কথা সামান্যই-কেউ কিন্তু কারণ বলছে না by ফজলুল আলম

আরো একটি বছর শেষ হলো- কলামিস্ট সম্পাদকের দল উঠেপড়ে সর্বত্র বিগত বছরের ঘটনাবলি পর্যালোচনা করছেন, শুধু মন্দটি নয়, ভালো ঘটনার কথাও বলছেন।
কিন্তু সর্বত্র একই কথা পুনরাবৃত্তি হচ্ছে, শেয়ারবাজার পতন, পদ্মা সেতু বিপর্যয়, গার্মেন্টে অগ্নিকাণ্ড, রামুতে বৌদ্ধদের ওপর সহিংসতা, সংবিধান সংশোধন, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ও অন্যান্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, মিটারবিহীন ট্যাক্সি রিকশা ভাড়া বৃদ্ধি, যানজট বৃদ্ধি, তেল-গ্যাস লুণ্ঠনের অভিযোগ, দারিদ্র্য সম্পর্কে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য- এসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে সুখবর যে আমাদের ডলার রিজার্ভ বিশাল আকার ধারণ করেছে, জিডিপি বাড়ছে, শিশুমৃত্যু ও প্রসূতি মৃত্যুর হার কমে গেছে, গার্মেন্টে আমরা এখনো শীর্ষে, বেকারত্ব বাড়ছে, দুর্নীতি বাড়ছে, সরকার-বিরোধী দলে অস্থিরতা বাড়ছে ... আর বলে লাভ নেই। এ বিষয়গুলো স্কুলের কাজের মতো সংক্ষেপে বর্ণনা করার দরকারটি কেন হলো? যাতে আগামীতে 'মন্দ' কাজগুলো ফিরে না আসে। তাই কি? নাকি পত্রিকা গ্রহণ করে বলে কিছু তৎপর লেখক লিখে যাচ্ছেন তাঁদের অনেকের ব্যাকগ্রাউন্ড কী, সেটা কিন্তু পাঠক জানে এবং তাদের কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ হাসির খোরাক জোগায়। একটা পত্রিকা বছরখানেক হলো 'বদলে যাও, বদলে দাও' বলে স্লোগান দিচ্ছে, অনেকে হয়তো বদলেছেন, দুই দিকেই- ভালোর দিকে এবং মন্দের দিকে।
রাস্তার পাশে চায়ের স্টলে বা ফুটপাতে বসে আড্ডা দেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বদাই বিভিন্ন পর্যালোচনা চলছে, সে জন্য পত্রিকা পড়ার দরকার নেই। সমস্যা হচ্ছে, এত পর্যালোচনার পরও এসবের কারণ, কেন এমন হয়েছিল তা কেউ নির্ধারণ করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। অথচ যথাযথ কারণ বা মূল সমস্যা না জানলে যে সমাধানের পথ বাতলানো যায় না, তা সবাই জানি। কারণ নির্ধারণ করতে না পারার পেছনে কারণ আছে- হয় অজ্ঞতা অথবা ইচ্ছা। অন্য এক ব্যাখ্যায় এই দুটির কোনোটাই নয়। আমরা ফলাফলকে কারণ হিসেবে দেখি। এক ব্যক্তি যখন খুন করে বা একজন রাজনৈতিক নেতা যখন কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তখন আমরা সেসবের উদ্দেশ্য খুঁজে যা পাই সেসব উদ্দেশ্যকে কারণ বলি; কিন্তু সেসব আসলেই অন্য কোনো কারণের ফলাফল। এই 'অন্য কোনো কারণ'কে প্রাধান্য দেওয়া সব সময় বুদ্ধিমানের কাজ নয়। পৃথিবী চলে ক্ষমতার ওপরে। এক এক সময় এক এক অবস্থানে থাকা ব্যক্তি, ব্যক্তিরা বা মতাতত্ত্ব ক্ষমতা নিয়ে থাকে। তাদের বা সেসবের পেছনেও অন্য কারণ থাকে। মানুষকে তাদের বা সেসবের প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করতে বাধ্য করা হয়। তাদের সুবিধার জন্য 'শিক্ষক, মনুষ্যকুলের নেতারা, ধর্মবিশেষজ্ঞসহ সবাই অধঃপতিত ও ক্ষয়িষ্ণু সেখান থেকে সব মূল্যবোধ জীবনের প্রতিকূল করে তোলা হয়, সেখান থেকে নৈতিকতার সংজ্ঞা নির্ণীত হয়...' (নীৎসে ১৯০৮, বাংলা অনুবাদ ২০১১, আমাকে চিনতে হলে : পৃ-৭৪)। এটাই বিশ্বব্যবস্থা এবং এই সত্যকে বেশ কয়েকবার চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল; কিন্তু ক্ষমতাধারীরা নানাভাবে তাদের পরাজিত করে। এমন নয় যে এই ক্ষমতাধারীরা বোঝেন না তাদের পরিকল্পিত বিশ্বব্যবস্থার বিকল্পব্যবস্থা মনুষ্যকুলের জন্য শ্রেয়; কিন্তু এতে ব্যক্তি সার্থপরতা রক্ষা করা সম্ভব নয়, বিশেষত একটি বা কয়েকটি শ্রেণীর জন্য। ইতিহাস সেটাই সাক্ষ্য দেয়। লুণ্ঠনকারী, সাম্রাজ্যবিস্তারকারী, উপনিবেশ স্থাপনকারী, অর্থনৈতিকভাবে অন্যদের অবদমিত করে রাখা শক্তি- এরাই পৃথিবীর আইনকানুন, রীতিনীতি, মনুষ্যকুলের ব্যবহার, আহার বিহার সবই নিয়ন্ত্রণে রাখে। তাদের প্রয়োজনমতো বিশ্বব্যবস্থা তৈরি হয়। এমন নয় যে সেই ব্যবস্থায় বিশ্বের সব দেশ বিপাকে পড়বে। ক্ষমতাসীন ও শক্তিশালী রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় এবং তাদের পরিকল্পনায় অনেক দেশই উন্নতি করতে পারে। আমরাও পারি, কিন্তু পারছি না। তার কারণ খুঁজে বের করা এমন কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু সমস্যা নিরূপণের পরে আর আমাদের কিছু করার ক্ষমতা নেই। আমাদের মতো বিশ্বের আরো দেশ আছে যারা একই অবস্থায়।
বিশিষ্ট কলামিস্ট ও লেখকরা বিগত বছরের পরিক্রমা যা করেছেন, তাতে ভালো-মন্দ দুই-ই আছে; কিন্তু আমি যে কয়েকটি লেখা পড়েছি সেসবে সমাধানের প্রচেষ্টা খুব একটা উপযোগী মনে হয়নি। প্রায় সবাই আইনের শাসনের কথা, নাগরিক অধিকারের কথা, সরকারের দায়ের কথা, বিরোধী দলের দায়িত্বের কথা বলেছেন। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান লিখেছেন (কালের কণ্ঠ ১/১/১৩), 'নিছক অর্থনৈতিক অস্তিত্বের তাগিদে আত্মরক্ষার চেতনায় মানুষ স্বীয় ক্ষমতায়নে ও উন্নতিকল্পে মোড় ফেরাতে বদ্ধপরিকর হলে সে হবে এক বড় আশার কথা।' কথাটি পরিষ্কার হলো না, কারণ এই মানুষগুলো অবদমিত আছে এবং তাদের 'অর্থনৈতিক অস্তিত্বে'র জন্যই তারা রাষ্ট্রের প্রচলিত অব্যবস্থায় গা ভাসিয়ে নিজেদের 'ক্ষমতায়নে' কিছু বা অনেক কাজ করে- এই কাজগুলোর অপর নাম অপকর্ম। যেমন- দুর্নীতি, আইন না মানা, দুষ্কর্মে নিয়োজিত হওয়া, ঘুষ দিয়ে বা নিয়ে কাজ আদায় করা। রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন করা যাবে না বলে এই অপকর্মগুলো রাষ্ট্র চোখ বুজে দেখে। রাষ্ট্র জানে যে জনগণের অর্থনৈতিক সংস্থান তারা করে দেবে না। আইনের শাসনের কথা বেশি বেশি বলা হয়। আজ যে মিটার ছাড়া সিএনজি অটোরিকশা ও ট্যাক্সি চলছে তার কারণও ওই 'অর্থনৈতিক অস্তিত্বের তাগিদ', পুলিশও এসব অনিয়মে তাদের অর্থনৈতিক প্রয়োজন (ক্ষমতায়ন!) করে চলছে। আইন কাদের জন্য তৈরি হয়েছে, সেটা জানতে পারলে লেখকরা 'আইনের শাসন' এনে সমস্যা সমাধানের কথা বলতেন না। আইন তৈরি হয়েছে এই সমাজে সম্পদশীল ও বিত্তবানদের সুবিধার জন্য, এখানে সাধারণ মানুষের মানবাধিকার পদদলিত হলে আইন অঙ্গুলি সঞ্চালন করবে না। কেউ কি বলেছে যে প্রাইভেট গাড়িতে প্রাকৃতিক গ্যাস দেওয়া বন্ধ করো। এই গ্যাস কি তখন আমাদের শিল্পে দেওয়া যায় না?
মূল কথাটি হচ্ছে, বিশ্বের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থার অংশীদার হয়ে আমাদের কিছু উন্নতি হলেও তা যে যথেষ্ট নয়। কিন্তু সেই ব্যবস্থার অতি ক্ষুদ্র অংশীদারি থেকে বের হয়ে আসার ক্ষমতা আমাদের প্রথমে অর্জন করতে হবে- তখনই এখনকার সমস্যাগুলো, অর্থনৈতিক সমস্যার সঙ্গে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের পথ খুলে যাবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.