নতুন বছরে কেমন হবে বিশ্ব রাজনীতি by ড. তারেক শামসুর রেহমান

রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অস্ত্র হ্রাস সংক্রান্ত 'নিউ স্টার্ট' চুক্তি স্বাক্ষর, যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ও রাশিয়ার ডুমায় তা অনুমোদনের পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, ২০১১ সালে বিশ্ব পরাশক্তির মধ্যকার সম্পর্ক কোন পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হবে?
চীনের প্রেসিডেন্ট আগামী ১৯ জানুয়ারি ওয়াশিংটন সফরে যাচ্ছেন। স্পষ্টতই রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের যে 'নতুন ক্ষেত্র' তৈরি হয়েছে, বেইজিং তাতে শরিক হতে চায়। এই তিন পরাশক্তির পাশাপাশি ভারতের একটি ভূমিকাও হবে লক্ষ রাখার মতো। চার-চারজন বিশ্ববরেণ্য নেতা_বারাক ওবামা, সারকোজি, ওয়েন চিয়াবাও, মেদভেদেভ ভারত সফর করে গেলেন ডিসেম্বরে। এর আগে জুলাই মাসে ভারতে এসেছিলেন যুক্তরাজ্যের নয়া প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন। বিশ্ব রাজনীতিতে ভারত যে কত গুরুত্বপূর্ণ এ পাঁচ নেতার ভারত সফরের মধ্য দিয়ে তা প্রমাণিত হয়েছিল। ওই সফরে হাজার হাজার কোটি টাকার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ভারত এখন বড় বাজার। এ বাজারে চীনা পণ্য যেমনি ঢুকতে চায়, ঠিক তেমনি ঢুকতে চায় মার্কিনি পণ্য। এখানে প্রতিযোগিতা হবে। এ প্রতিযোগিতা আবার বৃহৎ শক্তির মধ্যকার দ্বন্দ্বকে উসকে দিতে পারে।
নিঃসন্দেহে একটা বড় অগ্রগতি হয়েছে 'নিউ স্টার্ট' চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে। গত এপ্রিলে বারাক ওবামা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট মেদভেদেভের সঙ্গে এ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু এর বৈধতার জন্য দুই দেশের পার্লামেন্টের অনুমোদনের প্রয়োজন ছিল। গত দুই মাস বারাক ওবামা এটা নিয়ে লবিং করেছেন। শেষ পর্যন্ত ২২ ডিসেম্বর সিনেটে ৭১-২৬ ভোটে তা অনুমোদিত হয়। রিপাবলিকানরা প্রথমে বিরোধিতা করলেও পরে তা অনুমোদন করে। পরে ডুমাও তা অনুমোদন করে। এ চুক্তির ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া তাদের পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা কমাবে এবং সর্বোচ্চ এক হাজার ৫৫০টি করে পরমাণু বোমা মোতায়েন রাখতে পারবে। এর আগে ২০০২ সালে যে স্টার্ট চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার তুলনায় এ সংখ্যা ৩০ শতাংশ কম। নিঃসন্দেহে এটা বড় অগ্রগতি। এতে দুই পরাশক্তির মধ্যে একটা আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হলেও বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র যে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তুলেছে এবং কোথাও কোথাও যা রাশিয়ার স্বার্থকে আঘাত করছে, তার কী হবে? যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে যে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, তাতে রাশিয়ার প্রবল আপত্তি রয়েছে। ইউক্রেন ও জর্জিয়া ন্যাটোতে যোগ দেবে, এখানেও আপত্তি রাশিয়ার। জর্জিয়া রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশ। জর্জিয়া ন্যাটোতে যোগ দিলেও সেখানে রাশিয়ার সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হলে তা রাশিয়াকে এক ধরনের স্নায়ু যন্ত্রণার মধ্যে ঠেলে দেবে। কৃষ্ণ সাগর এলাকায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ঔড়রহঃ ঞধংশ ঋড়ৎপব_ঊধংঃ। রোমানিয়ার শহর কনস্টানজার কাছাকাছি মিখাইল কোগালনাইসেনু বিমান ঘাঁটিতে রয়েছে এর সদর দপ্তর। কিরগিজস্তানের মানাস বিমান ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্র অনেক দিন ধরেই ব্যবহার করে আসছে। আফগানিস্তান ও ইরাকে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান ঘাঁটি। যদি সূক্ষ্মভাবে খোঁজ নেওয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে ছয়টি মহাদেশের প্রায় প্রতিটিতে যুক্তরাষ্ট্র তার সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে, এমনকি অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশেও ৫৪টি 'সামরিক মিশন' রয়েছে তাদের। লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকায় যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান শক্তিশালী করেছে। সামরিক খাতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক খাতে বাজেট বরাদ্দ ছিল ৬৮০ বিলিয়ন ডলার। রাশিয়ার সঙ্গে কৌশলগত অস্ত্র হ্রাস করার চুক্তি করলেও যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী সামরিক কর্তৃত্ব রাশিয়া সন্দেহের চোখেই দেখবে। চলতি বছর তাই এ কারণেই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক আরো একটি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল_তা হচ্ছে ডিসেম্বরে রাশিয়ার পার্লামেন্ট ডুমার নির্বাচন। ধারণা করা হচ্ছে, পুতিন প্রধানমন্ত্রী পদে আর দাঁড়াবেন না। তিনি ২০১২ সালে অনুষ্ঠিতব্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। ২০০০ ও ২০০৪ সালে পরপর দুই বার তিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সাংবিধানিকভাবে তিনি তিনবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন না। তাই তিনি ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এখন আবার ২০১২ সালে তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেবেন। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে পুতিন অতটা 'উন্মুক্ত' নন। কখনো কখনো সমালোচনাও করেছেন। এখন দেখতে হবে পুতিনের সঙ্গে ওবামা প্রশাসন কিভাবে সম্পর্ক রক্ষা করে।
১৯ জানুয়ারি চীনা প্রেসিডেন্ট হু চিনথাওয়ের ওয়াশিংটন সফরও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। চীন বিশ্ব রাজনীতিতে অন্যতম একটি শক্তি। উত্তর কোরিয়া ও ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের এ মুহূর্তে চীনের সহযোগিতা দরকার। ২০০৯ সালের নভেম্বরে বারাক ওবামা বেইজিং সফর করেছিলেন। এখন ফিরতি সফরে হু চিনথাও যাচ্ছেন ওয়াশিংটনে, যদিও বেশ কিছু ইস্যুতে ওয়াশিংটনের সঙ্গে বেইজিংয়ের সম্পর্ক ভালো নয়। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও চীনা মুদ্রানীতি নিয়ে যে বিরোধ ছিল, তা রয়ে গেছে। ওয়াশিংটন মনে করে, চীনা ইউয়ানের মূল্য অনেক কম, কিন্তু চীনা নেতারা এটা মানতে রাজি নন। ইরানের প্রশ্নেও দুই দেশের অবস্থান এক নয়। যুক্তরাষ্ট্র তিব্বতকে চীনের অংশ বলে মনে করলেও দালাই লামার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পক্ষে হোয়াইট হাউস প্রশাসন। দালাই লামাকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, এটা চীন সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। উত্তর কোরিয়াকে ছয় জাতি আলোচনায় ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে চীন রাজি থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র এখন তিন জাতি (যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া) আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে দুই দেশের অবস্থানও ভিন্ন। তবে চীনা নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় অংশীদারির কথা বলেছেন। এটাই মোদ্দা কথা। আধিপত্য নয়, প্রভাব বিস্তার নয়, সামরিক আগ্রাসনও নয়, দরকার সমমর্যাদাভিত্তিক অংশীদারি। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে যদি সমমর্যাদাভিত্তিক অংশীদারি নিশ্চিত হয়, তাহলে তা বিশ্ব স্থিতিশীলতার জন্য বড় ভূমিকা রাখবে। হু চিনথাওয়ের ওয়াশিংটন সফরের মধ্য দিয়ে এ ধরনের একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে এখন। ওবামা প্রশাসন চাইছে, চীন নয়া বিশ্ব ব্যবস্থায় একটি দায়িত্বশীল আচরণ করুক। চীনকে তারা মনে করেছে 'জবংঢ়ড়হংরনষব ঝঃধশবযড়ষফবৎ' হিসেবে। ডেপুটি সেক্রেটারি অব স্টেট জেমস স্ট্রাইনবার্গের ভাষায় এ সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ঝঃৎধঃবমরপ জবধংংঁৎধহপব হিসেবে। এর অর্থ কী? এটা ব্যাখ্যা করা হয়েছে এভাবে_'ঝঃৎধঃবমরপ জবধংংঁৎধহপব ৎবয়ঁরৎবং ঃযধঃ নড়ঃয ংরফবং ভরহফ ধিুং ঃড় যরমযষরমযঃ ধহফ ৎবরহভড়ৎপব ঃযব ধৎবধং ড়ভ পড়সসড়হ রহঃবৎবংঃ, যিরষব ধফফৎবংংরহম ঃযব ংড়ঁৎপবং ড়ভ সরংঃৎঁংঃ ফরৎবপঃষু যিবৎব ঃযবু নব ঢ়ড়ষরঃরপধষ, সরষরঃধৎু ড়ৎ বপড়হড়সরপ'. (ঋড়ৎবরমহ ঢ়ড়ষরপু, ঘড়াবসনবৎ ২০০৯)।
তিনটি বৃহৎ শক্তি যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের মধ্যকার সম্পর্ক বিশ্ব রাজনীতিতে আলোচিত হলেও ভারতের একটি ভূমিকা ২০১১ সালে নানা কারণে আলোচিত হবে। ভারত বিশ্বসভার সদস্য (স্থায়ী পরিষদ) হতে চায়। ওবামার তাতে সমর্থন ভারতের অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করেছে। বিশ্বব্যাংকের উপদেষ্টা হরিন্দর কোহলীর মতে, আগামী ৩০ বছরে ভারত হবে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধিশালী দেশ। মাথাপিছু আয় ৯৪০ থেকে বেড়ে ২২ হাজার ডলারে দাঁড়াবে। তখন বিশ্ব অর্থনীতিতে ১৭ শতাংশ অবদান রাখবে ভারত (২০০৭ সালে মাত্র ২ শতাংশ)। যদিও এর জন্য প্রয়োজন ৮ থেকে ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। এ ধরনের মন্তব্য প্রমাণ করে, ভারত ধীরে ধীরে একটি অর্থনৈতিক শক্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ভারতের নেতৃত্ব যদি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে 'সম্পর্ক' ও 'আচরণ' পরিবর্তন না করে, তাহলে বিশ্বসভায় তার গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। চীন-ভারত সম্পর্কের দিকে তাই দৃষ্টি থাকবে অনেকের, যদিও ডিসেম্বরে চীনা প্রধানমন্ত্রী ওয়েন চিয়াবাওয়ের নয়াদিলি্ল সফর সম্পর্কের ক্ষেত্রে তেমন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আনতে পারেনি। গত ১০ বছরে এ দুটি দেশের মধ্যে বাণিজ্য বেড়েছে ৩০ গুণ। চুক্তি হয়েছে দুই হাজার কোটি ডলারের। চীন যা ভারতে রপ্তানি করে, আমদানি করে কম। ওয়েন চিয়াবাওয়ের এ সফর 'বাণিজ্যিক সম্পর্ক'কে বৃদ্ধি করলেও 'রাজনৈতিক সম্পর্ক' বৃদ্ধি করতে পারেনি। তিব্বত ও তাইওয়ানকে ভারত চীনের অংশ বলে মনে করলেও এবারের যৌথ ইশতেহারে তা উল্লেখ করা হয়নি, যেমন উল্লেখ করা হয়নি 'জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ'_এ কথাটি। ভারত মহাসাগরে চীনের নৌবাহিনীর উপস্থিতি বৃদ্ধি ('মুক্তার মালা' নীতি) যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভারতেরও চিন্তার কারণ। বলার অপেক্ষা রাখে না ২০১১ সালে এ বিষয় সম্পর্ক উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে গুরুত্ব পাবে বেশি। বলা ভালো, ভারত ইজওঈ ভুক্ত চারটি নব্য বড় শিল্পোন্নত দেশের সদস্য, যেখানে চীন ও রাশিয়াও রয়েছে। বিশ্বের উষ্ণতা রোধে এ চারটি দেশের (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন) ভূমিকাকে বিশ্বনেতারা গুরুত্ব দিচ্ছেন। চলতি নভেম্বরে (২০১১) দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে যে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন হবে (কপ-১৭), তাতে এ দেশগুলোর ভূমিকা হবে বড়। কেননা তারা বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাইঅঙ্াইড নিঃগর্মন করে বেশি, যা বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে। ডারবানে একটি চুক্তি হতেই হবে। কেননা ২০১২ সালে বিশ্বের উষ্ণতা রোধ সংক্রান্ত কিয়োটো চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। কানকুনে (২০১০) উন্নয়নশীল বিশ্বের অর্থ প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু চুক্তির ব্যাপারে কোনো ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাই যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ইজওঈ ভুক্ত দেশগুলোর একটি ভূমিকা হবে লক্ষ করার বিষয়। ২০১১ তাই সংগত কারণেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব শক্তিগুলোর মধ্যে সম্পর্ক ও সেই সঙ্গে ইজওঈ ভুক্ত দেশগুলোর একটি ভূমিকা ২০১১ সালের বিশ্ব রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলবে।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.