সাহেবপাড়ার সাহেবরাএখন এ দেশেরভোটার, খাঁটি বাঙালী- নড়াইলে নীলকরদেও অধসত্মন বংশধররা কেমন আছেন by সাজেদ রহমান

 রিফাত বিন ত্বহা, যশোর ও নড়াইল থেকে নরম্যান ডিবারৃজ। নীল চোখ। প্রথম দেখাতেই মনে হবে বিদেশী সাহেব। মাঠে যখন তিনি কাজ করেন তখন মনে হয় একজন বিদেশী মাঠে কাজ করছেন। গ্রামের মানুষ ডিবারজকে চেনেন।
কিন্তু বাইরের মানুষ তো তাঁকে চেনে না। হ্যাঁ, নীল চোখ উঁচু লম্বা সাহেবীগোছের দেখতে নরম্যান ডিবারজ আদপেই এক ইংরেজের বংশধর। তাঁর পূর্বপুরম্নষ নড়াইলে নীলচাষ করতে এসে বাংলার গ্রামকে ভালবেসে থেকে যান নড়াইলে। তাঁর বংশধররা এখন মাঠে কাজ করেন। মজুরি দেন অন্যের েেত। ইংরেজ শাসনামলে নড়াইলে নীলচাষ শুরম্ন হয়। ১৮৪০ সালে নড়াইলের লোহাগড়ায় নীলকর সিএমসি মুনয়ার ইতনায় প্রথম নীলকুঠি তৈরি করেন। বর্তমানে কুঠিটি মধুমতির ভাঙ্গনে শেষ হয়ে গেছে। ওই সময়ে নড়াইল সদরের নবগঙ্গার তীরে কুমারগঞ্জে নীলকুঠি ছিল। বর্তমানে ওই গ্রামের কোন অসত্মিত্ব নেই। আর নীলকুঠিটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। স্থানটি এখন শঙ্করপুর মৌজায়। এখানে এক ইংরেজ নীলচাষ করতে এসে শঙ্করপুর গ্রামকে ভালবেসে সেখানে থেকে যান। সাথে আরও কয়েক ইংরেজ। এ গ্রামের নীলকুঠিসংলগ্ন এলাকায় জমি কিনে তাঁরা বসবাস শুরম্ন করেন। তাঁদের বংশধররা এখনও এ গ্রামে বসবাস করছেন। তাঁদেরই একজন নরম্যান ডিবারজ। নিজস্ব খ্রিস্টধমর্ীয় কৃষ্টি অুণ্ন রাখলেও তাঁরা সামাজিকভাবে মিশে গেছেন স্থানীয় লোকজন ও রীতিনীতির সঙ্গে। গ্রামের আর দশজনের মতো তাঁদের অধিকাংশই এখন গায়ে খেটে চাষাবাদও করছেন। বনে গেছেন খাঁটি চাষী। তবে এলাকায় আজও তাঁরা সাহেব নামেই পরিচিত। শঙ্করপুর গ্রামের যে পাড়াতে তাঁরা বসবাস করেন সে পাড়া এখনও পরিচিত সাহেবপাড়া নামেই। সাহেবপাড়ার সাহেবরা এখন বাংলাদেশের ভোটার এবং মনেপ্রাণে খাঁটি বাঙালী।
নড়াইলের শঙ্করপুর গ্রামে স্থাপিত নীলকুঠি এবং সেখানকার নীলকর সাহেবদের নির্মম অত্যাচারের চিহ্ন অনেক আগেই নবগঙ্গার ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। স্মৃতি হিসেবে রয়ে গেছে বাঙালীর ওপর ব্রিটিশ অত্যাচারের একমাত্র প্রতিবাদকারী জন ডিবারজের উত্তরসূরিরা। এসব উত্তরসূরি ও আশপাশের বয়স্ক লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নড়াইল জেলার (তৎকালীন নড়াইল মহকুমা) বিভিন্ন এলাকার পাশাপাশি শঙ্করপুর গ্রামে ১৮৪০ সালে নীলকুঠি স্থাপন করে জোরপূর্বক স্থানীয় কৃষকদের দিয়ে নীলচাষ শুরম্ন করে। ফ্রান্সের নাগরিক আর্থার ডিবারজ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তার কন্যাকে বিয়ে করে শ্বশুরের সহযোগিতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে শঙ্করপুর গ্রামের নীলকুঠির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তাঁর সঙ্গে শঙ্করপুর গ্রামে আসেন আরও কয়েক ব্রিটিশ নাগরিক। আর্থার ডিবারজ সস্ত্রীক নীলকুঠিতে বসবাস শুরম্ন করেন। এখানেই জন্ম হয় তাঁদের একমাত্র সনত্মান জন ডিবারজের। ডানপিটে জনের লেখাপড়ার প্রতি তেমন মনোযোগ ছিল না। পারিবারিক অনুশাসন ভেঙ্গে তিনি বাঙালী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশতেন ও হেসেখেলে বেড়াতেন। এসব থেকে বিরত রাখতে না পেরে এক পর্যায়ে তাঁকে ব্রিটেনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু সেখানে মন টেকেনি জন ডিবারজের। শিাজীবন শেষ না করেই তিনি ফিরে আসেন শঙ্করপুরে। বাবার অনুরোধ সত্ত্বেও জন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে চাকরি করতে রাজি হননি। বরং তিনি বাঙালীর ওপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নির্মম নির্যাতনের বিরোধিতা করতেন। একপর্যায়ে একমাত্র সনত্মানের বাঙালীপ্রীতির কাছে হার মেনে যান নীলকুঠি ম্যানেজার আর্থার ডিবারজ। এরপর বন্ধ হয় নির্যাতন। আর্থার ডিবারজও নবগঙ্গা পারের শঙ্করপুর গ্রামের লোকজনকে ভালবাসতে শুরম্ন করেন এবং কুঠিসংলগ্ন প্রায় ১০০ বিঘা জায়গাও কেনেন নিজের টাকায়। আর্থার ডিবারজের মৃতু্যর পর জন ডিবারজ মাকে নিয়ে বাবার কেনা জমিতে ঘর বেঁধে বসবাস শুরম্ন করেন। বিয়ে করেন এ দেশেরই মংলা বন্দর এলাকায় এক বাঙালী খ্রীস্টান পরিবারে। তাঁর ছিল ২ পুত্র ও ২ কন্যা। বড় পুত্র ম্যালকম ডিবারজ এবং ছোট পুত্র মাইকেল ডিবারজ। দু'মেয়ের মধ্যে জুল রেনাল্ড বিয়ে করে ইংল্যান্ডে এবং অনরেনাল্ড স্বামীর সঙ্গে ভারতের বিহারে বসবাস শুরম্ন করেন। ম্যালকম ডিবারজ ভারতে গিয়ে বিভিন্ন যাত্রাদলে অভিনয় শুরম্ন করলেও পরে তিনি খুলনায় এক মিশনারি প্রেসে কাজ শুরম্নর কিছুদিন পর আততায়ীদের হাতে খুন হন। অপরদিকে মাইকেল ডিবারজের তিন পুত্র নরম্যান ডিবারজ, টমাস ডিবারজ ও আনত্মন ডিবারজ সবাই খুলনায় খ্রীস্টান পরিবারে বিয়ে করেন। তাঁরা এবং তাঁদের পরিবার এখন শঙ্করপুরে বসবাস করছেন। নরম্যান ডিবারজের বড় মেয়ে বিউটি নিজ পছন্দে বিয়ে করেন নড়াইলের এক মুসলমান পরিবারের ছেলেকে। তিনি পেশায় ছিলেন নার্স। প্রায় দু'বছর আগে তিনি অসুস্থতায় মৃতু্যবরণ করেন। দ্বিতীয় কন্যা লাভলীও (২৮) পেশায় নার্স। অন্য দু'মেয়ে অস্র (২০) ও সুইট (১৮) পড়াশোনায় মনোযোগী না হওয়ায় তাঁরা স্কুলের গ-ি পেরোতে পারেননি। এ তিন বোন এখনও অবিবাহিত রয়েছেন। একমাত্র পুত্র হ্যানিমন ডিবারজ (২৬) ডিপেস্নামা ইঞ্জিনিয়ার। টমাস ডিবারজের বড় মেয়ে বড়ু ডিবারজের (২৫) কলেজে পড়া অবস্থায় দু'বছর আগে বিয়ে হয়েছে বরিশালে এক খ্রীস্টান পরিবারে। ছোট মেয়ে রজনী ডিবারজ (১৮) কলেজে পড়েন। আনত্মন ডিবারজ প্রায় ১০ বছর আগে সাপের কামড়ে মারা যান। তাঁর মেয়ে আশা (১৬) ও ছেলে আশীষ (১৪) পড়াশোনা করছে। নরম্যান ডিবারজ (৭০) জানান, পূর্বপুরম্নষদের অনেক ভূ-সম্পত্তি থাকলেও পরবতর্ী প্রজন্মের সদস্যরা জমিজমার বেশিরভাগই বিক্রি করে ফেলেছেন। তিনি বলেন, ২০/২৫ বছর আগেও ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত তাঁদের বংশধর ও আত্মীয়স্বজনরা তাঁদের কাছে বড়দিনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কার্ড পাঠাতেন। তাঁরা এখন আর তাঁদের কোন খোঁজখবর রাখেন না। এখন তাঁরা এ দেশের মানুষ। এ দেশকে তাঁরা প্রাণের চেয়ে ভালবাসেন। এ দেশ ছেড়ে আরও কোথাও যেতে তাঁদের ইচ্ছাও জাগে না।

No comments

Powered by Blogger.