তিসত্মা পানি চুক্তি না হলে দেশের উত্তরের ৩ জেলা মরম্নভূমি হয়ে যাবে- এ মুহূর্তে ২ হাজার ৭শ' কিউসেক পানি পাবার কথা থাকলেও বাংলাদেশ পাচ্ছে মাত্র ৩শ' কিউসেক by মামুন-অর-রশিদ
তিসত্মা ব্যারাজ নিয়ে কাঙ্ৰিত চুক্তি ত্বরান্বিত করতে দু'দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজ নিজ পানি সম্পদমন্ত্রীকে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এই চুক্তির মাধ্যমে তিসত্মার পানি বণ্টনে সমানুপাত নিশ্চিত করা হবে।
আগামী তিন মাসের মধ্যে অর্থাৎ মার্চ নাগাদ এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধানত্মে পেঁৗছানোর ব্যাপারে দু'দেশ ঐকমত্যে পেঁৗছেছে। শেখ হাসিনার আমন্ত্রনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যখন বাংলাদেশে আসবেন তখন এই চুক্তি হতে পারে বলে সংশিস্নষ্ট সূত্রগুলো মনে করছে। বহুকাঙ্ৰিত তিসত্মা চুক্তি না হওয়ায় দু'দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে শীর্ষ দু'নেতা এই নির্দেশ দেন। তিসত্মার পানি রাজনীতিতে ভারত উদার না হলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের তিন জেলা নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুরের ১৩ উপজেলা মরম্নভূমিতে পরিণত হবে। অবশ্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মৌর্য শেরাটন হোটেলে 'কমল মিলনায়তনে' মঙ্গলবারের বৈঠকে বিভিন্ন বিষয়ে ভারতকে আরও উদার হওয়ার আহবান জানিয়েছেন। তিসত্মার পানি বণ্টন নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশের বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত জনকণ্ঠকে বলেন, বিষয়গুলো খুবই জটিল। জটিলতার জট খোলা ছাড়া ত্বরিত কোন সিদ্ধানত্মে পেঁৗছানো সম্ভব নয়।ভারতের জলপাইগুড়িতে গজলডোবায় বাঁধ দিয়ে তিসত্মার পানি আটকে দেয়ায় ইতোমধ্যে যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, তিসত্মা ও ধরলার বুকে জেগে উঠেছে অসংখ্য চর। ১৯৮৩ সালের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক এবং ১৯৯৯ সালে যৌথ নদী কমিশনের সিদ্ধানত্ম অনুযায়ী শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশকে ২ হাজার ৭শ' কিউসেক পানি দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু চলতি বছরের শুষ্ক মৌসুমের এই মুহূর্তে পাওয়া এই পানির পরিমাণ মাত্র ৩শ' কিউসেক। এভাবে শুষ্ক মৌসুমে একতরফা পানি প্রত্যাহার জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিরান মরম্নভূমিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে তিসত্মা প্রকল্পের আওতাধীন সাড়ে পাঁচ লাখ হেক্টর আবাদী জমি। অন্যদিকে বর্ষার মৌসুমে গজলডোবার ভারতীয় বাঁধের ৫৪টি গেট খুলে দেয়ায় উত্তরাঞ্চলের বিসত্মৃত এলাকা পস্নাবিত হয়।
বর্ষার মৌসুমে জলপাইগুড়ির গজলডোবায় ৫৪টি গেট খুলে দেয়ায় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বিসত্মীর্ণ এলাকা বন্যাকবলিত হয়। শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশকে ২ হাজার ৭শ' কিউসেক পানি সরবরাহের কথা রয়েছে। কিন্তু গত বছর এই পানি প্রবাহের পরিমাণ ছিল মাত্র ৫৪৫ কিউসেক যা স্বাভাবিক প্রবাহের মাত্র ১০ ভাগ। শুষ্ক মৌসুমে স্বাভাবিক পানি প্রবাহের পরিমাণ হচ্ছে প্রায় ৫/৬ হাজার কিউসেক। তবে এবার পানির প্রবাহ সর্ব নিম্নে। এবার পানির প্রবাহ মাত্র ৩শ' কিউসেক। বর্ষা মৌসুমে পানি প্রবাহের পরিমাণ ১০ হাজার কিউসেক ছাড়িয়ে যায়। ভারত ২ হাজার ৯শ' ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ পানি প্রবাহের মাধ্যমে ১ হাজার ৫শ' কিউসেক পানি মহানন্দা নদীতে নিয়ে যায়। ভারত পানির গতি পরিবর্তন করে দার্জিলিং, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি ও মালদাহে সেচ ব্যবস্থা চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ এবং ৩৯ ভাগ ভারত এবং বাকি ২৫ ভাগ নদীতে সংরৰিত থাকবে। বাংলাদেশের তিসত্মা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের আওতাধীন জমির পরিমাণ ৭ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর। সেচ সুবিধার আওতাভুক্ত জমির পরিমাণ ৫ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর।
সিকিম থেকে উৎপন্ন হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত তিসত্মার দৈর্ঘ্য ৩শ' ১৫ কিলোমিটার। বাংলাদেশ অংশের দৈর্ঘ্য ১শ' ১৩ কিলোমিটার। প্রস্থ ৯শ' ৫০ কিলোমিটার। তিসত্মার মোট অববাহিকার পরিমাণ ১৭শ' ১৯ বর্গকিলোমিটার। ১৯৯০ সালে তিসত্মা ব্যারাজের কাজ শুরম্ন হয়। ৯৮ সালের জুন মাসে ব্যারাজ নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ১৯৭২ সালে গঠিত যৌথ নদী কমিশন এখন পর্যনত্ম জীবনবান্ধব পানি বণ্টন নিশ্চিত করতে পারেনি। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর উপলৰে ঢাকায় যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক হয়। এই বৈঠকে তিসত্মাই ছিল আলোচিত বিষয়। হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে লালমনিরহাটে গড়ে তোলা তিসত্মা ব্যারাজ আজ উপযোগহীন হয়ে পড়ছে। দু'দেশের পানিসম্পদ সচিব ঢাকায় দু'দিনের বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতিতে তিসত্মার চুক্তির ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু দু'দেশের সচিবদের বৈঠকে আলোচনার ভিত্তিতে আশাবাদ প্রকাশের পরের দিন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, 'তিসত্মার পানি বণ্টন নিয়ে কোন চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা এবারে নেই।' পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের পরই বিভিন্ন মহলে হতাশা সৃষ্টি হয়। কারণ তিসত্মা এখন বাংলাদেশের অসত্মিত্ব, জীবন-মরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তিন দিনের সরকারী সফরে ভারত গিয়ে তিসত্মার কথা ভোলেননি। তিনি বিষয়টি শীর্ষ বৈঠকে আলোচনায় নিয়ে এসেছেন। এমনকি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের দেয়া নৈশভোজেও তিনি তিসত্মার বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে এসেছেন। তিসত্মার পানি বণ্টন পরিস্থিতির বর্তমান বাসত্মবতা, দু'দেশের সমানুপাতিক স্বার্থ সংরৰণের উপায় খুঁজে বের করে খুব শীঘ্রই চুক্তির ব্যাপারে দু'প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। দু'দেশের সরকারের নীতিনির্ধারক মহল মনে করছে অন্যান্য বিষয়ের মতো তিসত্মার পানি বণ্টন চুক্তি হবে এবং এৰেত্রে বিরাজমান সকল জটিলতার অবসান হবে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশি বিশ্বাস ও আস্থার পর্যায়ে রয়েছে। দৰিণ এশিয়ার দু'টি দেশেই এখন উদার-গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক মানস কাঠামোর দু'টি সরকার থাকায় সকল সমস্যার সমাধান সহজ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে বলেছেন, 'এখনই সময়। সকল সমস্যার সমাধান করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।'
তিসত্মার পানি বণ্টন নিয়ে জানতে চাইলে দেশের বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, দীর্ঘদিন এই বিষয়টি নিয়ে আমি কোন কাজ করিনি। ফলে এই মুহূর্তের অবস্থা বলতে পারব না। তবে বাংলাদেশের জন্য শুষ্ক এবং বর্ষার মৌসুমে কতটুকু পানি ভারত দেবে, আমাদের তিসত্মা ব্যারাজ প্রকল্পের মাধ্যমে আবাদী জমি সেচের জন্য কি পরিমাণ পানি দরকার, বর্ষার মৌসুমে ভারত গজলডোবা দিয়ে কতটুকু পানি ছাড়বে- এসব বিসত্মারিত জানার পরই সিদ্ধানত্ম নিতে হবে।
No comments