প্রসঙ্গ ইসলাম ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিল অধ্যাপক by হাসান আবদুল কাইয়ূম

সাধারণত হেমনত্ম, শীত, বসনত্মকালে বাংলাদেশে ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিলের হিড়িক পড়ে যায়। শতকরা ৯০ ভাগ মুসলিম অধু্যষিত এই বৃহৎ ব-দ্বীপে ইসলামের সৌকর্য প্রতিণে বেগবান ধারায় বর্তমান রয়েছে।
ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিল আয়োজনের মধ্য দিয়ে ইসলামী চেতনা ও হিদায়াতের আলোকরশ্মি প্রসারিত করবার সৎ উদ্দেশ্য বিকাশ লাভ করে, সেই সঙ্গে সত্য সুন্দরের জ্ঞান দান করে। ইসালে সওয়াব অ র্থ সওয়াব পেঁৗছানো আর ওয়াজ মহফিল অর্থ সদুপদেশ সভা। আলস্নাহজালস্না শানুহু হিকমত ও ওয়াজ দ্বারা মানুষকে সৎ পথে আহ্বান করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে : ঊদ্'উ ইলা সাবীলি রবি্বকা বিল হিকমাতি ওয়াল মাও'ইযাতিল হাসানা_ তুমি তোমার রব-এর পথে আহ্বান করো হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা। (সুরা নহল : আয়াত ১২৫)
হিকমত অর্থ কৌশল, নিপুণতা, বিচৰণতা, প্রজ্ঞা। সোজা কথা, হিকমতকে বলা হয় সঠিক জ্ঞান। হিকমতের সাথে ও সদুপদেশের মাধ্যমে ইসলাম প্রচারের ধারা প্রিয় নবী সরকারে দোআলম নূরে মুজাস্সম হযরত মুহাম্মাদুর রসুলুলস্নাহ সালস্নালস্নাহু আলায়হি ওয়া সালস্নাম থেকে উৎসারিত হয়েছে।
সাধারণত বছরে একবার নির্দিষ্ট তারিখে ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিল বিভিন্ন পীর সাহেবের খানকা শরীফে অনুষ্ঠিত হয়। কোথাও কোথাও উর্স অনুষ্ঠিত হয়। উর্সের নামে যেসব বার্ষিক জলসা বা মহফিল অনুষ্ঠিত হয় তার অধিকাংশই শির্ক, কুফর, বিদা'আত ও কুসংস্কার প্রভৃতি দ্বারা আচ্ছাদিত। এসব শির্ক, কুফর, বিদা'আত ও কুসংস্কারে আচ্ছাদিত জলসা থেকে সওয়াব লাভের আশা করা যায় না। তবে কিছু উর্স আছে যেগুলোতে অনৈসলামিক কার্যকলাপ হয় না। ৬ রজব আজমীর শরীফে যে উর্স হয় তা খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুলস্নাহি 'আলায়হির ওফাত বার্ষিকী উপল েঅনুষ্ঠিত হয়। আজমীর শরীফে এসে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী রহমাতুলস্নাহি 'আলায়হির মাযার শরীফ জিয়ারত করে রম্নহানী তরক্কী লাভ করা যায়। সেই সঙ্গে বহু ফায়দাও হাসিল হয়। কিন্তু এক শ্রেণীর ভ- খাজা বাবার নামে যে সমসত্ম কার্যকলাপ করে তা শরী'আতসম্মত নয়। মহাপবিত্র উর্স শরীফের নামে যে সমসত্ম কর্ম হয়ে থাকে তাতে যোগ দিয়ে মহামূল্যবান ইমান আকিদা বরবাদ করা ছাড়া আর কোনো ফায়দা পাওয়া যায় না। অন্যদিকে এমন কিছু উর্স মুবারক আছে যাতে যোগ দিয়ে ইমান আকিদা সুদৃঢ় করা যায়। এমনি এক উর্স অনুষ্ঠিত হয় যশোরের খড়কী শরীফে প্রতিবছর চৈত্র মাসের ১৬ তারিখে। খড়কী শরীফের এই পীর পরিবারের উর্ধতন পুরম্নষ সৈয়দ সুলতান সম্রাট আকবরের আমলে ১৫৬৭ খৃস্টাব্দে যশোর অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের জন্য আগমন করেন। সৈয়দ সুলতানের বংশপরম্পরাগতভাবে বহু আলস্নাহর ওলী জন্মগ্রহণ করেছেন। এখানকার উর্স মুবারকে শির্ক, বিদা'আতমূলক কোনো কার্যকলাপ হয় না। এই উর্সের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা শাহ মোহাম্মদ আব্দুল করিম রহমাতুলস্নাহি 'আলায়হি অতি উচ্চ সত্মরের কামিল পীর ছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় মৌলি ও বিসত্মারিত তাসাওউফ গ্রন্থ এরশাদে খালেকিয়া বা খোদাপ্রাপ্তি তত্ত্ব রচনা করেন। এই গ্রন্থ সম্পর্কে প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান ও প্রফেসর মুহম্মদ আব্দুল হাইয়ের যৌথ গ্রন্থনায় প্রকাশিত বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত গ্রন্থে বলা হয়েছে : আব্দুল করিম ছিলেন নকশবন্দীয়া তরিকার একজন কামিল সুফী সাধক। নিজের জীবনে সূফীতত্ত্বের আমল করেছিলেন বলে দুরূহ সূফীতত্ত্ব সম্বন্ধে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল।... মোহাম্মদ আব্দুল করিমের খোদাপ্রাপ্তি তত্ত্বের মতো বাংলা ভাষায় তাসাওয়াফ সম্পর্কিত বই আর দ্বিতীয়টি দেখা যায় না।...
বাংলা অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিল কায়েম করেন ফুরফুরা শরীফের পীর মুজাদ্দিদে যামান হযরত মওলানা শাহ সূফী আলহাজ্জ আবু বকর সিদ্দিকী রহমাতুলস্নাহি 'আলায়হি। তিনি এই মহফিল সম্পর্কে বলেছেন : আমি জানি, আলস্নাহ বলিয়াছেন : ইয়া আইয়ু্যহালস্নাযীনা আমানু কুও আনফুসাকুম ওয়া 'আহলিকুম নারা_ "হে ইমানদারগণ, তোমরা নিজেদিগকে ও নিজেদের পরিজনকে অগি্ন হইতে রা কর।" এই আয়াতের মর্ম অবলম্বনে আমার বাড়িতে দেশী-বিদেশী সকলকে আম দাওয়াত দিয়া বহু আলেম ওলামা হাফেজ, ক্বারী কতর্ৃক ওয়াজ নছিহত করাইয়া ও নিজে করিয়া শরীয়তের হুকুম আহ্কাম জানাইয়া দেই।... ৬০/৭০ খতম কুরআন শরীফ, ছুরা এখলাছ ও ফাতেহা, কলেমা ইত্যাদি পড়ানো হয়। এই সমসত্মের ছওয়াব হওরত নবী (ছাঃ) এর ও যাবতীয় অলি আওলিয়া, গওছ, কুতুব ও যাবতীয় মুছলমানদের রম্নহের ওপর ছওয়াব রেছানী করা হয়। এই জন্য এই মহফিলের এক নাম ইছালে ছওয়াব। এই মহফিল যাহাতে আলস্নাহ কায়েম রাখেন তাহার চেষ্টা আমার পুত্রগণ, খলিফাগণ ও মুরিদগণ করিবেন। খলিফাগণের মধ্যে যদি কাহার বাড়িতে এরূপ মহফিল করিতে কাহারও শক্তি হয় তবে তিনি তাহা করিবেন। সাবধান! কেহ যেন অর্থের লোভে বা অন্য কোনোরূপ মানমর্যাদার জন্য না করেন। বিশুদ্ধ হেদায়াতের নিয়তে করিলে বহু নেকী পাইবেন। আরও সাবধান থাকিবেন যে, যেন এই মহফিলে কোনো প্রকার বেদয়াত ও হারাম কার্য বা নামাজের জামায়াত তরক না হয়। বাজে তামাসা ইত্যাদি না হয়। (দ্র. মওলানা মোহাম্মদ রম্নহুল আমিন, ফুরফুরা শরীফের হযরত পীর ছাহেব কেবলার বিসত্মারিত জীবনী, প্রথম সংস্করণ, কলিকাতা, ১৯৩৯, পৃ. ২৪২-২৪৩)।
ফুরফুরা শরীফের আলা হযরত পীর সাহেব কিবলা মুজাদ্দিদে যামান মওলানা শাহ সূফী আলহাজ্জ আবু বকর সিদ্দিকী রহমাতুলস্নাহি আলায়হি তার প্রধান প্রধান খলীফাগণের বাড়িতে তারিখ নির্ধারণ করে ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিল কায়েম করে যান যা আজও কায়েম রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হচ্ছে : ছারছীনার ইসালে সওয়াব যা অনুষ্ঠিত হয় ১৪, ১৫ ও ১৬ অগ্রহায়ণ, বৃহত্তর যশোর অঞ্চলের মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার দ্বারিয়াপুর শরীফে ৪ মাঘ অনুষ্ঠিত হয় দর যামানে অাঁ ইসালে সওয়াব ও মহফিলে ওয়াজ। এছাড়াও কুমিলস্নার ধামতিতে, যশোরের ইনায়েতপুরে, ফরিদপুরের ডোবরায়, সাতীরার হামিদপুরে, নোয়াখালীর শ্রীনদীতে_ এসব ছাড়াও বাংলাদেশসহ পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের প্রায় কয়েক শ' স্থানে ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিল নির্ধারিত তারিখে অনুষ্ঠিত হয়।
ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিলের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই মহফিলে বহুবার কুরআন মজীদ খতম করা হয়, বা'দ মাগরিব যিক্র-আজকার, তা'লীম-তালকীন, তওবা ইসত্মিগফার করা হয়। হাজার হাজার মানুষ যখন একযোগে প্রেমে আপস্নুত হয়ে মননে উদ্ভাসিত হয়ে বিনয়ের সঙ্গে সশঙ্ক চিত্তে আলস্নাহ আলস্নাহ যিক্র করে তখন এক অনন্য পবিত্র পরিবেশ সমসত্ম মহফিল ময়দানজুড়ে প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে। আলস্নাহ আলস্নাহ যিকর তো হয়ই, তাছাড়া নফীইসবাত বা লাইলাহা ইলস্নাহ যিক্র, তওবার ফয়েজ ইত্যাদি যখন চলতে থাকে তখন এক মোহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। 'ইশার সালাত বা'দ থেকে তাহাজ্জুদ পর্যনত্ম চলে ওয়াজ নসিহত। তাহাজ্জুদ আদায়ের পর ফজর হওয়া পর্যনত্ম সালাত-সালাম। ফজরের সালাত আদায়ের পর সূযের্াদয়ের পূর্ব পর্যনত্ম চলে তরিকতের নিয়ম অনুযায়ী দরম্নদ শরীফ পাঠ, যিক্র-আজকার। এই সময় এক অপূর্ব অবস্থার সৃষ্টি হয় যিক্রকারীদের মধ্যে, যা ভাষা দিয়ে বুঝানো খুবই কঠিন। সূর্য উঠলে মীলাদ মহফিল শুরম্ন হয়। প্রায় দুই ঘণ্টা কি আড়াই ঘণ্টা ধরে মীলাদ মহফিল চলতে থাকে। মীলাদ মহফিলের পূর্বে তওবা পড়ানো হয় এবং মুরীদ করা হয়। মীলাদ মহফিলের শেষ পর্যায়ে তাওয়ালুস্নদ শরীফ পাঠ শেষে সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রিয়নবী সালস্নালস্নাহু 'আলায়হি ওয়া সালস্নামের প্রতি সুমধুর এলহানে সমবেত কণ্ঠে সালাম ও সালাত পেশ করেন। এর পর মনে মনে খতম শরীফ পাঠ করা হয়। অর্থাৎ বিসমিলস্নাহসহ তিন বার সূরা ফাতিহা, বিসমিলস্নাহসহ দশ বার সূরা ইখলাস, এগারো বার দরূদ শরীফ এবং সাত বার আসত্মাগফিরম্নলস্নাহি রবি্ব মিন কুলিস্ন জাম্বিউ ওয়াতুবু ইলায়হি পাঠ করা শেষে সওয়াব রিসানী করা হয় আখেরী মুনাজাতের মাধ্যমে। তামাম আম্বিয়া কেরাম, সাহাবায়ে কেরাম, শোহাদায়ে কেরাম, আজওয়ায়ে মুতাহিরা, আশারায়ে মুবাশশিরা, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন, তরীকতের ইমামগণসহ অন্য সকলের রূহে সওয়াব পেঁৗছানো হয় এবং বিশ্বশানত্মির জন্য, বিশ্ব মানবতার কল্যাণের জন্য দু'আ করা হয়।
ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিলে মানুষকে আলোকিত পথের দিকে আহ্বান জানানো হয়। একে হিদায়াতের উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায়।
লেখক : উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.), সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।

No comments

Powered by Blogger.