কাল রঙ্গ-উইকি ছ্যান্দা by হিলাল ফয়েজী

২০১০ সালে উইকিলিকসের অ্যাসাঞ্জ মিয়া নাকি ফেইসবুকের মিয়া 'সেরা ব্যক্তিত্ব' হবেন এই ভুবনের, সেটা নিয়ে দুনিয়াজুড়ে মধুর বিতর্ক চলছে। আপনি-আমি সবাই কখনো বলব ইনি, কখনো বলব উনি।
তথ্যপ্রযুক্তির আশ্চর্য মার্কা বিস্ময়রাজি বিগত শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ থেকেই মানবজাতির চক্ষুর ভেতর চড়কগাছ (যে গাছটি আসলে কেমন তা জানি না, চিনি না) স্থায়ীভাবে বসিয়ে রেখেছে। এতকাল জানতাম পৃথিবীর অঢেল সম্পদ সব রাজা-বাদশাদের কোষাগারে। তারপর জানলাম ব্যবসা-ব্যাপারি-কারখানা-ব্যাংক মালিকদের দরবারেই দুনিয়ার ধন-সম্পদ। হঠাৎ চড়কগাছ চড়কির মতো নেচে উঠল যখন দেখলাম শিল্পপতি-খনিমালিক-ব্যাংক-মহাজনওয়ালাদের তথ্যকনুই দিয়ে এতকালের সব ধনপতিকে 'কনি্ন' মেরে ধন্যি ধন্যি হয়ে গেছেন মাইক্রোসফট তথ্যপ্রযুক্তিশিল্পের অধিপতি বিল গেটস। পৃথিবী বহুকাল ধরে 'বিল-বিল' করেছে। একদিকে বিল ক্লিনটন, আরেক দিকে বিল গেটস।
তথ্যপ্রযুক্তির রাজ্যে একের পর এক আবিষ্কার। যোগাযোগের ক্ষেত্রে কী যে উল্টাপাল্টা তেলেসমাতি মাতামাতি কাণ্ড। কানাডার আলবার্টায় মাইনাস ৪০ ডিগ্রি থেকে সন্তান কথা বলছে বাংলাদেশের প্লাস ২০ ডিগ্রি প্রান্তরে প্রায়ান্ধ বাবার সঙ্গে। বাবা লাঠি দিয়ে অনুমানে পথ হাঁটছেন, কথা বলছেন, এমন দৃশ্য গত সপ্তাহে নিজে দেখে এসেছি টেঙ্গারচর নামক এক বঙ্গপ্রান্তরে। এখন বঙ্গদেশজুড়ে গ্রামগঞ্জে ইন্টারনেটযোগে ওয়েবক্যামে দূরপ্রবাসী সন্তানকে দেখে দেখে কথা বলছেন মা-বাবা। যে মুহূর্তে টেন্ডুলকার পঞ্চাশতম সেঞ্চুরির শটটি মারলেন দক্ষিণ আফ্রিকায়, দক্ষিণ বাংলার কোনাকানচির দ্বীপভূমিতে বসে সেই মুহূর্তে তা উপভোগ করার আনন্দে সাজল ভুবন বাগান। আমরা ঘুম থেকে ওঠার আগেই বিশ্ববাঙালিদের বাংলাদেশের পত্রিকা পড়া শেষ ওয়েব-ল্যান্ডস্কেপে। নালিতাবাড়ী সীমান্তে বন্ধুবর যখন গুগলস ম্যাপে বনভূমিতে আমাদের অবস্থান জানিয়ে দিচ্ছিলেন আইফোনে, তখন ভাবি, যাই কোথায়! 'চমক' শব্দটি নিজেই 'চমকিত' হচ্ছে প্রতিদিন।
অর্ধশতাব্দী ধরেই জোরেশোরে শুনছি, একালের পারমাণবিক অস্ত্র হচ্ছে 'তথ্যকাল'। যে দেশের ভাণ্ডারে যত তথ্য তার হাতেই উন্নয়নের সব উপাত্ত, সব পথ্য। অতএব সব দেশেরই রণসংগীত হয়ে গেল, 'যেখানে যাও, তথ্য জোগাও, তথ্য কুড়াও।' সব তথ্য-ছাইয়ে পাবে মানিক-রতন। এভাবে তথ্যভাণ্ডারী হয়ে দপাদপ এগিয়ে গেল সিঙ্গাপুর, ভারত, গণচীন আরো কত দেশ। এদিকে তথ্যমহাভাণ্ডারী মার্কিনওয়ালাদের পায় কে! পৃথিবীতে প্রতি মুহূর্তে মিলিয়ন-বিলিয়ন ই-মেইল চালাচালি হয়। প্রায় সব দেশের ই-মেইল প্রথমে মার্কিন ভাণ্ডারে জমা হয়ে পরে গন্তব্যে পেঁৗছে। উপগ্রহের মালিকানায় এই নব তথ্য-বিগ্রহে পরিণত হয়েছে তথ্যসুপার মহাজন। পারমাণবিক অস্ত্র আর তথ্য ব্রহ্মাস্ত্র হাতে পৃথিবীর এক নম্বর আসনটি ধরে রাখতে পাগলপারা ওরা।
কার্ল মার্কস একদা এ রকমটা বলেছিলেন, কারখানা মালিকরা নিজেদের প্রয়োজনেই 'শ্রমিক-প্রতিপক্ষকে' নিজেদের কারখানায় পুঁজিবাদের 'গোর-খোদক' হিসেবে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়। তা মার্কস মহোদয়ের কথাটি কালের ধোপে কতটুকু টিকবে, সেটা দেখার সময় তো শেষ হয়ে যায়নি। কিন্তু পুঁজিবাদী দুনিয়ায় তথ্য চড়কবাজির এই মহারমরমা যুগে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকের অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ থেকে এক খুদে পুঁচকে 'অ্যাসাঞ্জ' নামের এক ছাওয়াল যে পুঁজিবাদী তথ্য মোড়লকে এমন গ্যাঁড়াকলে ফেলে দেবে সেটা কোনো মহাজন কি ভাবতে পেরেছিলেন? ২০১০ সালটিতে দুটি শূন্য অক্ষরের ছিদ্র বা লিক। উইকি শব্দটি ইংরেজি 'কুইক' শব্দের অপভ্রংশ। সেই উইকি শব্দের মধ্য থেকে ছিদ্রসহযোগে হঠাৎ এমন দুনিয়া কাঁপানো তোলপাড় ঘটে যাবে, এমনটা সত্যিই অভাবনীয়।
ছিদ্র শব্দটিরই বঙ্গীয় লোকজ নামটি হচ্ছে 'ছ্যান্দা'। তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে। তা গোকুলে যে 'অ্যাসাঞ্জ' মিয়ারা বেড়ে উঠছিল, সে সংবাদ পেলেও বুঝি তেমন পাত্তা দেয়নি মার্কিন মোড়লরা, এখন হাড়ে হাড়ে অস্থিমজ্জায়, রক্তকণিকায়, দেহলতিকায়_সব মিলিয়ে অনুভব করছে তথ্য মহাপুঁজিপতি মার্কিনি-কত্তা-জনাব-বেগমরা, যে তীর অ্যাসাঞ্জ তাঁর উইকি-ছ্যান্দা দিয়ে ছুড়ে ফেলেছেন, তা ফিরিয়ে নেওয়ার 'ক্ষ্যাম' এবং 'ক্ষ্যামতা' যে স্বয়ং অ্যাসাঞ্জেরও নেই। পৃথিবীর বহু নামি প্রতিষ্ঠানের মালপানির সমর্থনে অ্যাসাঞ্জ ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা মাটির নিচে সুরক্ষিতভাবে গড়ে তুলেছে বিশাল কূটনৈতিক তথ্যভাণ্ডার। কূটনীতির অপর নাম যে চার 'ভ' অর্থাৎ 'ভণিতা-ভড়ং-ভণ্ডামি-ভোগলামি', তা তো ভালোই জানা সবার। বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে বিশ্বজুড়ে মিষ্টি বচনের সঙ্গে দুষ্টামি-নষ্টামি-ভ্রষ্টামির মিশ্রণে বিশ্ব-মাতব্বরির এক উপাচার তৈরি করেছে তা লা-জবাব। আর ঠিক এখানটিতেই উপযুক্ত জবাব দিয়েছেন ব্যক্তিপর্যায়ের অসাধারণ মগজওয়ালা তথ্য নবাব আমাদের অ্যাসাঞ্জ সাহেব। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পৃথিবীর নানা মার্কিন দূতাবাসে থেকে প্রাপ্ত চিঠিপত্রের এক অজানা ভাণ্ডার তিনি উন্মোচন করে অবাক করে দিয়েছেন মার্কিনি পক্ষ-বিপক্ষ সবাইকেই। মার্কিনিরা ওপরে কী বলে, পেছনে কী করে তার হাজার নমুনা এখন উইকি-ছ্যান্দার ভেতর দিয়ে বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করল।
অতএব গোকুল-অ্যাসাঞ্জকেই বধ করার ব্রত নিয়েছে মার্কিনি মোড়লরা। বিল ক্লিনটন-আল গোর কোনো প্রকার 'নষ্টামি' করলে এটা হয় লীলা, আর অ্যাসাঞ্জ তেমন কিছু না করলেও সে এখন 'মহা-অপরাধী' বটে। কিন্তু মানুষ বসে নেই। অ্যাসাঞ্জের পাশে এখন পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ। এখন বিশ্বভোট হোক। অ্যাসাঞ্জ পাবেন বিলিয়ন বিলিয়ন ভোট, ওবামা-হিলারি পাবেন গোল্লা।
উইকি-ছ্যান্দা হোক আগামী পৃথিবীর তথ্য-মুক্তিযুদ্ধের প্রধান বাহন। পৃথিবীজুড়ে, দেশে-দেশে, সমাজে, প্রতিষ্ঠানে, পরিবারে, ঘরে-ঘরে সচেতন-অসচেতন যত অন্যায় সাধিত হচ্ছে উইকি-ছ্যান্দা দিয়ে বের হোক তার সব তথ্য। যে আমি পাকিস্তানি খানসেনাদের যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র ধরি, সে আমি যখন কর্মক্ষেত্রে নিজেই যৌন হয়রানি বরদাশত করি, এমন ভণ্ডামির দিন যে ফুরিয়ে আসছে। যে আমি বাঙালিদের অধিকার রক্ষা করতে আত্মদানে ব্রতী হই একাত্তরে, সে আমি পাহাড়িদের অধিকারের বিরুদ্ধে দাঁড়াই কিভাবে! উইকি-ছ্যান্দা দিয়ে বের হোক যাবতীয় গোপন তথ্য। তাতেই বেরিয়ে পড়বে পৃথিবীজুড়ে ডান-বাম-মধ্যশক্তির বড় ঘোড়েলদের কথা ও কাজের যাবতীয় অসংগতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মহান শিক্ষকরা, মিডিয়া মহাজনরা, সুশীল মহারাজরা সামান্য সুযোগের জন্য কিভাবে ন্যায়নীতি গুলিয়ে সেবন করেন, তার হাজার নমুনা বেরিয়ে আসুক নব নব উইকি-ছ্যান্দা দিয়ে।

লেখক : রম্য লেখক

No comments

Powered by Blogger.