সরকার ও বিরোধী জোটের সাফল্য এবং ব্যর্থতা by রাহাত খান

সরকারের চার বছর পূর্ণ হয়েছে। হাতে আছে মাত্র একটি বছর। এই শেষ বছরটি মহাজোট সরকারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বললেও বোধকরি কম বলা হয়।
দেশের মানুষ স্বভাবতই যতটা সম্ভব চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখতে চাইবে নির্বাচনে দেয়া প্রতিশ্রুতি বর্তমান সরকার কতটা পরিপূরণ করতে পেরেছে।
কতটা পারেনি। দেশের মানুষ গত চার বছরে বিরোধী দল নিজেদের উদ্দিষ্ট ভূমিকা কতটা পালন করতে পেরেছে, কতটা পারেনি এই বিচারও করবে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। গত চার বছরে সরকার ও বিরোধী দলের সাফল্য ও ব্যর্থতা যাচাই করার পাশাপাশি জনগণ এও বোধকরি ভেবেচিন্তে দেখবে আগামী নির্বাচনে কোন দল ও জোটকে ভোট দিলে দেশের উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি বাড়বে। বিএনপি-জামায়াত একই জোটের অন্তর্ভুক্ত বিধায় আগামী টার্মে ক্ষমতায় গেলে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করবে কিনা, ২০০১-২০০৬ সময় পর্বের মতো দেশ জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হবে কিনা, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আগের মতোই বিলুপ্ত করার চেষ্টা চলবে কিনা, এসব বিবেচনাও সচেতন মানুষদের মধ্যে কাজ করবে বলে অনেকে মনে করবে।
সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা পদ্মা সেতু এখনও নির্মাণ করতে না পারা। চলতি বছর সেতুর নির্মাণ কাজ কিছুদূর এগোবে হয়ত সেই আভাস সরকারের নানা মহল থেকেই পাওয়া যাচ্ছে। তবে পদ্মা সেতু যে গাড্ডায় পড়েছে তাতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাধারণ মানুষ তো বটেই, বহু সরকারপন্থী সমর্থকও এই ইস্যুতে হতাশ। পদ্মা সেতুর অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের উৎসাহ ও অর্থায়ন শুধু প্রয়োজনীয় নয়, জরুরী। অথচ বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে অবিশ্বাস ও জটিলতা বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি অবদান সরকারেরই সদা হাস্যময় এক ব্যবসায়ী মন্ত্রী এবং সবসময় ঠোঁটে ক্ষীণ হাসি বিরাজ করা এক আমলার। সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের না-হক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া [বিশ্বব্যাংকের প্রতি] এবং অর্থহীন প্রগলভতাও এ ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও দায়ী। এ কথা সবারই কমবেশি জানা যে, বিশ্বব্যাংক হচ্ছে বিশ্বের সেরা শক্তিধর দেশটির বাণিজ্য ও রাজনৈতিক একটি সংস্থা। একটি এজেন্সি। সেই শক্তিধর দেশটি বাংলাদেশের কাছে কি চাইছে তা বিবেচনা করে দেখতে হবে বৈকি। তবে এও অবশ্য সমান সত্য যে, বাংলাদেশে নিকট প্রতিবেশী এবং প্রায়-নিকট প্রতিবেশীর চাপও এই ইস্যুতে একেবারে উড়িয়ে দেয়ার মতো তুচ্ছ নয়। বলা চলে একটা বিশেষ কূটনৈতিক ইস্যুতে বংলাদেশের ‘শ্যাম রাখি না, কুল রাখি’ অবস্থা দাঁড়িয়েছে। তবে সে যাই হোক সাধারণ মানুষ দেখবে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মহাজোট সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণে কতটা সাফল্য ও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ব্যর্থতার ভাগটাই বেশি তাতে কোন সন্দেহ নেই।
মহাজোট সরকারের আরেক ব্যর্থতা নানা স্তরে বিরাজমান দুর্নীতি এবং অর্থনৈতিক অ-ব্যবস্থাপনা। সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ডেসটিনির কয়েক হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি, শেয়ারবাজারে হঠাৎ দরপতন এবং রাতারাতি অন্তত দুই লাখ লোকের বিশাল আর্থিক লোকশানের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ-বিএনপির কিছু মুখচেনা ব্যবসায়ীর হাজার কোটি টাকা লুট করে নেয়া এসবই সরকারের আর্থিক অ-ব্যবস্থাপনার চিত্রই তুলে ধরে। সরকার ব্যাংক অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিপক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়েছে; তবে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির বিপক্ষে আশানুরূপ আইনী ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
মহাজোট সরকারের গত চার বছরে সাফল্যের পাল্লাই ভারি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা যেন সাফল্যের ঔজ্জ্বল্যকে ম্লান করে দেয়। মহাজোট সরকার মিডিয়া ও প্রেস-উইংয়ে নিয়োজিত মন্ত্রী-উপদেষ্টা এবং কর্মকর্তাবৃন্দ এমনি ‘দক্ষ’ ও ‘করিৎকর্ম’ যে নিছক কিছু প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেয়ার কারণে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার একটা বড় অংশ চলে গেছে সরকারের বিপক্ষে। গত চার বছরে মহাজোট সরকারের সাফল্য তুলে ধরা দূরে থাক এবং সরকারের সামান্য সব ব্যর্থতাকে বড় করে দেখিয়েছে এবং জনগণের কাছে সরকারের ভাবমূর্তির বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে। একটা বড় অংশের মিডিয়া এখনও সরকারের নেতিবাচক প্রচারণায় নিয়োজিত কিন্তু আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকার এসব নিয়ে যেন পরোয়াই করে না। অযোগ্য ও তোষামোদকারী কিছু লোক মিডিয়ার ক্ষেত্রে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতেই যেন বেশি উৎসাহী। এরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ডুবিয়েছে। মহাজোট সরকারের অতসব সাফল্য সত্ত্বেও সরকারকে রক্ষণাত্মক ভূমিকার গাড্ডায় ফেলে দিয়েছেন। একটা সফল সরকারকে মিডিয়ার প্রায় অহেতুক নেতিবাচক প্রচারণা দ্বারা ব্যর্থ সরকার হিসেবে পরিণত করতে যেন বদ্ধপরিকর মিডিয়া বিষয়ক এসব ব্যক্তিবর্গ। নতুন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু অবশ্য মন্ত্রী হিসেবে যথেষ্ট যোগ্যতা ও দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন।
গত চার বছরে এবং এখনও বিশ্বে বিরাজ করছে অর্থনৈতিক মহামন্দা। এই মহামন্দায় এক জার্মানি ছাড়া গোটা পশ্চিম ইউরোপ প্রায় ধসে পড়ার দশায় এসে উপনীত হয়েছে। বিশ্বের এমন কোন দেশ নেই যেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম গত চার বছরে দু’গুণ তিনগুণ বৃদ্ধি পায়নি। বাংলাদেশেও চাল ছাড়া অন্যান্য দ্রব্য-সামগ্রীর মূল্য ওঠা-নামার মধ্যে আছে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, মহাজোট সরকারের আমলে বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। এটা বিরাট এক সাফল্য বৈকি।
বিশ্ব মহামন্দার দুঃসময়েও বাংলাদেশের বার্ষিক উন্নয়ন প্রবৃদ্ধি শতকরা ৬.২ ভাগ। ভারত, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি উপমহাদেশীর দেশের তুলনায়, শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, উন্নয়নের এই প্রবৃদ্ধি পশ্চিমা ও অন্যান্য উন্নত দেশে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। শিক্ষা ও তথ্যপ্রযুক্তি বিচারে বাংলাদেশের সাফল্য অভূতপূর্ব। জঙ্গী ও সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশের মহাজোট সরকার ৯৮ ভাগ সফল। খাদ্যোৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সমর্থ হয়েছে মহাজোট সরকার। রফতানি আয় ও ভল্যুম গত চার বছরে প্রায় দ্বিগুণ পর্যায়ে উন্নত। দেশে নানা দ্রব্য-পণ্যের উৎপাদন বাড়িয়ে কমানো সম্ভব হয়েছে আমদানি ব্যয়। বিএনপি এবং বিএনপি-জামায়াত জোটের দুই শাসনামলে এক কিলো বিদ্যুত উৎপাদন করা হয়নি। ক্ষমতাসীন হয়েই বিদ্যুত সঙ্কটের নিরসনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে গত চার বছরে বিদ্যুতর উৎপাদন হয়েছে প্রায় চার হাজার মেগাওয়াট। বিদ্যুতের দরুন জনভোগান্তি এখন অনেকটাই কম। শিল্প-কলকারখানাগুলোতে বিদ্যুতের সরবরাহ আগের তুলনায় অনেক ভাল। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো হয়েছে। দেশের জনশক্তি রফতানির গ্রাফও উর্ধমুখী। এ পর্যন্ত ৬ লাখ লোককে বিদেশে পাঠানো সম্ভব হয়েছে। আগামী পাঁচ বছরে শুধু মালয়েশিয়ায়ই বাংলাদেশ থেকে যাবে পাঁচ লাখ লোক।
সারা বিশ্বই মহাজোট সরকারের আমলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অভূতপূর্ব, ক্ষেত্র-বিশেষে বৈপ্লবিক সাফল্য অর্জনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। বলেছে বর্তমান ধারা বজায় থাকলে ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ চীন, ভারত, ব্রাজিল ও তুরস্কের পরই সবচেয়ে উন্নতি করা দেশের তালিকায় স্থান করে নেবে।
কিন্তু মহাজোট সরকারের এতসব বিশাল অর্জনও আমাদের একশ্রেণীর মিডিয়াকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। সন্তুষ্ট করতে পারেনি এক শ্রেণীর অর্থনৈতিক প-িত এবং আঁতেলদের। স্বাধীনতা-বিরোধীদের অপ-প্রচারণার মধ্যে তারা সাবস্টেন্স খুঁজে পায়। বানোয়াট এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সমীক্ষা ও জরিপে তারা দেশবাসীকে বোঝাবার প্রয়াস পাচ্ছে যে, বর্তমান সরকার ‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে’ সফল হলেও বহুক্ষেত্রে তারা ব্যর্থ। বিরোধী দলের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা নাকি গত কয়েক বছরে বাড়তে বাড়তে স্বাধীনতা-পক্ষের মহাজোট সরকারের জনপ্রিয়তাকে ছাড়িয়ে গেছে।
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো স্বাধীনতাবিরোধী পক্ষের। তাদের পরোক্ষ সমর্থনের পেছনে কি কারণ, কি রহস্য তা আমরা ভেবে পাই না। আমরা এতটুকু নিশ্চিত মহাজোট সরকারের আমলে গ্রামবাংলার বেশিরভাগ লোকেরই আয়-রোজগার বেড়েছে। তারা খুশি। আমরা এটাও জানি, বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ যাদের অহঙ্কার, সেই তরুণ সমাজ বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী দল বা জোটকে সমর্থন দেবে না কোন অবস্থায়ই। মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের প্রায় দুই কোটি লোকই কি স্বাধীনতাবিরোধীদের সমর্থন করবেন কোনদিন। আর দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়?
২০১৪ সালে সাধারণ নির্বাচন। নির্বাচনের রায় স্বাধীনতা পক্ষের শক্তির পক্ষেই হবে।

No comments

Powered by Blogger.