ব্রিক এখনও শীর্ষে by এমদাদ হোসেন ভূঁইয়া

বিশ্ব অর্থনীতির অঙ্গনে একটি নতুন অর্থনৈতিক জোট 'ব্রিক'-এর নাম এখন বহুল আলোচিত। চারটি দেশের ইংরেজি নামের আদ্য অৰর নিয়ে 'ব্রিক' শব্দটি গঠিত। দেশগুলো হচ্ছে_ ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া (ভারত) এবং চীন।
আজ থেকে আট বছর আগে এটি ছিল শুধু একটি ধারণা, কিন্তু আজ তা বাসত্মব। সাংবাদিক জিন ও' নীল লিখেছেন, লেহম্যান ব্রাদার্স-এর পতনের আগ পর্যনত্ম আমাদের মনে হতো একটি অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়ে 'ব্রিক' তত্ত্বের একটি পরীৰা হয়ে যাওয়া উচিত। এবার বোধ হয় সেই সুযোগটি পাওয়া গেল। আর তা সম্ভব হলো সদ্য কাটিয়ে ওঠা বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়ে। 'ব্রিক' এই মন্দা খুব সাফল্যের সঙ্গেই উতড়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ২০২৭ সাল নাগাদ, 'ব্রিক'-এর সম্মিলিত জিডিপি 'জি-৭'-এর জিডিপিকে ছাড়িয়ে যাবে এবং এটা ঘটবে পূর্ব নির্ধারিত সময়ের দশ বছর আগে। প্রশ্ন দাঁড়াতে পারে, তাহলে এই অর্থনৈতিক মন্দা 'ব্রিক'-এর জন্য ভাল হলো কি করে?
এই প্রশ্নের উত্তর এবার দেয়া যেতে পারে। চীনের কথাই ধরা যাক। দেশটি তার আগের রফতানি নীতির খোলনলচে পাল্টে ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় অর্থনীতির দুর্বল দিকগুলো পর্যালোচনার মাধ্যমে চীন নিজেকে শুধরে নিয়েছে এবং বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির মাত্রা অনত্মত ৮ শতাংশ ধরে রাখার লৰ্যমাত্রা স্থির করছে। তবে লৰ্যমাত্রা থাকবে তার চেয়ে বেশি। এ জন্য শিল্প উৎপাদন বাড়াতে প্রণোদনা প্যাকেজও ঘোষণা করেছে। যা খুব সুন্দরভাবে কাজ করছে। চীন দু'নম্বর অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে জাপানকে ছাড়িয়ে যাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ধারণা করা হচ্ছে, চীন ১৭ বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে।

বিগত অর্থনৈতিক মন্দায়, যার রেশ এখনও চলছে, ব্রাজিলেও সঙ্কট হয়েছে। পণ্যের দাম কমে যাওয়ার পরও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে কোন আতঙ্ক দেখা দেয়নি। ২০০১ সালে ৰমতায় আসা প্রেসিডেন্ট লুলা ডি সিলভাও বিপর্যয় থেকে বেঁচে যান। স্বল্পমাত্রার মুদ্রাস্ফীতি একটি নতুন বাসত্মবতা হলেও বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ বিরাজ করছে। এখন ৰমতার পালাবদলে লুলা বিদায় নিলেও ব্রাজিল পাঁচ শতাংশ বার্ষিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে।
ভারতও অর্থনৈতিক মন্দায় শিকার হয়েছিল আবার এটাও সত্য। কে ভেবেছিল যে, বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক এই দেশটি মন্দার বছরেও ৬ শতাংশ কিংবা তার চেয়েও বেশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে? কিন্তু বাসত্মবে তাই হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের চেয়েও বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে ভারত। ঐতিহাসিকভাবে ভারতের সবচেয়ে গুরম্নত্বপূর্ণ বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। গত মে মাসের নির্বাচনে ডক্টর মনমোহন সিং বিজয়ী হওয়ার পর নতুন নীতিনির্ধারকরা আবার নড়েচড়ে বসেন। ভারত যদি তার অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং নীতি গ্রহণের প্রক্রিয়া সহজতর করে, তাহলে পরবতর্ী দশকের মধ্যে চীনের মতো প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে।
ব্রিক-এর আরেক সফল সদস্য রাশিয়া। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা এবং তেলের মূল্য দ্রম্নত পড়ে যাওয়ায় রাশিয়ার পণ্য নির্ভরতা শুধু বেড়ে যায়নি, বাসত্মবতা হচ্ছে অর্থ এবং ৰমতার বেশিরভাগই গুটিকয় ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে যায়। দীর্ঘমেয়াদে প্রবৃদ্ধির উচ্চ হার ধরে রাখতে হলে রাশিয়াকে অবশ্যই জনসংখ্যা পড়ে যাওয়ার হার ঠেকাতে হবে, আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ব্যবসায়ীরা উৎসাহিত হয় এবং অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে।
উদীয়মান অন্যন্য অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর অবস্থা এখন খতিয়ে দেখা যাক। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই আসে 'এন১১' বা 'নেকস্ট১১' নামে সম্ভাবনাময় একটি অর্থনৈতিক জোটের কথা। এই জোটের অনেকেই মগস্নাজনিত সঙ্কট সাফল্যের সঙ্গে কাটিয়ে উঠেছে। এশিয়ার অন্যতম জনবাহুল দেশ ইন্দোনেশিয়া খুব সাফল্যের সঙ্গে সঙ্কট মোকাবেলা করেছে। কেউ কেউ মনে করেন ইন্দোনেশিয়ার অর্থনৈতিক সম্ভাবনা 'ব্রিক' ভূক্ত যে কোন সদস্যের চেয়ে উজ্জল। জিম ও নীল মনে করেন, দেশের অভ্যনত্মরে সুশাসন নিশ্চিত করে উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেকে জাহির করতে দেশটির আরও সময় লাগবে। তবে সম্ভাবনা উৎসাহ ব্যঞ্জক।
মেক্সিকো, নাইজোরিয়া এবং তুরস্কের মধ্যেও অথনৈতিক সম্ভাবনা উজ্জল। তুরস্কের পরিশ্রমী জনশক্তি এবং ভৌগলিক অবস্থান এৰেত্রে ইতিবাচক আবদান রাখবে। দেশটি প্রাচ্য এবং পাশ্চাতের মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ করছে।
মেক্সিকো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশটির রয়েছে কর্মৰম বিশাল জনশক্তি। কখনও কখনও মনে হয়। দেশটি ব্রিকের তালিকায় অনত্মভূক্ত হওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু দেশটি উৎপাদন খাতে আশানুরূপ অগ্রগতি দেখাতে পারছে না, তেল রাজস্বের উপর নির্ভরতা বেশি। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী হওয়ার কারণে নেতিবাচক কোন প্রভাব রয়েছে কি না তা-ও বোঝা যাচ্ছে না। প্রাকৃতিক সম্পদ সমৃদ্ধ নাইজেরিয়া তার অর্থনৈতিক শাক্রকে ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলে উঠে আমার সম্ভাবনা খুবই উজ্জল। আফ্রিকার সবচেয়ে জনবাহুল এই দেশটির সম্ভাবনাময় বাজারের আয়তন দৰিণ অফ্রিকার চেয়ে চারগুণ বড়।
এসব উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তিগুলো সদি সত্যি সত্যিই উঠে আসতে পারে তাহলে বিশ্বের অর্থনৈতিক চেহারা কেমন দাড়াবে? তবে প্রথম এবং প্রধান শত হচ্ছে সব রকমের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, অনুকূল পরিবেশ এবং সংঘাত মুক্ত বিশ্ব। যে কারণে 'জি২০'-এর উত্থান সহজ হয়েছে। এটি এখন সংঘাত প্রশসনের একটি ৰেত্র হিসেবে ভূমিকা রাখছে। যাহোক, উদীয়মান অথনৈতিক শক্তিগুরোর সামনে যে অনেকগুলো বাধা এবং ঝুকি রয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। যেমন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে দেখা যায়। বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে পরিচিত দেশগুলোতে বিরাজ করছে উদার গণতান্ত্রিক পরিবেশ। প্রশ্ন দাড়ায়, চীন যদি ভবিষ্যতে তার রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন আনে, তাহলে পরিস্থিতিটা কেমন হবে? তবে এটা নিশ্চিত যে, যেখানে পশ্চিনা ধারার গণতন্ত্র আসবে না। তাহলে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ চীনকে আনত্মর্জাতিক অঙ্গনে একজন অংশীদার হিসেবে কীভাবে গ্রহণ করবে; বা মানিয়ে নেবে, সেটা একটা প্রশ্ন। নতুন অর্থনৈতিক মোট 'ব্রিক' কি তাদের পাশে থাকবে? আরও কথা আছে। যেমন, চীন এবং ভারতের মধ্যে রয়েছে সুদীর্ঘ অভিন্ন সীমানত্ম। দেশ দু'টির মধ্যে অতীতে যুদ্ধ হয়েছে। ভবিষ্যতেও কি আবার সংঘাত বাধতে পারে? যদি বাধে তাহলে বিশ্ব অর্থনীতির উপর এর কি প্রভাব পড়বে।
আগামী দিনে বিশ্ব অর্থনীতির চেহারা নির্ভর করছে এসব প্রশ্নের উত্তরের উপর। আবার অনেকে এটাও মনে করেন যে, চীন একসময় তার মুদ্রা এবং পুজির উপর নিয়ন্ত্রণকে আলগা করে দেবে, এটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। অর্থনীতিবিদ ও'নীল নিজেও এমনটাই মনে করেন। তিনি বলেন, সাম্প্রতিককালৈ এশিয়া সফরকালে দেখা গেছে। পুঁজির উপর বর্তমান নিয়ন্ত্রণ চীন এবং ভারতকে মন্দা উত্তরণে সহায়তা করেছে। উভয় দেশের নীতিনির্ধারকরাই একটা বিষয়ে অত্যনত্ম সন্তুষ্ট এবং একমত যে, সঙ্কট কাটাতে তাদের পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ ধার করতে হয়নি।
এখন ২০২০ সালের দিকে তাকানো যাক। এ মুহূর্তে চীন বিশ্বের জিডিপি প্রায় ১৫ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করছে এবং বারত করছে ৫ থেকে ১০ শতাংশের। এটা দু'দেশকেই অর্থনৈতিক আযতন বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের কাছাকাছি নিয়ে যাবে। এই পরিস্থিতি আজ অনেক পশ্চিমা নীতি নির্ধারকদের ভাবিয়ে তুলেছে। তাদেরকে এখন একপেশে চিনত্মা থেকে বেরিয়ে সার্বজনীন বিশ্ব অর্থনীতির কথা ভারতে হবে। ২০০৯ সালের এপ্রিলে জি-২০ সম্মোলনের আগে পিপলস ব্যাংক অফ চায়না গবর্নর ঝু জিয়াওচুয়ানের একটি বনত্মব্য খুবই প্রনিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, বিশ্বকে আইএমএফ সুপারিশকৃত ফমুলা ত্যাগ করতে হবে, ডলারের প্রাধান্য থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিকল্প হিসেবে ইউরের ইউয়ান কিংবা অন্য মুদ্রা যেমন ইয়েনকে ব্যবহার করা যেতে পারে, কিংবা বেছে নেয়া যেতে পারে গোল্ড বা সোনাকে। নতুন বাহমাত্রিক বিশ্ব মুদ্রা ব্যবস্থা বাণিজ্য এবং বিনিয়োগে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। গড়ে উঠবে একটি সুখী ও সমৃদ্ধ পৃথিবী।
সূত্র : নিউজউইক

No comments

Powered by Blogger.