহেব, তিনি নিজে আবার কখনও এলাকার লোকজনও বটে।
উত্তর ও দণি দিকে দুটো কাঁচের জানালা ছিল। জানালা দুটো দেয়ালের সাথে লোহার আংটা লাগিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। তাতে কাঠের ব্যবহার হয়নি। পূর্ব দিকে দুটো ছোট দরজা ছিল। অজুর পানি ব্যবহারের জন্য দণি দিকে ছিল একটিক কূপ। ৩০ বছর আগে পুনর্নির্মাণের সময় কূপটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। প্রাচীন মসজিদটিতে একটি ছোট মেহরাব ছিল। তার ওপর বসানো ছিল কালো পাথরের মোমদানী। মাঝখানে লাগানো ছিল একটি মনোরম ঝাড়বাতি।
নির্মাণের উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল চুন সুড়কি। ব্যবহৃত হয়েছিল ছোট ছোট ইট। দেয়ারগুলো বেশ মোটা। ১৮-২০ ইঞ্চি চওড়া। আস্তরই ছিল দুই ফুটের মতো। কারম্নকার্যম-িত ছিল দেয়ালগুলো।
প্রাচীন মসজিদের শিলালিপি আছে কিনা জানতে চাইলাম মোয়াজ্জেম সাহেবের কাছে। তিনি তিন তলায় চলে গেলেন। তিন তলার সিঁড়ির মাঝখানে চাতালের ওপর ড্রাম, কাঠসহ বেশ কিছু জিনিস রাখা ছিল। তিনি ড্রামের পিছন থেকে বের করে আনলেন শিলালিপিটি।
ঐতিহ্যপূর্ণ শিলালিপিটি বর্তমান মসজিদেও কি ভবিষ্যতে দেখা যাবে? জানতে চাইলে সেক্রেটারি সাহেবের উত্তর পাওয়া গেল না-সূচক।
অতীতের ঐতিহ্যপূর্ণ নিদর্শনটিও হারিয়ে যাবে একদিন। যা পড়ে আছে আজ অবহেলায়। মসজিদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রয়েছে কমিটি। এর সদস্য সংখ্যা দশ। গঠন করা হয়েছিল ১৯৬৫ সালেই। মোঘল আমলের নির্মিত আমলীগোলার এ ছোট মসজিদটির ঐতিহাসিক গুরম্নত্ব সবারই অজানা। পড়ে আছে আজও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের দৃষ্টির অনত্মরালে। কখনও মেলেনি সরকারী পৃষ্ঠপোষকতাও। এলাকাবাসীর চাঁদার ভিত্তিতেই সম্পাদিত হয় এর যাবতীয় কার্যাবলী। সেক্রেটারি সাহেব জানালেন, আনোয়ার সিল্ক মিলের মালিকও এ মহলস্নার বাসিন্দা। তার মতো মহলস্নার কিছু প্রভাবশালী লোকের অনুদানেই নির্মিত হচ্ছে আমলীগোলার ৫ তলাবিশিষ্ট ছোট মসজিদটি।

No comments

Powered by Blogger.