কদর্য শাসন কদর্যতাই তৈরি করে by বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে, ধরে নেয়া হয়েছে, জাতির জীবনে আধুনিক রাষ্ট্রের কেন্দ্রিকতা হচ্ছে : ৰমতা। ৰমতার দিক থেকে সংখ্যাগুরম্ন হচ্ছে সশস্ত্র শক্তি, অন্যরা হচ্ছে সংখ্যালঘু।
সেজন্য সংখ্যালঘুর শক্তিকে অর্থাৎ সাধারণ মানুষের শক্তিকে অবশ্যই মেনে নিতে হবে সামরিক নেতৃত্ব এবং সমতার দিক থেকে সংখ্যাগুরম্ন সশস্ত্র শক্তিকে মেনে নিতে হবে। সংখ্যাগুরম্ন শক্তি এবং সংখ্যালঘু শক্তির মধ্যকার পার্থক্য বাংলাদেশের রাজনীতির আবশ্যিক শর্ত; সংখ্যাগুরম্ন শক্তির এ অধিকার মেনে নিতেই হবে। সংখ্যালঘু শক্তি অর্থাৎ সাধারণ মানুষের অধিকার স্বতন্ত্র, এ স্বতন্ত্র শক্তির অধিকার সীমাবদ্ধ, রাষ্ট্র পরিচালনার দিক থেকে সশস্ত্র শক্তির অধিকার সকল প্রশ্নের উর্ধে। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী ইতিহাসে এবং জাতির জীবনে রাষ্ট্রের কেন্দ্রিকতা অর্থাৎ সশস্ত্র শক্তির কেন্দ্রিকতা অস্বীকৃত, তার বদলে সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় বহুতর ইনস্টিটিউশন এবং প্র্যাকটিসের উলেস্নখ আছে, যার মধ্যে দিয়ে সাধারণ মানুষ বিভিন্নতা মেনে নিয়ে জীবনযাপন করে চলেছে। বাংলাদেশের যথার্থ ইতিহাস সশস্ত্র শক্তির মধ্যে কেন্দ্রিক নয়, যথার্থ ইতিহাস কেন্দ্রিক বরং সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের মধ্যে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সাধারণ মানুষের এ ইতিহাসকে অবদমিত করা হয়েছে এবং সশস্ত্র শক্তির ইতিহাসকে কেন্দ্রিক করা হয়েছে। এ কেন্দ্রিকতাকে গঠন করা হয়েছে সামরিক শক্তি-জাতি-রাষ্ট্রের জটিল স্মারক ঘিরে। বাংলাদেশের আধুনিক ইতিহাস গভীরভাবে যুক্ত কলোনিয়ালিজমের সঙ্গে, এ যুক্ততার ভিত্তিতে কাজ করে চলেছে সশস্ত্র শক্তির বিভিন্ন রাজনৈতিক দাবি, যেসব দাবি তৈরি করেছে সামরিক শক্তি বনাম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। সশস্ত্র শক্তি আসত্মে আসত্মে আত্মসাত করেছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধ যে জনযুদ্ধ এ ইতিহাসবোধ আসত্মে আসত্মে, পরিকল্পিতভাবে নষ্ট করা হয়েছে। দুই পেশাদার সশস্ত্র শক্তির লড়াইয়ে উদ্ভিদ্যমান বাংলাদেশের সশস্ত্র শক্তি, অ-পেশাদার অর্থাৎ সাধারণ মানুষের সাহায্যে পাকিসত্মানের সশস্ত্র শক্তিকে পরাজিত করেছে।
মুক্তিযুদ্ধের একটা দিক হচ্ছে, কলোনিয়ালিজম ও কলোনিয়াল রাষ্ট্র ভেঙ্গে ফেলা এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্য দিকটা হচ্ছে, সাধারণ মানুষের সার্বভৌমত্বের ওপর ভিত্তি করে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। বঙ্গবন্ধু দুটি কাজ একত্রে করেছেন এবং একসঙ্গে করেছেন। নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে সশস্ত্র করে মুক্তিযুদ্ধের তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, আবার সাধারণ মানুষ তার অনুপস্থিতিকে সশস্ত্র করে বাঙালি জাতির মধ্যে একটি সিভিল সমাজ তৈরি করেছে এবং সিভিল সমাজকে একটি রাষ্ট্রে রূপানত্মরিত করেছে। এভাবে তাঁর উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতি একত্রে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে অগ্রসর হয়েছে।
কলোনিয়াল রাষ্ট্র ও স্বাধীন রাষ্ট্রের তফাৎ প্রতিদ্বন্দ্বী মতাদর্শের এবং এ তফাৎ যুগানত্মরের। কলোনিয়াল রাষ্ট্রের ডমিনান্সের ভিত্তি এমন একটি ৰমতা সম্পর্ক, যেখানে জবরদসত্মিই প্রধান, যেখানে বাঙালিয়া অধসত্মন এবং অধসত্মনদের কোন স্পেস নেই রাজনীতির দিক থেকে, অর্থনীতির দিক থেকে, সংস্কৃতির দিক থেকে। এ জবরদসত্মি গুঁড়িয়ে দিয়ে ও বাঙালিদের অধসত্মন জীবনযাপন উচ্ছেদ করে, একটি স্বাধীন দেশের ইতিহাসের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। এ তৈরি হওয়াই সাধারণ মানুষের জীবন ও চেতনা, এবং বঙ্গবন্ধুর জীবন ও চেতনা ইন্টিগ্রেট করে হেজিমনি নির্মাণ করেছে।
কলোনিয়াল রাষ্ট্রে মানুষের মনুষ্যত্ব, মানুষের অনত্মঃসার কখনও স্ফুর্ত হয় না। মানুষের মনুষ্যত্ব, মানুষের অনত্মঃসার স্ফুর্ত হয় কেবলমাত্র মুক্ত, অবাধ, সৃষ্টিশীল আবহাওয়ার মধ্যে। স্বাধীন রাষ্ট্র মানুষকে সৃষ্টিশীল, অবাধ, মুক্ত কাজের মধ্যে অবারিত করে দেয়। কলোনিয়াল রাষ্ট্র কিংবা সশস্ত্র রাষ্ট্র মানুষের এ ৰমতা করে দেয় নষ্ট। সেজন্যই মানুষ স্বাধীনতার লড়াই করে। কলোনিয়াল রাষ্ট্রের ফলশ্রম্নতি হচ্ছে শ্রেণী ৰমতা এবং শ্রেণী সমাজের মধ্যে রাষ্ট্রের স্বরূপ নির্মাণ। শ্রেণী ৰমতার বিরম্নদ্ধে স্বাধীনতার লড়াই এবং শ্রেণী সমাজের মধ্যে রাষ্ট্রের যে স্বরূপ তার বিরম্নদ্ধে লড়াই স্বাধীনতাকে বহুমাত্রিক করে তোলে।
স্বাধীনতার এই বহুমাত্রিকতা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খুঁজে পাওয়া যায় না। সশস্ত্র শক্তি, সংখ্যায় স্বল্প হলেও, অস্ত্রের জোরে ম্যাজরিটি হয়েছে এবং ম্যাজরিটিয়ান নীতি মেনে (সংসদ না থাকা সত্ত্বেও) রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। আর শুরম্ন করেছে সমপর্যায় এবং সমদূরত্বের নীতি। সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদের স্নেহ পেয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির সেমিনারে আতাউর রহমান কাকাতুয়ার মতো বলে ওঠেন : 'মুক্তিযুদ্ধের নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান আর জিয়াউর রহমানের নাম পাশাপাশি রাখা উচিত।' সশস্ত্র বাহিনী তাদের রাজত্বকালে সমপর্যায় এবং সমদূরত্ব তৈরি করার জন্য ভদ্রলোক সজ্জন বুদ্ধিজীবী ব্যবহার করেছে, যেসব ভদ্রলোকদের গায়ে ঈশ্বরের ময়লা জামাপরা (সৈয়দ শামসুল হকের ভাষা ধার করে বলছি।) আগস্ট বিদ্রোহের সময় ছাত্র নির্যাতনের প্রতিবাদকারী শিৰক ও ছাত্রসমাজকে বিপথগামী করার জন্য যারা এগিয়ে এসেছেন তাদের একজন শিৰক ও বুদ্ধিজীবী ড. আনিসুজ্জামান। তিনি লিখলেন : "এ পরিস্থিতিতে শিৰক সমিতির প্রতিবাদ সঙ্গত হয়েছে। তবে সমিতির বক্তব্য ঘটনার প্রতিবাদ অতিক্রম করে রাজনৈতিক অবস্থান সূচিত করেছে। এর দায়দায়িত্ব সমিতিকেই বহন করতে হবে। সমিতির পৰে এরকম রাজনৈতিক অবস্থান অবশ্য নতুন নয়, অতীতেও এমন হয়েছে। তবে সান্ধ্য আইন জারির পর ছাত্রছাত্রীদের হল ত্যাগের নির্দেশ অমান্য করতে যদি শিৰক সমিতি আহ্বান জানিয়ে থাকে, তবে তা যথার্থ হয়নি। ছাত্রছাত্রীরা যদি নির্দেশ অগ্রাহ্য করে থেকে যেতো এবং পরিণামে আইনশৃঙ্খলা রৰাকারী বাহিনীর হয়রানির সম্মুখীন হতো, তার দায়িত্ব কে বহন করত? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে এমন হয়রানির ঘটনা যে ঘটছে তা তো আমরা জানতেই পারছি।" কী চমৎকার ব্যাপার। সেনা সদস্যদের নির্যাতনকে নির্যাতন বলার মতো সাহসই হলো না ড. আনিসুজ্জামানের। তিনি বরং মোলায়েমভাবে সামরিক সেনাদের নামে তেল মলম মালিশ করে সেটাকে 'হয়রানি' চালিয়ে দিলেন (অথবা আদর্শিক ও নৈতিকভাবে তিনি সেরকমই মনে করেন) এবং 'যদি' শব্দটির ওপর নির্ভর করে শিৰক সমিতির বিরম্নদ্ধে ড. আনিসুজ্জামান তাঁর ৰোভ উগড়ে প্রতিনিধিত্ব করলেন নির্যাতন সামরিক কর্মকর্তাদের (ইমতিয়ার শামীম, শানত্ম নিরপেৰ তত্ত্বাবধায়ক ২০০৯)। সশস্ত্র শক্তির কদর্যতার শেষ নেই। 'যেমন গণমাধ্যমে আলোচিত হয়নি নারী পুলিশ কনস্টেবল আঞ্জুমান আরা, যিনি এক সেপ্টেম্বরে মোবাইলে উচ্চস্বরে কথা বলতে মানা করার পঙ্গু হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ সেবিকা গুলশান আরাকে মারধর করতে করতে বলেছিলেন, এই হাত দিয়ে হাসিনাকে এ্যারেস্ট করেছি। তোকেও এ্যারেস্ট করব (প্রথম আলো, দুই সেপ্টেম্বর ২০০৭) আলোচিত হননি র্যাবের এএসআই কামরান, যিনি ১৩ সেপ্টেম্বর মিরপুরের বিআরটিএ-এর সামনে তার মোটরসাইকেল দিয়ে পথযাত্রী গার্মেন্টস মালিক আলী হক ও তার চার বছরের প্রতিবন্ধী শিশু শাহেদকে বহনকারী মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনা ঘটানোর পর উল্টো গালিগালাজ করেন। তারপর র্যাবের বাহিনী ডেকে তীব্র নির্যাতন চালান তাদের ওপর (ইমতিয়ার শামীম, শানত্ম নিরপেৰ তত্ত্বাধায়ক ২০০৯)।
সশস্ত্র বাহিনীর শাসন ফকরম্নদ্দীন-মইন উ আহমেদদের আবির্ভাব ঘটিয়েছে, তেমনি আলোর মধ্যে এনেছে আতোয়ার রহমান-আনিসুজ্জামাদের তেমনি আলোর মধ্যে এনেছে আঞ্জুমান আরাদের, তেমনি আলোর মধ্যে এনেছে এএসআই কামরানদের। কদর্য শাসন কদর্যতাই তৈরি করে, দুর্বৃত্তদের শাসন দুর্বৃত্তদের তৈরি করে।

No comments

Powered by Blogger.