কালান্তরের কড়চা-হে বন্ধু, বিদায় by আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

শোক আর যুক্তির মধ্যে সম্ভবত মাসতুতো ভাইয়ের সম্পর্ক। আমার একটি উপলব্ধি হলো, যুক্তি দিয়ে শোক উপশম করা যায় না। নিজের জীবনে বহু আত্মীয়-বন্ধুকে আমি তাদের শোকে যুক্তি দিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
যে মা হারিয়েছে, তাকে বলেছি, মা কি কারো চিরকাল থাকে? যে স্ত্রী হারিয়েছে, তাকে বলেছি, তোমার আগে তিনি চলে গেলেন, ভালোই হলো। তুমি আগে চলে গেলে তাকে বৈধব্যের যন্ত্রণা সইতে হতো।
গত ১৮ ডিসেম্বর মঙ্গলবার (২০১২) আমার স্ত্রী সেলিমা আফরোজ চৌধুরীর আকস্মিক মৃত্যুর পর আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব একই ধরনের যুক্তি তুলে আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, আমার শোক নিবারণের চেষ্টা করছেন। তাতে আমার শোক ও বিয়োগব্যথা না কমে দিন দিন আরো বাড়ছে। নিজেও যুক্তি দিয়ে নিজের মনকে প্রবোধ দিতে পারছি না। একজন মানুষের অনুপস্থিতিতে সারা পৃথিবী যে আমার কাছে শূন্য হয়ে যেতে পারে, সে অভিজ্ঞতা আগেও দু-একবার আমার হয়েছে। কিন্তু এত নিদারুণভাবে আর কখনো হয়নি।
সেলিমা আফরোজের সঙ্গে আমার বিয়ে হয় ১৯৫৮ সালে। আমাদের বিবাহিত জীবন ৫৪ বছরের। আমাদের সুস্থ বিবাহিত জীবন কেটেছে মাত্র ১৫ বছর। তার পরই তিনি আকস্মিকভাবে অসুস্থ হন। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি মেরুদণ্ডে ভাইরাস সংক্রমণে আক্রান্ত হন এবং শরীরের অর্ধাংশের বেশি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়। ডাক্তাররা বলেছিলেন, তাঁর বাঁচার আশা নেই। তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। তাঁর সহৃদয়তা ও সহায়তায় আমার স্ত্রীকে দ্রুত কলকাতায় নেওয়া সম্ভব হয়। প্রথমে কলকাতার বিড়লা হাসপাতালে (আলীপুর), তারপর পিজি হাসপাতালে (ভিক্টোরিয়া মনুমেন্টের সামনে, বর্তমানে নাম পরিবর্তিত) দীর্ঘ ১০ মাস চিকিৎসা হয়। ভারতের সেরা নিউরোলজিস্ট ড. তড়িৎ কুমার ঘোষ তাঁর জীবন রক্ষায় সক্ষম হন, কিন্তু তাঁকে পক্ষাঘাতমুক্ত করতে পারেননি।
এ অবস্থায় তাঁকে নিয়ে দেশে ফিরি। মাসখানেক পর তাঁর অবস্থার আবার অবনতি শুরু হয়। ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরী (সাবেক রাষ্ট্রপতি) তখন আমার পরিবারের সবচেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী ও চিকিৎসক। তিনি বললেন, আমার স্ত্রীর একটা বড় ধরনের অপারেশন দরকার। নইলে বছরখানেকের বেশি তাঁর জীবন রক্ষা পাবে না। আর এই অপারেশন তখন একমাত্র সম্ভব ছিল লন্ডনে।
লন্ডনে স্ত্রীর চিকিৎসা করানোর মতো আর্থিক সামর্থ্য আমার ছিল না। আমি তখন ঢাকার একটি দৈনিকের সম্পাদক এবং বঙ্গবন্ধুকে তাঁর আত্মজীবনী লেখার কাজে সাহায্য জোগাই। আমার স্ত্রীর গুরুতর অসুস্থতার খবরে বঙ্গবন্ধু একদিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের যে কেবিনে আমার স্ত্রী প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় ছিলেন, সেখানে তাঁকে দেখতে এলেন। আমার স্ত্রী তখন হাসপাতালের বেডে শায়িত। অর্ধচেতন অবস্থা। আমি তাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, বঙ্গবন্ধু তোমাকে দেখতে এসেছেন। সেলিমা, আমার স্ত্রী, বহুকষ্টে ডান হাতটা একটু তুলে সালাম জানালেন।
বঙ্গবন্ধু বহুক্ষণ তাঁর শিয়রের কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন। ডাক্তারদের সঙ্গে তাঁর চিকিৎসা সম্পর্কে আলোচনা করলেন। বিদায় নেওয়ার সময় কেবিনের বাইরে এসে আমাকে বললেন, 'আমি কলকাতায় থাকতে কবি নজরুলের পাশে শায়িত তাঁর স্ত্রী প্রমীলা নজরুলকে দেখতে গিয়েছিলাম। প্রমীলা তখন পক্ষাঘাতগ্রস্ত। তোমার স্ত্রীকে দেখে সেই ছবি আমার চোখে ভেসে উঠেছে। এখনই তোমার স্ত্রীর চিকিৎসার একটা ভালো ব্যবস্থা হওয়া দরকার। আমি আজই সব ব্যবস্থা করছি।'
পরদিনই বঙ্গবন্ধু আমাকে ডেকে পাঠালেন গণভবনে। বললেন, লন্ডনে ব্যয়বহুল চিকিৎসার খরচ জোগানো তোমার পক্ষে সম্ভব হবে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন এখন আমাদের বন্ধু। আমাদের বহু পঙ্গু, আহত মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসা তারা করছে বিনা পয়সায়। আমি আমাদের পররাষ্ট্র দপ্তরের রেজাউল করিমকে (পরবর্তীকালে ব্রিটেনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত) নির্দেশ দিয়েছি অবিলম্বে রাশিয়ায় তোমার স্ত্রীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য।
বঙ্গবন্ধু এই নির্দেশ দিয়েছিলেন। রেজাউল করিমও ঢাকায় সোভিয়েত দূতাবাসের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে কথিত লৌহ যবনিকা ভেদ করার সাধ্য আমার হয়নি। আমলাতান্ত্রিক যান্ত্রিকতা, অহমিকা ও দীর্ঘসূত্রতা কাকে বলে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের লাল আমলাতন্ত্রের চালচলন না দেখলে তা বোঝার উপায় ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়নের সব ধরনের মানবতাবোধবর্জিত আমলাতন্ত্রের লৌহ নিগড় সম্পর্কে তখন থেকেই আমার মোহভঙ্গ হতে শুরু হয়। আমার তখনই মনে হয়েছিল, মানবিক উপলব্ধিশূন্য এই পদ্ধতি বেশি দিন টিকতে পারে না।
বঙ্গবন্ধু সব কথা জানলেন। আমাকে ডেকে বললেন, রাশিয়ায় চিকিৎসার জন্য তোমার স্ত্রীকে পাঠানো অবশ্যই সম্ভব হবে। কিন্তু ওদের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা এমনই ঢিলে যে মস্কো থেকে অনুমতি আসতে আসতে তোমার স্ত্রী হয়তো চিকিৎসার ঊর্ধ্বে চলে যাবে। তুমি দ্রুত লন্ডন যাওয়ার ব্যবস্থা করো। আমি যতটা পারি সাহায্য করব।
বঙ্গবন্ধুর কথায় লন্ডনে স্ত্রীকে নিয়ে রওনা হওয়ার সাহস পেলাম। আজ কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি, সেদিন বঙ্গবন্ধু সাহস ও সাহায্য না জোগালে লন্ডনে স্ত্রীকে চিকিৎসার জন্য নেওয়ার কথা স্বপ্নেও কল্পনা করতাম না। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে (তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন নাজির আহমেদ) আমার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা প্রদানের ব্যবস্থা করার কথা জানিয়েছিলেন। অবশ্য নাজির আহমেদ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ লাভের আগেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আমার জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা বরাদ্দ করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু নিজেও আমাকে অর্থ সাহায্য করেছেন। আমি তাঁর কাছ থেকে অর্থ সাহায্য নিতে ইতঃস্তত করছি দেখে মৃদু হেসে বলেছিলেন, 'তুমি ভাবছ, আমার কাছ থেকে অর্থসাহায্য নিলে তুমি আমার কাছে দায়বদ্ধ হয়ে যাবে! রাজনৈতিক কলামিস্ট হিসেবে আমার বা আমার সরকারের আর সমালোচনা করতে পারবে না। আমি তোমাকে সেই দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তি দিচ্ছি। তুমি স্বাধীনভাবে আমার সম্পর্কে লিখবে। এই টাকা তোমাকে নয়, তোমার স্ত্রীকে দিচ্ছি। আমার ওপর তার একটা হক আছে। আমি সেই হক আদায় করছি।'
বঙ্গবন্ধুর এই কথা প্রায় ৪০ বছর আগে আমার মনে যে সাহস জুগিয়েছিল তার ফলেই সামান্য কিছু পাউন্ড (তখনো এই চিকিৎসার ব্যয়বহুলতার কথা ভাবতে পারিনি) হাতে অসুস্থ ও পঙ্গু স্ত্রীকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিতে দ্বিধা করিনি। আমার স্ত্রীর চিকিৎসায় আমার ব্যক্তিগত ও সাংবাদিক-বন্ধুদের অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন। বিস্মিত হয়ে দেখেছি, যাঁদের সঙ্গে আমার দারুণ কলমযুদ্ধ হয়েছে, তাঁদের অনেকে অযাচিতভাবে সাধ্যমতো আমাকে আর্থিক সাহায্য দানে এগিয়ে এসেছেন।
সর্বাগ্রে নাম করব প্রয়াত সাংবাদিক বন্ধু ফয়েজ আহমদের। তখনকার দিনে (সত্তরের দশকে) পাঁচ হাজার অনেক টাকা। ফয়েজ তাঁর সঞ্চয়ের এই টাকা আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, 'শেলির (আমার স্ত্রী) চিকিৎসার জন্য এই টাকাটা দিলাম। তুই না বলবি না।' আমার সাংবাদিক ও সাহিত্যিক বন্ধুদের মধ্যে ফয়েজ আহমদ, এবিএম মূসা, আলাউদ্দীন আল আজাদ, হাসান হাফিজুর রহমান, আহমেদুর রহমান, আনোয়ার জাহিদ, আজিজ মিসির- এ রকম অনেকের সঙ্গে আমার স্ত্রীর দারুণ ভালো সম্পর্ক ছিল। কলকাতাতেও পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাকালে তাঁকে দেখতে আসতেন সাহিত্যিক গৌরকিশোর ঘোষ, সাংবাদিক মানস ঘোষ (বর্তমানে দৈনিক স্টেটসম্যানের সম্পাদক), অভিতাভ চৌধুরী, সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত প্রমুখ। পশ্চিমবঙ্গের তখনকার রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী অজিত পাঁজা শুধু আমার স্ত্রীকে দেখতে আসা নয়, তাঁর সুচিকিৎসার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
ঢাকার শুভাকাঙ্ক্ষীরা মুক্তহস্তে আমার স্ত্রীর লন্ডন-চিকিৎসার জন্য নিজেরা যেচে এসে আর্থিক সাহায্য দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে দৈনিক সংবাদের প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক খায়রুল কবির, সংবাদের প্রথম প্রকাশক নাসিরউদ্দীন আহমদ, দৈনিক জনপদের ম্যানেজিং ডিরেক্টর প্রয়াত হাবিবউদ্দীন আহমদের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। আমি তখনো লন্ডন দেখিনি। লন্ডনে আসা সম্পর্কে আমার মনে একটা দারুণ ভীতি ছিল। রুগ্ণ, পঙ্গু স্ত্রীকে নিয়ে লন্ডনে একা আসব? ভয়ানক ভীতি আমাকে গ্রাস করেছিল। এই ভীতি দূর করার জন্য হাবিবউদ্দীন আহমদ লন্ডন-যাত্রায় আমাদের সঙ্গী হন। লন্ডনের ক্যাথলিক নার্সিং হোমে আমার স্ত্রীর জন্য কেবিন রিজার্ভ করেন। পরে সেন্ট থমাস হাসপাতালে তাঁকে স্থানান্তর করা হয়। ইউরোপের পাঁচজন বিখ্যাত নিউরো সার্জনের অন্যতম ডা. লয়েড ডেভিস আমার স্ত্রীর চিকিৎসার ভার গ্রহণ করেন এবং দীর্ঘ সময় অস্ত্রোপাচার করে তাঁর জীবন রক্ষার ব্যবস্থা করেন। অবশ্য তিনি তখনই বলেছিলেন, বাকি জীবনটা আমার স্ত্রীকে হুইলচেয়ারে বসেই কাটাতে হবে। প্রায় ৪০ বছর তিনি তা-ই কাটিয়ে গেছেন।
একটি কথা এখানে না লিখলে সত্য গোপন করা হবে। আমার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য এমন এক রাজনৈতিক নেতার কাছ থেকে অযাচিত সাহায্য এসেছিল, যাঁর সঙ্গে আমার রাজনৈতিক মতের ছিল দারুণ অমিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগরে থাকাকালেও তাঁর দারুণ সমালোচনা করেছি। আমার অসুস্থ স্ত্রীকে হাসপাতালে দেখার জন্য বঙ্গবন্ধু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আসার পর আরো অনেক মন্ত্রীই হাসপাতালে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদও। তিনি তখনো বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী হননি, বরং ছিলেন তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য। তিনি আমার সাংবাদিক বন্ধু ফয়েজ আহমদের মাধ্যমে পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন। তাঁর একান্ত অনুরোধে এবং বিদেশে স্ত্রীর চিকিৎসার বিরাট ব্যয়ের কথা ভেবে টাকাটা গ্রহণ করি।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে খন্দকার মোশতাক আহমদের যুক্ত থাকার কথা জেনে এই টাকা গ্রহণের জন্য মনে মনে দারুণ অনুতপ্ত হই। ক্ষমতা গ্রহণের পর সম্ভবত আমার বন্ধু তাজুল ইসলাম তাঁর প্রেসসচিব হয়েছিলেন। এই তাজুল লন্ডনে খন্দকার মোশতাকের একটি চিঠি আমাকে পাঠিয়ে দেন। সেই চিঠিতে খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে তাঁর জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে বঙ্গবন্ধুর কর্মকাণ্ডই যে তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটিয়েছে, এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন। আমি চিঠিটার একটা জবাব ঢাকায় রাষ্ট্রপতি ভবনে পাঠিয়েছিলাম। তাতে লিখেছিলাম, 'আমি যদি আগে জানতাম আপনি স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির জনককে হত্যায় এমন ঘৃণ্য ভূমিকা নেবেন, তাহলে ঘৃণার সঙ্গে আপনার আর্থিক সাহায্য প্রত্যাখ্যান করতাম। আপনার চিঠির জবাবে শুধু এটুকু জানিয়ে রাখি, এই অর্থসাহায্য দ্বারা আপনি আমার বিবেক ক্রয় করেছেন- তা ভাববেন না। আপনি শিগগিরই বাংলার দ্বিতীয় মীর জাফররূপে আখ্যাত হবেন এবং যথাযোগ্য শাস্তি পাবেন- এটাই আমার কামনা।
এই চিঠি লেখার পর আমি বঙ্গবন্ধুর হত্যা ও দেশে স্বাধীনতার শত্রুপক্ষের ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে লন্ডনভিত্তিক প্রতিরোধ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি। এরপর স্ত্রী সেলিমা আফরোজকে জানাই, আমি লন্ডনে বসে যে রাজনৈতিক ও সাংবাদিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে যাচ্ছি, তাতে দীর্ঘকাল হয়তো দেশে ফিরতে পারব না। আদৌ কোনো দিন পারব কি না জানি না। আমাদের আয়-উপার্জন লন্ডনে দীর্ঘকাল থাকার মতো নয়। পাঁচটি ছেলেমেয়ে। তার ওপর তুমি পঙ্গু। সুতরাং তোমার মত না নিয়ে কোনো কাজে এগোনো আমার উচিত নয়।
আমি বিস্মিত হয়ে তাঁর জবাব শুনেছি। সেলিমা বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময়েই তুমি যখন মুজিবনগরে চলে যাও, তখনই বলেছি, আমি তোমার সঙ্গে যাব এবং থাকব। যদি মরতে হয় একসঙ্গে মরব, বাঁচতে হলে একসঙ্গে বাঁচব। সংসারের অনিশ্চয়তার কথা ভেবে তুমি তোমার পথে চলতে পিছপা হয়ো না। আমি পঙ্গু হলেও ঠিকই সংসারের হাল ধরে রাখতে পারব। এখনো তোমার কাছে সেই একই কথা আমার।
৫৪ বছরের বিবাহিত জীবনে, এমনকি প্রায় ৪০ বছরের অসুস্থতার সময়ও তিনি তাঁর কথা রক্ষা করেছেন। আমি পাঁচ টাকা উপার্জন করলেও তিনি তা দিয়ে চমৎকারভাবে সংসার চালিয়েছেন। আবার ৫০০ টাকা উপার্জন করলেও বাহুল্য ব্যয় করেননি। সংসারের আর্থিক নিরাপত্তার ওপর জোর দিয়েছেন। আমি কোনো দিন সংসারের দিকে তাকাইনি। ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার দিকেও নজর দিইনি। রুগ্ণ ও পঙ্গু মানুষটি অবশ দেহে বিছানায় শুয়ে দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর সংসারের ঘানি টেনেছেন। আমার দিকে লক্ষ রেখেছেন। ছেলেমেয়েকে এই বিদেশে বসেও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। এর পেছনে আমার অবদান সামান্যই।
বাংলাদেশের একটি মধ্যবিত্ত ঘরের সাধারণ মেয়ে আমার স্ত্রী। তাঁর কলেজ-জীবনেই তাঁকে আমি বিয়ে করি। তাঁর মধ্যে কোনো অসাধারণত্ব দেখে বিয়ে করিনি। তাঁর বড় ভাই ড. জাকিউদ্দীন আহমদ ছিলেন আমার সহপাঠী। এ সুবাদেই সেলিমার পরিবারের সঙ্গে আমার পরিচয় ও পরিণয়। একজন গৃহবধূর ভূমিকা গ্রহণ ছাড়া তিনি আমার সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জীবনে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করবেন, তা আশা করিনি, কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পরই আমার এ ভুল ভেঙেছে। বিয়ের পর একদিন ঢাকার নিউ মার্কেটে বেড়াতে গেছি। তখন নিউ মার্কেটে নলেজ হোম নামে একটি বইয়ের দোকান ছিল, দেশি-বিদেশি সব রকম ভালো বইয়ের কেন্দ্র। নরেন্দ্রনাথ মিত্র ছিলেন আমার স্ত্রীর প্রিয় লেখক। তাঁর একটা বই কিনতে গিয়ে তিনি আমাকে বললেন, আমি আরেকটা বই কিনতে চাই। বইটি রোমা রোঁলার 'জাঁ ক্রিস্তফ' নামক তিন খণ্ডের উপন্যাসের বাংলা অনুবাদ।
তাঁর মধ্যে সাহিত্যের নেশা ছিল, তা আমি জানতাম না। ইউরোপের নামি লেখকদের লেখার বাংলা অনুবাদ তিনি পড়তেন। বিলাতে কিছুকাল থাকার পর পশ্চিমা লেখকদের মূল ইংরেজি লেখাই তিনি পড়তে শুরু করেন। কলকাতার 'দেশ' পত্রিকাটি ছিল তাঁর প্রিয় কাগজ। সাংবাদিকতাতেও আমাকে সাহায্য জুগিয়েছেন তিনি। শুধু আমার লেখার কাটিং রাখা নয়, লিখতে বসলে নানা রকম ইনফরমেশন জোগাতেন, নানা সাজেশন দিতেন। আর লেখার প্রতিটি বিরতিতে এক কাপ করে চা। হুইলচেয়ারে বসেই তিনি আমার জন্য রান্না করতেন, চা বানাতেন, অতিথিদের আপ্যায়ন করতেন। সেলিমা আফরোজ ছিলেন আমার স্ত্রী, সচিব ও সখা। আজ তাঁকে হারিয়ে এক মহাশূন্যতার অন্ধকার আমাকে ঘিরে ধরেছে।
তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সততার অনেক উদাহরণের মধ্যে একটি এখানে উল্লেখ করছি। আমাদের বিয়ে হয় ১৯৫৮ সালে আইয়ুবের সামরিক শাসন শুরুর জমানায়। তখন আমি 'ইত্তেফাকে' চাকরি করি। মাসে বেতন ২৫০ টাকা। দৈন্যদশার মধ্যে দিন কাটে। বিয়ে করে স্বামীবাগে যে ভাড়া বাড়িতে উঠি, সেটিতে ইলেকট্রিসিটি ছিল একটি ঘরে। কুয়োর পানিতে সব কাজ সারতে হতো। এ সময় একটি চাকরির অফার এলো, যা সামরিক শাসনের কর্মকাণ্ডের পাবলিসিটির সঙ্গে যুক্ত। বেতন ৪০০ টাকা। কিন্তু চাকরিটি গ্রহণে সেলিমা আমাকে সম্মতি দিলেন না। বললেন, 'এই চাকরি নিলে আমাদের সচ্ছলতা হয়তো একটু বাড়বে, কিন্তু তুমি মনে শান্তি পাবে না। কারণ তোমার একটা রাজনৈতিক কনভিকশন আছে। আর আমি তো তোমার কাছে কখনো শাড়ি-গয়না চাইনি। এই জীবনই তো মেনে নিয়েছি।' আর সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের ৫৪ বছরের বিবাহিত জীবনে তিনি আমার কাছে কখনো শাড়ি-গয়না চাননি। দারিদ্র্যের সঙ্গে সারা জীবন যুদ্ধ করেছেন। আমাকে সুযোগ ও সুবিধার দিকে হাত বাড়াতে দেননি।
অতিশয়োক্তি করব না, এমন প্রচারবিমুখ নারী আমি আর বেশি দেখিনি। আমার স্ত্রী হিসেবে সেলিমা মিডিয়ার সামনে, এমনকি ক্যামেরার সামনেও দাঁড়াতে চাইতেন না। কোনো টিভি বা সংবাদপত্র অনুরোধ করলে তাঁর জবাব ছিল, 'আমি সাধারণ একজন নারী। আমার নিজের বলার কিছু নেই। আমাকে নিয়েও বলার কিছু নেই।' আমাকে দেখিয়ে বলতেন, কিছু লিখতে হয়, ওকে নিয়ে লিখুন।
আমার পাঁচ সন্তানের তিনি ছিলেন গর্বিত জননী। দুর্দিনে আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু, সুদিনে সুপরামর্শদাতা। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধে তাঁকে কখনো ভীত হতে দেখিনি। সংসারের সব দায়িত্ব ফেলে রেখে সাহিত্য ও রাজনৈতিক লেখা নিয়ে মত্ত থাকা বা আমার দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানোতেও তিনি কখনো বাধা দেননি; তাতে তাঁর যত অসুবিধাই হোক। কেমন করে বলব, এই নারী ছিলেন একজন সাধারণ নারী? তাহলে অসাধারণ নারী কাকে বলে? বঙ্গবন্ধু আমাদের বলতেন, 'তোমাদের ভাবিকে স্ত্রী হিসেবে না পেলে, আমি মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠতে পারতাম না।' এ কথা আমার বেলায়ও সত্য। সেলিমা আফরোজকে স্ত্রী হিসেবে না পেলে আমিও আজকের সাহিত্যিক ও কলামিস্ট হয়ে উঠতে পারতাম না।
প্রায় ৪০ বছর আগে দুরারোগ্য ব্যাধিতে যাঁর মৃত্যু হওয়ার কথা ছিল, তিনি আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন, তবে ৪০ বছর পর আমাকে জীবনে প্রতিষ্ঠা দান করে। ছেলেমেয়েদেরও জীবনে অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত দেখে গেছেন। ৪০ বছর আগে চলে গেলে আমার গোটা জীবন ছারখার হয়ে যেত। ছেলেমেয়েদের কী হতো জানি না। আজ তাঁর অভাব ও অনুপস্থিতিতে যে মহাশূন্যতা আমাকে গ্রাস করেছে, তা থেকেও আমার আর মুক্তি আছে কি না জানি না।
এটা কি কাকতালীয় ঘটনা! প্রায় ৪০ বছর আগে আমার মৃত্যুন্মুখ স্ত্রীর জীবন রক্ষা ও চিকিৎসার জন্য তাঁকে বিদেশে পাঠাতে বঙ্গবন্ধু সাহায্য দানে এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁর রোগশয্যায় শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। কী বিস্ময়ের কথা! দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর পর আমার স্ত্রী লন্ডনের হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় শায়িত জেনে সর্বাগ্রে ছুটে এসেছিলেন শেখ রেহানা। তারপর সাহায্য দানে এগিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমার স্ত্রীর শেষ চিকিৎসা ও দেশে তাঁর মৃতদেহ ফিরিয়ে নিয়ে মিরপুরের বুদ্ধিজীবী গোরস্তানে তাঁকে মর্যাদার সঙ্গে দাফনের সব ব্যবস্থা করেছেন তিনি। আমি কী করে এই কৃতজ্ঞতার ঋণ পরিশোধ করব? প্রায় ৪০ বছর আগে ঢাকা হাসপাতালে আমার রুগ্ণ স্ত্রীর বেডের পাশে দাঁড়ানো দেখেছি বঙ্গবন্ধুকে। আর প্রায় ৪০ বছর পর লন্ডনের হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় শায়িত আমার স্ত্রীর পাশে অজিফা পাঠরত অবস্থায় দেখেছি শেখ রেহানাকে। তাঁকে আমি মা বলে ডাকি। আমার শোকার্ত ছেলেমেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেহানা সান্ত্বনা দিয়েছেন।
জীবনের এই চরম দুঃসময়ে আরো অনেকের সাহায্য, সান্ত্বনা ও সহযোগিতা পেয়েছি। তাঁদের কথা পরে লিখব। আজ শুধু এটুকুই বলব, ১৮ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার আমি শুধু আমার স্ত্রীকেই হারাইনি, হারিয়েছি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ বন্ধুকে। লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজ হাসপাতালে তাঁকে মৃত ঘোষণার পর তাঁর কপালে শেষ চুমু খেয়ে বলেছি,
'তোমাকে যা দিয়েছিনু, সে তোমারই দান,
গ্রহণ করেছ যত, ঋণী তত করেছ আমায়
হে বন্ধু, বিদায়।'
লন্ডন, ৬ জানুয়ারি, রবিবার, ২০১৩

No comments

Powered by Blogger.