ফ্রন্টলাইনে সিআইএ আল কায়েদা by কামরম্নল হাসান

আশির দশকের সোভিয়েত দখলদারিত্বকে পুঁজি করে তৎকালীন মার্কিন সরকার, সৌদি আরব এবং পাকিসত্মান আফগানিসত্মানের মুজাহিদদের ব্যাপকহারে অর্থ এবং অস্ত্র সাহায্য করে।
আফগানে প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিসত্মানের সামরিক শাসক জিয়াউল হক মার্কিন-সৌদির প্রত্য মদদে তখন দেশটিতে ব্যাপকহারে উগ্র ইসলামী চেতনার বীজ বপন করেন এবং উগ্র আদর্শের এই বিসত্মৃতি ঘটে সীমানত্ম অঞ্চলের বিভিন্ন দরিদ্র এলাকায়। পেট্রো ডলারের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশজুড়ে তখন সৃষ্টি করা হয় অজস্র মাদ্রাসা। মূলত আফগান যুদ্ধের মুজাহিদিন সৃষ্টি করাই ছিল এ সকল মাদ্রাসার লৰ্য। এমনকি তৎকালীন মার্কিন পত্রিকায়ও এসব মুজাহিদদের উপস্থাপন করা হতো শ্রেষ্ঠ বীর হিসেবে। আশির দশকের শেষ দিকে এই যুদ্ধের অবসান ঘটে। যুদ্ধশেষে মার্কিনীরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি হাসিলের পর এই বিপর্যসত্ম অঞ্চলটি নিয়ে আর তেমন আগ্রহ দেখায়নি। অন্যদিকে প্রতিবেশী পাকিসত্মান চিরশত্রম্ন ভারতের বিরম্নদ্ধে পর্যায়ক্রমে কাশ্মীরের স্বাধীনতাকে ইসু্য করে ব্যবহার করেছে যুদ্ধফেরত এসব মুজাহিদিনকে। কিন্তু বিপত্তি বাধে নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে। পাকিসত্মানের কিছু মালবাহী ট্রাক তখন আফগানে মুজাহিদদের হামলার শিকার হয়। এতে পাকিসত্মান সরকার আফগান পরিস্থিতি নিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। নিজের স্বার্থহাসিলের ল্যে পাকিসত্মানের গোয়েন্দা সংস্থা (আইএসআই) ঠিক তখন একটি পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠার ল্যে সৃষ্টি করে মাদ্রাসা ছাত্রদের সমন্বয়ে ঘটিত সংগঠন তালেবান। পসতুন, হাজারা, উজবেক বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী সমন্বয়ে আফগানিসত্মান। আর এই ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে পাকিসত্মানের গোয়েন্দা সংস্থা বেছে নেয় সংখ্যাগরিষ্ঠ পসতুন উপজাতি গোষ্ঠীকে। এই পসতুন জাতির নিবাস মূলত পাক-আফগান সীমানত্মের ওয়াজিরিস্থান। ভৌগোলিকভাবেও এই অঞ্চল অত্যনত্ম গুরম্নত্বপূর্ণ। পাক-আফগান এই অঞ্চলে আনুমানিক ৮ লাখ উপজাতি অধিবাসীর বসবাস। তাই এই উপজাতিকে নিজেদের মতো সাজানো এবং ব্যবহার করতে অর্থের পাশাপাশি অস্ত্র সাহায্য করে পাকিসত্মান। কুটনীতিকভাবেও তালেবানকে সমর্থন করে রাষ্ট্রটি। অন্যদিকে আরব আমিরাত এবং সৌদিআরব রাষ্ট্রীয়ভাবে তালেবানদের স্বীকৃতি প্রদান করে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী হামলার মাসখানেকের মধ্যেই মার্কিন বোমারম্ন বিমানের উপযর্ুপরি বোমা নিপে ব্যাপকহারে কোণঠাসা করে তালেবানদের। টুইন টাওয়ার হামলার তথ্য প্রমাণে ব্যর্থ মার্কিন প্রশাসন সরাসরি তখন দোষারোপ করে আল কায়েদাকে। আল কায়েদা আর তালেবান তখন একসূত্রে বাঁধা। মার্কিন হামলা এবং ন্যাটোর উপস্থিতিতে দেশটির প্রধান প্রধান শহর থেকে তালেবানরা পালিয়ে প্রতিবেশী পাকিসত্মানে আশ্রয় নেয়। মোটামুটি বিনাবাধায় তালেবানদের কোণঠাসা করে বুশ প্রশাসন। আর অন্যদিকে পাকিসত্মানের বিভিন্ন সীমানত্ম অঞ্চল কিংবা আফগান দুর্গম অঞ্চলে লুকিয়ে থেকে নিজেদের রা করে আল কায়েদা তালেবান এবং আল কায়েদা আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে ওয়াজিরিস্থান। উত্তর এবং দণি এই দুইভাগে ওয়াজিরিস্থান বিভক্ত। বিদেশী মুজাহিদীন এবং তালেবানদের কট্টর হসত্মেেপ অঞ্চলটি এখন কঠোর শরিয়া আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। পাকিসত্মানের বিগত সরকারগুলোও এই অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বিসত্মার করতে ব্যর্থ হয়। ওয়াজিরিসত্মানীরা মূলত ওয়াজির এবং মেহমুদ উপজাতিগোষ্ঠীর অনত্মভর্ুক্ত। এই জাতিগোষ্ঠীর কাছে যুদ্ধ হলো একটি চমৎকার খেলা এবং শত বছর ধরে লালন করা এই ঐতিহ্য ভাবিয়ে তুলেছে পাকিসত্মানের সেনাবাহিনী এবং মার্কিনীদের। পাকিসত্মানের এই সীমানত্ম অঞ্চলে পঞ্চাশ হাজার সৈন্য এখন অঞ্চলটিতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ব্যসত্ম। সোয়াত এবং ওয়াজিরিসত্মান এখন পাকিসত্মান রাষ্ট্রটির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। পাশাপাশি দীর্ঘ সেনা শাসনের মদদে বেড়ে ওঠা উগ্র ইসলামী দলগুলো আশ্রয় এবং মদদ দিয়ে যাচ্ছে এই তালেবানদের। যাদের উপর্যুপরি বোমা হামলায় এক বিভীষিকাময় বছর পার করল পাকিসত্মানের সরকার এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। গত ডিসেম্বরে বড়দিনে ড্রেটয়েটগামী বিমান উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা রীতিমতো হতভাগ করে দেয় প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে। ড্রেটয়েটগামী বিমানে বোমা হামলার পরিকল্পনাকারী আব্দুল মোতালেবের সঙ্গে আল কায়েদার সম্পর্ক রয়েছে। বিমানের যাত্রীদের সাহসী প্রচেষ্টার ফলে এই বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হয়েছে। অথচ মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যুক্তরাষ্ট্র এবং আরব উপদ্বীপে মার্কিন স্বার্থে আল কায়েদার হামলার পর্যাপ্ত তথ্য আগেই পেয়েছিল। তবে তারা এসব তথ্য কাজে লাগাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে ইয়েমেন এবং সোমালিয়ার সামপ্রতিক মৌলবাদী তৎপরতা নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে ওবামা প্রশাসনকে। লোহিত সাগরের সীমানত্মকূলবতর্ী রাষ্ট্র দুটি ভৌগোলিকভাবে অত্যনত্ম গুরম্নত্বপূর্ণ। এই দুই রাষ্ট্রের দখল প্রতিষ্ঠায় মার্কিনীরা ব্যর্থ হলে এর খেসারত গুনতে হবে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রকে। লৌহিত সাগরের বাণিজ্যিক জাহাজ কিংবা যুদ্ধজাহাজের অবাধ চলাচলে বিঘ্ন এবং বাধা সৃষ্টি করা এখন আল কায়েদার মূল ল্য। এই দুই রাষ্ট্রে সন্ত্রাসী সংগঠন আল কায়েদার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা পেলে বিশ্বের বাণিজ্যিক লেনদেনে তা চরমভাবে প্রভাব বিসত্মার করবে। এই সঙ্কটময় পরিস্থিতি উত্তরণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এখন পুরোপুরি নির্ভর গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর ওপর। বিমান হামলার যথাযথ পদৰেপ গ্রহণের ব্যর্থতাও তাকে ভাবিয়ে তুলেছে চরমভাবে। শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বৈঠকে তিনি এই প্রথমবার তাদের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। আর প্রেসিডেন্টের এই হুঙ্কার শীর্ষ কর্মকর্তাদের বদৌলতে পেঁৗছে যায় পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে কর্মরত এজেন্টদের কাছে। আর তাই শীর্ষ আল কায়েদা নেতাদের ধরতে রীতিমতো মরিয়া হয়ে পড়েছিলেন তারা। আফগানিসত্মানে মার্কিন দখলদারিত্বের শুরম্ন মূলত ২০০৪ সালে অক্টোবরে। পরবতর্ী দুইবছর মার্কিনীরা আফগানিসত্মানের বিভিন্ন অঞ্চলে সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়ে দখলদার বাহিনীতে পরিণত হয়। আর এই দখলদার বাহিনীর উপর্যুপরি বিমান হামলা ছিনিয়ে নেয় অনেক নিরপরাধ সাধারণ আফগানীর জীবন। আর এ ধরনের নিরপরাধ জনগণের মৃতু্য নতুন করে যুদ্ধের গতিপথ পরিবর্তন করে। সাধারণ আফগানীরা মার্কিনীদের বিরম্নদ্ধে যুদ্ধরত তালেবানদের সহায়তা করার পাশাপাশি এখন অর্থলোভে তাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। আফগানিসত্মান যুদ্ধে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তার ড্রোন বিমান হামলার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। কারণ প্রতিকূল পরিবেশে স্থলযুদ্ধের ফলাফল বরাবর আফগানদের প।ে আর পাশাপাশি ড্রোন হামলার ফলাফলও ঈর্ষণীয়। আল কায়েদার বেশ কজন শীর্ষ নেতা এই ড্রোন হামলায় নিহত হয়। তবে ড্রোন হামলার সবচেয়ে গুরম্নত্বপূর্ণ বিষয় হলো গোয়েন্দা তথ্য। আর এই গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ চেষ্টা তাদের এতটা বিপর্যয় ঘটাবে তা ছিল তাদের ধারণারও অতীত। বিগত ২৫ বছরের ইতিহাসে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার ওপর এত বড় আঘাত আর আসেনি। আফগানিসত্মানের খোসত্ম প্রদেশের ক্যাম্প চ্যাপম্যানের এই হামলায় সিআইএ'র অপারেশন প্রধানসহ নিহত হয় মোট ৮ এজেন্ট। হামলাকারী সম্পর্কে আল কায়েদা জানায়, তার নাম সামিউলস্নাহ। তিনি একজন আফগান আর্মির সদস্য। অন্যদিকে মার্কিনীদের দাবি হামলাকারী একজন ডবল এজেন্ট। মার্কিন সূত্রগুলো জানায়, হামলাকারীর নাম হুমাম খলিল। তার বাড়ি জর্ডানের জারকা এলাকায় এবং তিনি পেশায় একজন চিকিৎসক। ইন্টারনেটে আল কায়েদার জেহাদি ফোরামে সংগঠনটির তৃতীয় শীর্ষ নেতা আল ইয়াজিদ জানায়, পাকিসত্মানে তালেবান নেতা বায়তুলস্নাহ মেহমুদ, আবু সালেহ এবং সাইদ আল লিবি্বকে হত্যার প্রতিশোধ নিতেই এই হামলা চালানো হয়। ১৯৮৩ সালে বৈরম্নতে অত্যনত্ম সুরতি মার্কিন দূতাবাসে গাড়িবোমা হামলায় আট ৫জন সিআইএ অফিসার নিহত হয়। দীর্ঘবিরতির পর গত ৩০ তারিখে হামলা ছিল তাদের কাছে এক মরণ কামড়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, আফগান পরিস্থিতি যে দিকে মোড় নিয়েছে, তাতে ফ্রন্টলাইনে এখন রয়েছে কেবল সিআইএ এবং আল কায়েদা।

No comments

Powered by Blogger.